আগস্ট আবছায়া

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
আজ থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। বইমেলায় প্রকাশিতব্য নির্বাচিত তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে...


জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মম হত্যাকণ্ডকে উপজীব্য করে লেখা এই উপন্যাসে বিশদভাবে ধরা পড়েছে ১৫ আগস্টের কালো রাতের কাহিনি। সেই বই থেকে নির্বাচিত অংশ।

শেখ কামাল নিচে নেমে এলেন। তখনো গেটের সামনের কালো ও খাকি আর্মিদের দল গেট পার হয়ে ভেতরে ঢোকেনি, ঢুকবে ঢুকবে করছে। কামাল চেঁচিয়ে রিসিপশন রুমের সামনে জড়ো হওয়া কুমিল্লার ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির এদের এবং পুলিশের ওই তিন–চারজনকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আব্বা আর্মি চিফের সাথে কথা বলেছেন, কর্নেল জামিলের সাথে কথা বলেছেন। আর্মিরা চলে আসবে এক্ষুনি। এইটা জাসদের হামলা, জাসদ, সর্বহারা গ্রুপ মিলে হামলা। আর্মি এসে যাবে। ভয় পাবেন না আপনারা।’

মাসরুর আরেফিন
মাসরুর আরেফিন

এই কথা বলতে বলতে শেখ কামাল রিসিপশন রুম থেকে সামান্য সরে বাইরের দিকে পা রাখলেন এবং গেটে ওই আর্মিদের দেখে অনেক খুশি হয়ে বললেন, ‘আর্মি ভাইয়েরা কারা আসছেন, ভিতরে আসেন। কারা আসছেন, ভিতরে আসেন।’ পুলিশের দুজন পাশ থেকে শেখ কামালের হাত ধরে ভেতরের দিকে টেনে রাখলেন, যেন তিনি বাইরে চলে না যান। শেখ কামাল বিভ্রান্ত। আমি তাঁর থেকে সামান্য দূরে, আমার সামনে কুমিল্লার রেজিমেন্টের ওদের ভিড়। শেখ কামালের পেছনে পিএ মুহিতুল ইসলাম। হঠাৎ গেট ধাক্কা দিয়ে এদিকে এগোতে থাকল কালো পোশাক ও খাকি পোশাকের দশজনের মতো একটা দল। তারা আমাদের এখানে পৌঁছে গেল একমুহূর্তে, গাড়িবারান্দা ও গেটের দূরত্ব অতখানিই কম। তারা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল ‘হ্যান্ডস আপ’, ‘হ্যান্ডস আপ’। বিভ্রান্ত কামাল ও পুলিশের তিনজন—নুরুল ইসলাম, সিদ্দিকুর রহমান, খোরশেদ আলী—একসঙ্গে হাত উঁচু করলেন। শেখ কামালের চোখেমুখে বিস্ময়। তিনি হাত উঁচুতে তোলা অবস্থাতেই বললেন, ‘আমি শেখ কামাল। শেখ মুজিবের ছেলে কামাল।’ আরও দুবার দলটা বলে উঠল, ‘হ্যান্ডস আপ’, ‘হ্যান্ডস আপ’।

আমি ভাবি, এরা কি দেখছে না যে এখানে সবার হাতই ওপরে ওঠানো, এমনকি কুমিল্লার আর্মিদেরও, কেবল আমারটা ছাড়া। আমি নেই, ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি আছি। আমি দোতলার দিকে কান পাতি। বুঝতে পারি দোতলার সবাই একদম নিশ্চুপ হয়ে, শ্বাস চেপে নিচের সব কথাবার্তা, গতিবিধি, আজকের এই ভোরের সামনে এগোনো—সব বুঝতে চাইছেন কান দিয়ে। আমি হঠাৎ একটা সাব–মেশিনগানের—এনফিল্ডের তৈরি স্টেনগান ওটা—আট ইঞ্চি ব্যারেলের ঝলক দেখতে পেলাম, ক্যাপ্টেন হুদার হাতে ঝলকে উঠল তা। হুদা শেখ কামালকে গুলি করল তাঁর পায়ে। দুটো গুলি। ঠ্যাট-ঠ্যাট। শেখ কামাল তখনো ভাবছেন, এই খাকি পোশাকের আর্মি তাঁকে গুলি করছে কেন। তিনি পায়ে গুলি নিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে গেলেন মুহিতুল ইসলামের ঠিক পাশে, এমনভাবে পড়লেন যে তাঁর ধাক্কায় মুহিতুলও নিচে পড়লেন। আমি দেখলাম মুহিতুলের শরীরের অর্ধেক টেবিলের নিচে, বাকি অর্ধেক টেবিলের বাইরে। আমি কামালের আর্তচিৎকারে কানে হাত দিলাম। কামাল পড়তে পড়তে বলছেন, ‘হো-য়া-ট?’

