সাগুফতা শারমীনের উত্তর-দক্ষিণা

‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক সে মিছে কল্পনা’। একটি স্পেকুলেটিভ জনরার রূপকথাভিত্তিক ছোটগল্পের বই পড়তে পড়তে এই কলিতে ডুবে ছিলাম কদিন। ফ্যান্টাসি নভেল ক্রনিকলস অব নার্নিয়ার লেখক সি এস লুইস বলেছিলেন, ‘একদিন আপনারা আবারও রূপকথা পড়তে শুরু করার মতো যথেষ্ট পরিণত হবেন।’ পরিণত হয়েছি কি না জানি না, তবে বেশ বুঁদ হয়ে পড়ছিলাম সাগুফতা শারমীন তানিয়ার পুনরুজ্জীবিত রূপকথা উত্তর-দক্ষিণায়—‘রানির মহলে শত শত দীপ জ্বলিত, ধুপ জ্বলিত, মণিমাণিক্যখচিত ভান্ডে গোছা গোছা পদ্মফুল শোভিত হইত। এই পদ্মফুল সংগৃহীত হইত মহলের তিন দিকের পদ্মদিঘী হইতে। রানি এই ফুল ভালোবাসিতেন, রানি নিজেই ছিলেন পদ্মগন্ধা।’

আমরা যারা ছেলেবেলায় দক্ষিণারঞ্জনের পাঠক, তাদের কাছে এই আবহের মাধুর্য অন্য রকম। খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে রূপকথার স্বাপ্নিক ভাষা ব্যবহার করেছেন সাগুফতা। শিশু ভোলানোর কৌশলে সত্য ঘটনার প্রয়োজন যত না, তার চেয়ে বেশি জরুরি কল্পনার উপস্থাপন, মিথ্যাকে সত্যের রূপে উপস্থাপনা। কাজটি সাগুফতা করেছেন সার্থকভাবে এবং ভুলিয়েছেন আমার মতো এক প্রাপ্তবয়স্ককেও।

রূপকথার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতা নিয়ে লিখেছেন ম্যারিনা ওয়ার্নার (২০১৪)। পশ্চিমা দেশে, বিশেষ করে নারীবাদীরা রূপকথার নারী চরিত্রগুলোর নিবিড় আর্থসামাজিক ব্যাখ্যা করেছেন দীর্ঘদিন আগেই। তৈরি হয়েছে ‘সিনডারেলা সিনড্রোম’–এর মতো সমাজবৈজ্ঞানিক পদ। বিশেষত দ্বিতীয় প্রবাহের ফেমিনিস্টরা মূলত নারীর ভূমিকাভিত্তিক পরিচয় গঠনের সূত্র খুঁজতেই রূপকথার অতল শিকড় সন্ধান করেছেন, রূপকথাকে পুনর্নির্মাণ (রিকনস্ট্রাকশন), বিনির্মাণ (ডিকনস্ট্রাকশন), পুনর্ব্যাখ্যা (রিইন্টারপ্রিটেশন) করেছেন। কেউ কেউ আবার পুনঃসৃষ্টি বা রিক্রিয়েশনও করেছেন। সাগুফতার এই বই সেই ধারাবাহিকতারই কাজ।

উত্তর–দক্ষিণা বইয়ের প্রায় প্রতিটি মূল গল্পেই আছে বঞ্চিত নারীর হতাশা, ব্যথা ও অবদমনের কাহিনি। কিন্তু পুনর্নির্মাণের কারিগরিতে রূপকথার নারীদের বিজয়ের আয়োজনও করেছেন তিনি সুকৌশলে। মূক রানি হঠাৎ মুখরা হয়ে উঠলে রাজার প্রতিক্রিয়ার কথা সাগুফতা লেখেন এভাবে, ‘প্রাণ ভরিয়া যে মুখের সলজ্জ সুষমা দেখিতেন, আধ–প্রতিধ্বনি শুনিতেন, সেই মুখের বিদ্যাগর্ভে সুললিত বাণী শুনিয়া তাঁহার (প্রেমিকের) আপন বিদ্যার গড়িমায় ঠেস লাগিতেছে...।’ রূপকথার ছলে সাগুফতা তুলে এনেছেন পুরুষের অহং। তিনি এনেছেন নারীর প্রান্তিকতাও, ‘...আমিও সেইরূপ সর্বক্ষণ তর্ক করিতাম। নিদ্রাউলি আসিতে আমার পিতা হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছিলেন, স্ত্রীলোকের মুখে স্মৃতিশাস্ত্র লইয়া তর্ক কে সহ্য করে! আপন পিতা কন্যাকে অনন্ত নিদ্রার গর্ভে সঁপিয়া দিলেন, এই শোকের উচ্ছাস দমাইয়া রাখিতে আমি নিদ্রা যাই। জাগিয়া উঠিলে আমার তর্ক করিবার বাক জাগিবে, বুদ্ধি জাগিবে, তুল্যমূল্য বুঝিয়া নিবার মন জাগিবে। প্রকাশ্য সভায় আপন পাণ্ডিত্য দেখাইবার রোখ চাপিবে। তাহাই কি তুমি চাও?’ সাগুফতা চমক তৈরি করেছেন, যখন রূপকথার আবহের ভেতর খুব কৌশলে গ্রথিত করে দিয়েছেন একবারেই হাল আমলের কোনো অনুষঙ্গ। যেমন রানির সাজঘরে হঠাৎ দেখা যায় ‘ডিলাক্স’ সিঁদুরের কৌটা কিংবা সেই প্রাচীন রাজ্যের ঢোলবাদ্যের ভেতর হাজির হন কুমার শানু। যথার্থই রূপকথার পুনরুজ্জীবন।

এই বই রূপকথার আদলে নারী অভিজ্ঞতারই বয়ান হলেও আমাদের মনে রাখা দরকার যে নানা ঐতিহাসিক বিবর্তনে পৃথিবীর ও বাংলাদেশের নারীর জীবনাভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে নারীবাদের ধারাও পথ চলেছে একাধিক স্তরে। সেদিক থেকে বইটিতে নারীবাদের কিংবা নারীর অভিজ্ঞতার জায়গাটি রয়ে গেছে কিছুটা এক ধারার বয়ানে। যেখানে নারীর অবদমন আর পুরুষের অধিপতি মানসিকতাই মুখ্য। উত্তর–দক্ষিণায় লেখক অবশ্য ভাষা আর আবহের চমৎকার এক কৌশল খুঁজে নিয়েছেন, যেখানে আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ দেশের নারীদের আরও জটিল বহুস্তরী অভিজ্ঞতা ধরার সুযোগ ছিল, যার পুরোটা ব্যবহৃত হয়নি বলে মনে হয়েছে।

সেই অপূর্ণতা অবশ্য ভুলিয়ে দেয় সাগুফতার ভাষা আর আবহ নির্মাণের দক্ষতা। পাঠককে স্মৃতির ঘোরে ফেলে দেয় এই ভাষা, নিয়ে যায় বর্ণাঢ্য শৈশবে। তাই তো এই বই পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, ‘জাগিয়ো না, আমায় জাগিয়ো না...।’ এই উত্তরকালে এক নব, তদুপরি নারী দক্ষিণারঞ্জনের দেখা পাইয়া যারপরনাই পুলকিত হইয়াছি। অভিনন্দন সাগুফতা শারমীনকে।


উত্তর–দক্ষিণা: পুনরুজ্জীবিত রূপকথা

সাগুফতা শারমীন তানিয়া

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

১১২ পৃষ্ঠা; দাম: ২০০ টাকা।