সত্যিকারের লেখক পুরস্কারের কথা মাথায় রেখে লেখেন না

নিজের বাড়িতে বসে হাসান আজিজুল হক বললেন, সমস্ত বড় লেখকের একটাই ধ্রুব আছে—সময়, সমাজ, মানুষ। ছবি: শহিদুল ইসলাম
নিজের বাড়িতে বসে হাসান আজিজুল হক বললেন, সমস্ত বড় লেখকের একটাই ধ্রুব আছে—সময়, সমাজ, মানুষ। ছবি: শহিদুল ইসলাম
কথার জাদুকর তিনি—হাসান আজিজুল হক। আগামীকাল বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিকের ৮০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন নিজের সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যসহ নানা প্রসঙ্গে অকপট কথাবার্তা। লেখকের রাজশাহীর বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাকির তালুকদার।


জাকির তালুকদার: ২ ফেব্রুয়ারি আপনার ৮০তম জন্মদিন। এই দীর্ঘ জীবন পাড়ি দেওয়ার পর পেছন ফিরে তাকালে কী দেখতে পান?

হাসান আজিজুল হক: আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন—জীবনের দিকে যদি পেছন ফিরে তাকাই, দেখি বিচিত্র সব ছবি। বর্ধমান, খুলনা, রাজশাহী—সবকিছু একাকার হয়ে যায়। একজীবনে কম তো দেখা হলো না—দেশভাগ দেখলাম, বাস্তুভিটা ছেড়ে এলাম, এ দেশে আবার নতুনভাবে ভিটেমাটি তৈরি করলাম। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল ঘটনার মুখোমুখি হলাম। মানে আমার এই জীবনটা ভাঙা–গড়ার ভেতর দিয়েই কেটে গেল। জীবনের এই সব ভাঙা–গড়াই নানাভাবে ফিরে ফিরে এসেছে আমার গল্পে, উপন্যাসে। তাই পেছনে তাকানোর কথা যদি বলো, আমি দেখতে পাই একটি কিশোর ছুটছে, ক্রমাগত ছুটছে।

জাকির: এবার সাহিত্য নিয়ে কথা বলি। আপনি বড় লেখকদের বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, আপনার মতো করে। সেই পর্যবেক্ষণটি বলবেন?

হাসান: আমরা যে স্যুররিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে চেঁচামেচি করি, সেসব নিয়ে ইউরোপে কেউ মাথা ঘামায়? যাঁরা নিজেরা ম্যাজিক রিয়ালিজমের লেখক, তাঁরা নিজেরাই কি তা নিয়ে মাথা ঘামান? তাঁরা আসলে মাথা ঘামান নিজেদের নিয়ে। সেটাই ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে বেরিয়ে আসে, অথবা সমালোচকদের দেওয়া অন্য কোনো নাম নিয়ে বেরিয়ে আসে। অস্ট্রিয়ান যে নারী সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেলেন, তাঁর মধ্যে অস্ট্রিয়া ছাড়া, নিজের দেশ ছাড়া আর কিছু নেই। এঁরা যে বড় লেখক হয়ে ওঠেন তা এই জন্যই। নিজেকে নিজের দেশ এবং মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন না করে ফেলার জন্যই। আফ্রিকার লেখা পড়লেও সেটা বোঝা যায়। হয়তো তাঁরা লিখছেন অন্য ভাষায়—কেউ ইংরেজিতে, কেউ ফরাসিতে—কিন্তু লিখছেন একেবারে ঠিক নিজেদের কথাই। আফ্রিকার চিনুয়া আচেবের গল্পের দিকে তাকাও, কী দেখতে পাও? তাঁর একটি গল্পে এমন আছে: আফ্রিকার জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য ছিল, কেউ একা একা নিজের জন্য কিছু না করা। কেউ একার জন্য বাঁচে না সেখানে। গ্রামের লোকেরা সবাই মিলে খরচ দিয়ে একটি ছেলেকে ইংল্যান্ডের শহরে পাঠাল ব্যারিস্টার হয়ে আসার জন্য। কিন্তু ব্যারিস্টার হয়ে ফেরত আসার পরে সে আর গ্রামে থাকতে পারে না। কারণ গ্রামে তো আর প্র্যাকটিস হয় না। তখন সে চলে গেল শহরে। ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার সময় তার বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়নি নিজের জীবনধারার সঙ্গে। বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলো এবার নিজদেশে ফিরে এসে। যেই তথাকথিত উন্নতি এল, সঙ্গে সঙ্গে এল বিচ্ছিন্নতা। এটি এমনভাবে ধরতে পারেন বলেই চিনুয়া আচেবে বড় লেখক, মৌলিক লেখক।

জাকির: এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের লেখকদের কথা, সাহিত্যের কথা যদি বলেন...