ক্যাপ্টেন হুদা এবার আবার গুলি করল তাঁকে, বুকে ও তলপেটে, শর্ট ব্রাশফায়ার। আমি কোন দিকে যাব? গুলি চলার সময় কী বিভীষিকাময় শব্দ, কিন্তু গুলি শেষে কী ভয়ানক নিস্তব্ধতা। তিন দিক থেকে তিনটা আওয়াজ পেলাম। দোতলায় এক মেয়ের কণ্ঠে—‘কা-মা-ল’; আমার মনে হলো সুলতানা কামালের চিৎকার ওটা। কা ও মা জোরে, আর ল বলতেই কে যেন ওই নারীকণ্ঠকে মুখে হাতচাপা দিয়ে থামিয়ে দিল ঠাং করে। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো বেগম মুজিবের চিৎকারও হতে পারে ওটা। আমার বাঁয়ে রিসিপশন রুম থেকে শুনলাম কামালের কণ্ঠে তীব্র ব্যথার এক গোঁ গোঁ আওয়াজ, তার পা দেখলাম নড়ছে ফড়িংয়ের পাখার মতো, তার ডান হাত পেটের ওপরে চলে এসেছে, যেখান থেকে পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে গুলি, হাতটা সামনে নিয়ে হাত কী পরিমাণ রক্তে ভেসে গেছে, তা দেখারও আর শক্তি নেই কামালের। মাত্র দুই মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় র​্যাগ ডে উদ্​যাপনের দিনে তাঁকে আজকের আগে শেষবার দেখেছিলাম আমি। সারা দিন নাচগান, রঙিন উৎসব। তিনি ছিলেন উৎসব কমিটির আহ্বায়ক। এসব আয়োজনে, নির্দেশনায় তাঁর সমান আর কেউ ঢাকা শহরে নেই, নিশ্চিত। সারা দিন অবশ্য তাঁকে সেদিন দেখিনি আমি কোথাও, শেষে দেখলাম বিকেলে কলাভবনের চত্বরে বটতলায়, যখন কিনা সবাই মিলে তাঁকে ‘র​্যাগ মার্শাল’ উপাধিটা দিল। সন্ধ্যায় টিএসসির সবুজ চত্বরে প্রজেক্টরে সিনেমা দেখানো হবে। ভিড় আর ভিড়। মনে আছে, কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আজকের ছবির নাম সত্যকাম, হিন্দি ছবি।’ ঘোষণা শুনেই কী উল্লাস আমাদের!

তৃতীয় আওয়াজটা অনেক বড়, অনেক সম্মিলিত এক আওয়াজ। প্রায় ৪০ জন আর্মি বানের পানির মতো এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। কালো পোশাক—ল্যান্সার। খাকি পোশাক—আর্টিলারি। আমি এত দিনের অব্যবহৃত, জংধরা অস্ত্রগুলো থেকে জং পড়া লোহার গন্ধের মতো কেমন এক শরীর বিবশ করা গন্ধ পাচ্ছি সবদিকে, একটু আগের গুলির কার্তুজ পোড়া গন্ধও। আর্মির লোকেরা দ্রুত চলে গেল এ বাড়ির সাতটা সেন্ট্রি পোস্টের কাছে—চারটা পুলিশের, তিনটা আর্মির। তারা সাত পোস্টের সাতজনের কাছ থেকে রাইফেল সিজ করে নিল। বাড়ির দক্ষিণ শেডে, লেকের দিকটায়, কুমিল্লা রেজিমেন্টের দিকে গেল দেখলাম খাকি পোশাকের একটা ছোট দল। এদের একজন, রিসালদার সারোয়ার, হাততালি দিতে দিতে বলছে, ‘এসবি, পুলিশ, হাউস গার্ড, ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারি, এসবি, পুলিশ, হাউস গার্ড, ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারি—ফল ইন, ফল ইন, ফল ইন।’

