কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চিঠি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯ অক্টোবর ১৯২৪—২৫ ডিসেম্বর ২০১৮) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯ অক্টোবর ১৯২৪—২৫ ডিসেম্বর ২০১৮) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার অপ্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছিল তারও ১০ বছর আগে, ১৯৬১ সালে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে কিংবা কবিতা লিখি বলে কবিতা পড়া সম্পর্কে আগ্রহ একটু বেশি। ওই সময়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নতুন কবিতার বই অন্ধকার বারান্দা কিনে ফেললাম। তাঁর কবিতার সঙ্গে আগেই পরিচিত হয়েছিলাম দেশ পত্রিকার মাধ্যমে। সেই পরিচয়ের ব্যাপ্তি ঘটল অন্ধকার বারান্দা পাঠের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, অন্ধকার বারান্দার প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রচ্ছদ এঁকেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী, বইটি কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। কী কারণে জানি না, অন্ধকার বারান্দা আমার মনের ভেতর আলো জ্বেলে দিল। বইটি আমার মনের মধ্যে একধরনের ঘোর তৈরি করল। আমি শীতাংশু আর অমলকান্তির মোহে বন্দী হয়ে রইলাম।

মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় গিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে প্রথমে সাক্ষাৎ করলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। ষাটের দশকে আমার তিন–চারটা কবিতা দেশ পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার সুবাদে আত্মপরিচয় দিতে কুণ্ঠিত ছিলাম না। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমার হাত চেপে ধরলেন। সেই থেকে শুরু। বিগত ৪৮ বছরে তাঁর সঙ্গে অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি কলকাতায় গেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া ছিল অনিবার্য। মুক্তিযুদ্ধের পর আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিই। সরকারি কাজে কখনো দিল্লি বা ভারতের অন্য কোথাও গেলে কলকাতায় যাত্রাবিরতি করতাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমার আর ভারতে যাওয়া হয়নি।

নীরেনদার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ঢাকায়। মাসিক কালি ও কলম পত্রিকায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি ২০১২ সালে ঢাকা এসেছিলেন। ওই সময়ে, ৪ এপ্রিলে পত্রিকাটির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের পরদিন, অর্থাৎ ৫ এপ্রিল তিনি আমার ইস্কাটনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তাঁরা আমার বাসস্থানে ছিলেন। মূলত নীরেনদা ও আনিস স্যার বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। হাসনাত ও আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কবি হিসেবে শুধু বিশেষ খ্যাতিমান নন, বাংলা কাব্যসাহিত্যে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়, তিনি একাধারে কবি, সম্পাদক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ভাষাবিদ, বাংলা একাডেমির দক্ষ সংগঠক। অন্যদিকে তিনি একজন সফল পারিবারিক মানুষ। তাঁর পরিবার অসাধারণ উজ্জ্বল একটি পরিবার। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী সুষমা চক্রবর্তী ছিলেন তদানীন্তন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি জেল পর্যন্ত খেটেছেন। সুষমা চক্রবর্তীর বাবা শ্রী মনোরঞ্জন রায়চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যকালের শিক্ষক ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর কথা উল্লেখ রয়েছে। পুত্র কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাহিত্য সমালোচক। কবির দুই কৃতী কন্যা সোনালী চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং শিউলি সরকার এখন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষ। দুই জামাতা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব এবং অভিরূপ সরকার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজ্য সরকারের অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান। কবির পুত্রবধূ কাকলি চক্রবর্তী একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাবেক সম্পাদক। এই পরিবারের পরিচয়কে আরেকটু বিস্তৃত করা যেতে পারে। অভিরূপ সরকার কবি অরুণ কুমার সরকারের পুত্র। অন্যদিকে কাকলি চক্রবর্তী সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষের কন্যা।

দুই.
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মোট ৩টি চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। একটি চিঠি খুঁজে পাচ্ছি না। কোথাও যত্নসহকারে তুলে রাখার কারণেই একটি চিঠি হারিয়ে গেছে। বাকি দুটি চিঠি এতদ্সঙ্গে প্রকাশিত হলো।
প্রথম চিঠিটির সূত্র ধরে একটি বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। আমি মাঝেমধ্যে ফোন করে নীরেনদার ও তাঁর পরিবারের খোঁজখবর নিতাম। একবার তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে নীরেনদার শ্বশুরের কথা উল্লেখ করেছেন। শুনে আমি কিছুটা বিস্মিত হই। কারণ এ তথ্য আমার জানা ছিল না। পরে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতা উল্টে দেখি সেখানে লেখা, ‘১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাশ আমি নিশ্চয়ই করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক করাতেন। অঙ্ককে আমার ভয় ছিল। কারণ ভুল করে ফেলতাম। অঙ্কের জন্যই বোধ হয় প্রথম বিভাগ পাব না।’ নীরেনদার শ্বশুর শ্রী মনোরঞ্জন রায়চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর বিদ্যালয়জীবনের শিক্ষক ছিলেন। আমি নীরেনদাকে বলেছিলাম মনোরঞ্জন বাবুর সংক্ষিপ্ত জীবনী আমাকে পাঠালে বইয়ের জীবনবৃত্তান্তমূলক টীকায় তাঁর নামটি জুড়ে দেওয়া যাবে। নীরেনদার প্রেরিত সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে পাঠিয়ে দিই, যিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে শুনতে পাই কাগজটি স্থানচ্যুত হওয়ায় সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। আমিও মূল কপিটিই শামসুজ্জামান খানকে পাঠিয়েছিলাম। যাহোক, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পরবর্তী কোনো সংস্করণের জীবনবৃত্তান্তমূলক টীকায় অন্যদের নামের সঙ্গে মনোরঞ্জন বাবুর নামটিও উল্লেখ করা যেতে পারে। এ লেখার সঙ্গে নীরেনদার চিঠিগুলো যুক্ত করে দিলাম।

