অ্যারিস্টটল কি ভ্রান্ত

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আজ থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। বইমেলায় প্রকাশিতব্য নির্বাচিত তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে...


এবারে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন গণতন্ত্রের অভিমুখে নামে একটি বই। এখানে গ্রন্থিত প্রবন্ধগুলোয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাবন্ধকার দেখতে চেয়েছেন সমাজ, ইতিহাস ও দর্শনের আলোয়। এই বইয়ের ‘অ্যারিস্টটল কি ভ্রান্ত’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ।

 অ্যারিস্টটল কি তবে ভুল বললেন? তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে গরিবতন্ত্র। কথাটা কি ভুল, নাকি ঠিক?

তাঁর গুরু প্লেটো বলেছিলেন মূর্খতন্ত্র। গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খদের রাজত্ব। অধিকাংশ লোকই মূর্খ, গণতন্ত্রের অছিলায় এই মূর্খরাই রাজত্ব কায়েম করে। গুরু প্লেটোর এই কথার সঙ্গে শিষ্য অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের তফাত আছে, আবার নেইও। নেই বলছি এই জন্য যে, যেখানে দারিদ্র্য, সেখানেই তো অজ্ঞতা। লোকে শখ করে মূর্খ হয় না, বাধ্য হয়েই হয়, দারিদ্র্যই তাদের বাধ্য করে। গরিব বলেই মূর্খ হয়, মূর্খ বলে গরিব নয়। কাজেই গরিবের রাজত্ব বললেই মূর্খের রাজত্ব বোঝাবে এবং গরিবতন্ত্র বলে যদি গণতন্ত্রের পরিচয় দিতে চান কেউ, তবে সেই পরিচিতির মধ্যে মূর্খের শাসনের উপাদানটিও রয়ে যাবে।

কিন্তু কথাটা কি ঠিক? গণতন্ত্র মানে কি দরিদ্রের রাজত্ব? এটা অবশ্যই যথার্থ যে, গরিবেরা গণতন্ত্র চায়। চায় এই বিশ্বাসে যে, গণতন্ত্র তাদের স্বাধীনতা দেবে, সাম্যও দেবে, আর দেবে ক্ষমতা। ভোট খুব মূল্যবান তাদের কাছে। কেন? বাজারে বেচা যায় বলে? না, সে জন্য নয়। ভোট তাদের মর্যাদা দেয়, গুরুত্ব দেয়, ক্ষমতাবান করে তোলে। আত্মবিশ্বাসও দিয়ে থাকে। এই বোধ সৃষ্টি হয় যে, রাষ্ট্রশাসনে তাদেরও মতামত আছে এবং সেই মতের দাম রয়েছে। এই বোধটা কম মূল্যবান নয়।

কিন্তু ধনীরাও তো গণতন্ত্র চায়, আজকাল। তাহলে? এমনকি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি ক্ষমতায় আসে কোনো সরকার, তখনো অচিরেই দেখা যায় যে, সে ভারী গণতন্ত্রমনা হয়ে পড়ে। বলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করে ছাড়ব না কিছুতেই। ওদিকে সরকারবিরোধীরা তো চায়ই, চাইবেই। সরকারকে দরিদ্র বললে অপমান করা হবে, বিরোধীরাও গরিব নয় মোটেই। তবে কি ভুল বলেননি ওই গ্রিক দার্শনিক? মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি ওই ‘জ্ঞানীদের গুরুর বক্তব্য’?

না, মিথ্যা বলেননি অ্যারিস্টটল। ধনীর গণতন্ত্র ও গরিবের গণতন্ত্রে বিস্তর ব্যবধান। তা ছাড়া ধনবানেরা যেভাবে গণতন্ত্র চায়, দরিদ্ররা সেভাবে চায় না। ধনীদের জন্য গণতন্ত্র হচ্ছে শাসনের সুযোগ, গরিবদের জন্য তা বাঁচার আশা। ব্যবধান আসমান-জমিনের। দেশে গণতন্ত্র এলে কোনো গরিব মন্ত্রী হবে না, গাড়ি পাবে না, নিশান ওড়াবে না। (দরিদ্রের নিশান একটাই—জাতীয় নিশান।)

িশল্পীর চোখে অ্যারিস্টটল
িশল্পীর চোখে অ্যারিস্টটল

অ্যারিস্টটল অবশ্য লুকাছাপা করেননি। তিনি গরিবের রাজত্ব কায়েম করতে চাননি, ধনীর রাজত্বই চেয়েছেন। পারলে অভিজাততন্ত্রই থাকুক, না পারলে কতিপয়তন্ত্র পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র কখনোই নয়। কতিপয়তন্ত্রও ধনীর শাসনই, গণতন্ত্র হচ্ছে এই কতিপয়তন্ত্রের বিকৃতি। সে যেন কখনো না আসে কোনো দেশে। আব্রাহাম লিঙ্কন যে গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন জনগণের শাসন, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, সে তো এই সেদিনের ঘটনা, মাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর। অ্যারিস্টটলের সঙ্গে যদি দেখা হয় লিঙ্কনের, তবে ওই গ্রিক দার্শনিক বলবেন তাঁকে, ‘ভুল বলেছেন, হে রাষ্ট্রপতি, গণতন্ত্র হচ্ছে দরিদ্রের শাসন, দরিদ্রের জন্য, দরিদ্রের দ্বারা।’ না, যে অর্থে আজ আমরা বলি, সেই অর্থে নয়। প্রশংসার অর্থে নয়, নিন্দার অর্থে। বলে গম্ভীর হয়ে যেতেন তিনি, গুরু যিনি জ্ঞানীদের।

গণতন্ত্রের অভিমুখে

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা

প্রকাশক: কথা প্রকাশ, ঢাকা।