হুদা শেখ কামালকে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ারে মেরে আজকের দিনের ঘুঁটি সশব্দে সামনের দিগন্তবিস্তৃত পথে চেলে দিয়েছে, তার এখন মানমর্যাদাই অন্য স্তরের। একজন সেনা চিৎকার করে বলল, ‘নিচতলার রুমে যারা আছে, সবাই বাইরে আসো, না হলে ব্রাশফায়ারে মারা যাবা। সবাই বাইরে আসো।’ হুদা নিজেও চিৎকারের সঙ্গী হলো, ‘আউট, আউট, জয়েন দ্য লাইন, আউটসাইড। আউট আউট।’ শেখ কামাল ছাড়া সবাই বের হয়ে এলেন, দাঁড়ালেন সামনের ফল ইন হওয়া লাইনে। মুহিতুল ইসলামের পাশে এসবির ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর দাঁড়িয়ে। রক্ত ঝরছে মুহিতুল ইসলামের ডান হাঁটু থেকে, রক্ত ঝরছে তাঁর ডান পায়ের জুতো ভেদ করে পায়ের গুঁড়িয়ে যাওয়া কনিষ্ঠ আঙুল থেকে, রক্ত ঝরছে নুরুল ইসলামেরও হাঁটুর একটু নিচ থেকে। আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি যে এ দুজন শেখ কামালকে উদ্দেশ করে করা ব্রাশফায়ারে এভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন হাঁটুর মতো বিপজ্জনক ও সংবেদনশীল জায়গায়। দুজনেরই পা, দুজনেরই হাঁটুর হাড় নিশ্চয়ই গুঁড়িয়ে তছনছ হয়ে গেছে। আশ্চর্য! ব্যথায় চিৎকার করছেন না কেন এ দুজন? এ অবস্থায় পালাতে চাইছিলেন তাঁরা? আশ্চর্য!

হঠাৎ ল্যান্সারের এক সেনা, তাকেও এই ভোরে কিছু একটা করতে হবে বলে কিছুটা অনিচ্ছা থেকে আসা ইচ্ছায়, কিছুটা নায়ক হতে চাওয়ার জেদ থেকে, সরাসরি সিদ্দিকুর রহমানের বুকে গুলি চালাল। তার গুলি চালানোর ঠিক আগের মুহূর্তে, রিভলবার সিদ্দিকুরের দিকে তাক করার পিছলে-দ্রুত-সামনে-সরে-যাওয়া মুহূর্তে, সিদ্দিকুরের হাত থেকে ভয়ে তার নিজের রিভলবারটা পায়ের কাছে পড়ে গেল। এটা দেখেও গুলি চালাল ল্যান্সারের লোকটা। তার পাশের জন, মুখে দাড়ি, বড় গোঁফ, নুরুল ইসলামকে বলল, ‘তুমিই তো এদের সবার নেতা। ভেতর থেকে গুলি করার আদেশ তুমিই তো দিছ। চল, তোরে আমি গুলি করে মেরে ফেলব।’ সে নুরুল ইসলামকে টেনে গেটের বাইরে নিয়ে গেল। নুরুল ইসলাম হাউমাউ করে বললেন, ‘আমার বাচ্চা আছে, আমার বউ আছে, আমার মা বৃদ্ধ, আমার বাচ্চা আছে।’ আমি তাদের পেছন পেছন গেলাম।

আমি বাইরে বাঁয়ে তাকালাম। দেখি দুটো ট্যাংক দাঁড়ানো, দেখি একজন রাস্তার ফুটপাতে হাত-পা স্টারফিশের মতো ছড়িয়ে মরে পড়ে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। বুকের নেমপ্লেটে দেখি লেখা—‘শামসু’। সিপাহি। তিনি এ বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীদের একজন। একদম শুরুর ওই আর্টিলারি কামানের একটা গোলার স্প্লিন্টারের আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে মারা গেছেন তিনি, তাঁর মাথা আলাদা হয়ে গেছে প্রায়, কোনোমতে আটকে আছে তা মূল স্টারফিশের সঙ্গে।