একগুচ্ছ চিঠি
১২২ (বি ব্লক) বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ, কলকাতা ৭০০ ০৫৫ পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ২৩ জুন, ২০১৩
স্নেহাস্পদেষু মাহবুব, গত বছর আমার জন্মদিনে তুমি মূর্ত ও অমূর্ত নামে তোমার যে গ্রন্থখানি পাঠিয়েছিলে, সেটি পড়ে মুগ্ধ হই। তোমার গল্প লেখার হাত যে এত পাকা এবং গদ্য এত প্রাঞ্জল ও সাবলীল, তা জানা ছিল না। কিছুদিন আগে পেলুম তোমার কবিতার বই। ইতিপূর্বে তোমার ছড়া পড়ে বলেছি, ‘শাবাশ’। এবারে কবিতা পড়েও সেই একই কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু তুমি যে এত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে, তা তো কই জানতুম না। কবিতা পড়ে সেটা জানতে হলো ও কষ্টও পেলুম খুব। যা-ই হোক, আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি: নীরোগ দীর্ঘজীবী হও। একটা আক্ষেপের কথা বলি। তোমার চিঠিখানা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে খোয়া গেছে তোমার নতুন ঠিকানাও। বাধ্য হয়ে তাই তোমার প্রকাশক শুদ্ধস্বরের ঠিকানায় এই চিঠিখানা লিখতে হলো। একই সঙ্গে পাঠালুম বঙ্গবন্ধুর বিদ্যালয়জীবনের শিক্ষক মনোরঞ্জন রায়চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী। আশা করি, তাঁরা এ-চিঠি দ্রুত তোমার হাতে পৌঁছে দেবেন। চিঠি পেয়েই তুমি আমাকে ফোন করে জানিয়ো। নইলে বড় চিন্তায় থাকব। আবার বলি, নীরোগ দীর্ঘজীবী হও। বাংলা সাহিত্যকে আরও অনেক-কিছু তোমার দেবার আছে। তোমরা সবাই আমার স্নেহ ও শুভেচ্ছা জেনো। নীরেনদা

ওই চিঠির উত্তর না পেয়ে তিনি আবার লেখেন:
NIRENDRANATH CHAKRAVARTI
122 (Block B) Bangur Avenue CALCUTTA, West Bengal, India Pin: 700 055
মাহবুব, তোমার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মনে হচ্ছে, শুদ্ধস্বর তোমার চিঠিখানা তোমার হাতে পৌঁছে দেননি। তাই আমার মেয়ে সোনালীর হাত দিয়ে সেই চিঠির একটি অনুলিপি আবার তোমাকে পাঠাইলাম। সঙ্গে রইল বঙ্গবন্ধুর অঙ্কের শিক্ষক মনোরঞ্জন রায়চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী। ভালোবাসা জানাই। ভাল থেকো। নীরেনদা দ্বিতীয় চিঠির বিষয়বস্তুটি পারিবারিক। ২০১৪ সালের আগস্টের ২৬ তারিখে আমার ছেলে শোভন মাহবুবের বিয়ে হয়। প্রায় একই সময়ে ২৯ আগস্ট আমার ও নীলুফারের বিয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্​যাপনের আয়োজন করা হয়েছিল। দুটি অনুষ্ঠানেই আমন্ত্রণ জানিয়ে নীরেনদাকে কার্ড পাঠাই। উত্তরে নীরেনদা আমাদের নিচের চিঠিখানি লিখে পাঠান, যাতে তাঁর আন্তরিকতা ও স্নেহশীলতার স্পর্শ অন্তর ছুঁয়ে যায়। চিঠিখানি নিম্নরূপ: ১২২ (বি–ব্লক) বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ, কলকাতা ৭০০ ০৫৫ ২৫ শ্রাবণ, ১৪২১ পরম স্নেহাস্পদ মাহবুব ও নীলুফার, এ তো একই সঙ্গে দু–দুটি মহোৎসব। একটি তোমাদের ছেলের বিবাহের আর অন্যটি তোমাদের বিবাহের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষপূর্তির। তোমাদের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়েরও পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র বছর কয়েক বাকি। পেছনে তাকালে কত কথাই যে মনে পড়ে। সে বড় সুখের দিন ছিল না। তবে সম্প্রীতির সম্পর্ক যেখানে নিবিড়, সব দুঃখই যে সেখানে হার মেনে যায়, তা–ও তো মিথ্যে নয়। যেমন তোমাদের পুত্র ও পুত্রবধূ তেমনি তোমাদেরও আমাদের আশীর্বাদ ও শুভকামনা জানাই। তারা শুরু করুক তাদের মঙ্গলময় নবজীবন, আর তোমরা এগিয়ে চলো তোমাদের যৌথ জীবনের হীরকজয়ন্তী পূর্তির দিকে। সুখী হও, সুখী করো। সুখে থাকো, সুখে রাখো। নীরেনদা (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)