এবার আমার চোখ গেল মিরপুর রোডের দিকে। একটা রিকশা দেখলাম যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে নয়, ফুটপাতের ওপর দিয়ে। রিকশাওয়ালা শরীর অর্ধেক করে, অসম্ভব নুয়ে থেকে এক দানবীয় শক্তিতে তার রিকশা টেনে টেনে নিয়ে চলেছে মূল রাস্তা ছেড়ে, সরু এবড়োখেবড়ো ফুটপাত ধরে। আমি তাকে ডাকলাম, ‘হেই, হেই।’ ভাবলাম সে পাগল নাকি, এ সময়ে যাচ্ছে এই রাস্তা ধরে? আর্মিরা তো স্রেফ পেশাব করার প্রয়োজন থেকে কিংবা স্রেফ এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা থেকে তাকে সোজা গুলি করে বসবে তার মাথা–বরাবর। রিকশাওয়ালা আমার দিকে তাকাল না, সে ঘাড় বাঁকা করে রিকশা টানতে লাগল এমনভাবে, যেন মহাস্থানগড়ের সমান এক পাথরখণ্ড টানছে সে। তক্ষুনি, তক্ষুনি মিরপুর রোড ও ৩২ নম্বর রোডের একদম মিলনস্থলে, আমি রিকশাওয়ালাকে ডাকতে ডাকতে যেদিকে ছুটে গেছি কিছুটা, সেখানে দেখলাম তিনটে মহিষ, ওদের নাকের ফুটোগুলো আস্ফালনে ভরা, চোখের দৃষ্টি শান্ত বেহায়ার, মুখে গেঁজিয়ে ওঠা চুন রং ফেনা, শিং নিচের দিকে নামানো, শিং পেছনের দিকে চলে গেছে অর্ধবৃত্তাকার এক রামদা হয়ে, পেট বড়, দেহ ছোট। কী করছে ওরা এইখানে? কার বাড়ির মহিষ এরা? এই ভোরে যাচ্ছে কোথায়? আমি মহিষ তিনটে থেকে তখন মাত্র পাঁচ-ছয় গজ দূরে, তাকিয়ে দেখছি ওদের, ওরা তাকিয়ে আছে কিছুটা নিচের দিকে, আসলে কোন দিকে তা বলতে পারবে না এই পৃথিবীর কেউ। আমার পেছনে আবার গুলির শব্দ শুরু হলো, আমি এক পা এগোলাম মহিষগুলোর দিকে। হঠাৎ তিনটে মহিষই একসঙ্গে, মিলি সেকেন্ড-ন্যানো সেকেন্ড মেনে একসঙ্গে, একযোগে, ঝাঁৎ করে আমার দিকে মাথা তুলল এবং দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বাঘের মতো, বড় কুকুরের মতো, বনবিড়ালের মতো প্রচণ্ড জোরে এক আকস্মিক ‘খ্যা’ শব্দ করে চোখ গরম দিল আমাকে।

আমি উল্টো ঘুরে প্রাণপণে দৌড়ে যেতে লাগলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। দৌড়াচ্ছি এবং দেখছি, আমার কিছুটা সামনে মেজর নূর মোবাইল ফোনে কথা বলছে মেজর শাহরিয়ার রশিদ খানের সঙ্গে, বলছে ‘শাহরিয়ার, শাহরিয়ার, নো নো, উই হ্যাভ অনলি কিলড কামাল, হ্যালো, ইয়েস, তোমাদেরটা বলো।’ আমি থমকে দাঁড়ালাম নূরের সামনে, এবং ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম দিগন্ত কাঁপিয়ে—এতটা ভয় আমি শেখ কামালের মৃত্যু দেখেও পাইনি, ওই তিন মহিষের অবিশ্বাস্য মাংসাশী বাঘের আচরণ দেখেও পাইনি। কী করে মোবাইল ফোন এল ১৯৭৫ সালে? তার মানে? তার মানে বর্তমান ঢুকে গেছে ভবিষ্যতে আর ভবিষ্যৎ চলে গেছে অতীতে আর বর্তমান উপেক্ষা করছে অতীতের পথে ছুটে যাওয়া আর অতীত বিযুক্ত হয়ে গেছে ভবিষ্যৎ থেকে?

আগস্ট আবছায়া

মাসরুর আরেফিন

প্রচ্ছদ: সেলিম আহ্​মেদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।