হাসান: কত রকমের ফেনিল উচ্ছ্বাস এবং আলোড়ন যে আসে আমাদের দেশে! একটু অসতর্ক হলেই বা ভিত্তিতে দুর্বলতা থাকলেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নিজস্ব চিন্তাধারাকে। কত রকমের হুলুস্থুলই না আমদানি হয় সাহিত্যের জগতে। শিল্পের জন্য শিল্প, নন্দনতাত্ত্বিক শিল্প, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রচনা, আধুনিক মানুষের যুগযন্ত্রণা, উত্তর–আধুনিকতা, জাদুবাস্তবতা, নাগরিক শিল্প—কত নামে বিভ্রান্তি আসে। সেই সব স্রোতে গা না ভাসালে অভিধা জোটে ‘যথেষ্ট আধুনিক লেখক নন’ বলে। নিজের লেখকজীবনের শুরু থেকেই এ রকম মন্তব্য শুনতে হয়েছে আমাকে। শওকত আলীকেও। কিন্তু আমাকে কেউ ‘যথেষ্ট আধুনিক’ না বললে কিংবা ‘আঞ্চলিক’ বললে আমি মোটেও ঘাবড়ে যাই না। কারণ সেভাবে দেখতে গেলে সব লেখাই আঞ্চলিক। লাতিন আমেরিকার সব লেখাই ওই অর্থে আঞ্চলিক। পৃথিবীর সব বড় লেখকের মধ্য থেকে সাধারণ যে প্রবণতাটি আবিষ্কার করা যায়, সেটাও এই কথার সপক্ষেই দাঁড়ায়। নিজের সেই পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, প্রামিদ্যা অনন্ত তোয়ের, হোসে সারামাগা, সালমান রুশদী, অনিতা দেশাই, অরুন্ধতী রায়, লাতিনের সব বড় লেখক—তাঁদের একটাই ধ্রুব আছে—সময়, সমাজ, মানুষ। আমাদের ভাষার যাঁরা বড় লেখক—সে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অমিয়ভূষণ মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পর্যন্ত—তাঁদের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।

জাকির: বিশ্বসাহিত্য আমাদের পাঠ করা কতখানি দরকার? অন্তত কোথায় কেমন কাজ হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে অবহিত থাকাটা তো দরকারই।

হাসান: অবশ্যই। তুমি যদি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাই ধরো, তাহলে দেখবে সমকালীন বিশ্বসাহিত্য, বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে তিনি যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। তার পরের অনেকের অবশ্য সেই রকম পরিচিতি ছিল না। তিরিশ দশকের কবি-সাহিত্যিকদের বিশ্বসাহিত্যের পাঠ ভালো ছিল। তবে তাঁরা প্রভাবিতই বেশি হয়েছেন, আত্তীকরণের ক্ষমতাটি কমই ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠের ঘাটতি ছিল হয়তো। কিন্তু তিনি এতই প্রতিভাবান ছিলেন যে বরং তাঁর সাহিত্যকর্মই বিশ্বসাহিত্যের অন্য ভাষার লেখকদের অবশ্য–পাঠ্য হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। অন্য ভাষার লেখকদের দুর্ভাগ্য যে সেই সুযোগ তাঁরা পাননি মানিক অন্য ভাষায় অনূদিত না হওয়ার কারণে।

জাকির: আমাদের তরুণেরা অবশ্য বিদেশি সাহিত্য পাঠ করছে, অনুবাদ করছে। এটা একটা ভালো দিক।

হাসান: ভালো দিক। কিন্তু পাশাপাশি নিজেদের সাহিত্য কতখানি পাঠ করছে, সেটা তারাই জানে। আমাদের ভাষায় সাহিত্যে কতখানি কাজ হয়েছে, সেগুলো তারা যে জানার মতো জানে তা তাদের লেখাপত্র পড়ে বা কথা বলে মনে হয় না। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ পড়েছে কি না, মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি পড়েছে কি না, সতীনাথ ভাদুড়ী পড়েছে কি না, জগদীশ গুপ্ত-সোমেন চন্দ পড়েছে কি না, বোঝা যায় না। ভাবো শিবরাম চক্রবর্তীর কথা। লোকে তাঁকে হাসির গল্পের লেখক হিসেবেই চেনে। কিন্তু তাঁর যে অসাধারণ কয়েকটি গল্প আছে, সেগুলোর কথা কাউকে বলতে শুনি না। বাংলা সাহিত্যে ভালো ভালো যেসব কাজ হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় না থাকলে অর্ধশিক্ষিত লেখক হয়ে থাকতে হবে। অর্ধশিক্ষিত মানে বুঝেছ তো?

জাকির: মানে বোধ হয় অলেখকই। অথবা কাগজ-কালি অপচয় করা লেখক। তবে একটা সময়কালে অনেকজন লিখবে। কেউ কেউ কিছুদিন লেখা মকশো করে চলে যাবে, কেউ কেউ লেখালেখি চালিয়ে যাবে। তারা সবাই যে ভালো লিখবে তা হয় না। তাদের তো সমকালীন লেখক বলাই যায়?

হাসান: সমকালীন এবং সমকালীন।

জাকির: ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ভার্সনের প্লেয়ারের মতো। এদের মধ্যে অল্পজনই টেস্ট ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা রাখে। তবে সময়ই সেটা বলে দেবে।

হাসান: তা বটে।

জাকির: আপনার কি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে?

হাসান: না।

হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক

জাকির: ফেসবুক কিন্তু এখন খুব শক্তিশালী গণমাধ্যম। বলা চলে সবচেয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম। এটি সবাইকে নিজের কথা লেখার সুযোগ করে দিয়েছে। মতামত দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ফেসবুকে ঢুকলে দেখতে পাবেন, এখনকার নতুন লেখক-কবিদের সবকিছু নাকচ করে দেওয়ার প্রবণতা ও ক্ষমতা অপরিসীম। তারা রবীন্দ্র-নজরুল-রুমী-শেকস্​পিয়ার—সবাইকে নাকচ করে দিতে পারে। আপনাকেও পারে।

হাসান: কেউ যদি তার পাঠ্যতালিকা থেকে আমাকে নাকচ বা বাতিল করে দেয়, আমার তাতে কিছু বলার নেই। কোনো লেখকেরই বলার কিছু নেই। তবে যেসব সাহিত্যকর্ম এবং স্রষ্টা এক শ বছর, দুই শ বছর, পাঁচ শ বছর সময়কে অতিক্রম করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পেরেছে, তাঁদের নাকচ করার মানে হচ্ছে হয় নাকচকারীর মধ্যে সাহিত্য সম্পর্কে এমন কোনো মৌলিক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, যা সত্যি সত্যিই নন্দনতত্ত্বের জগতে বিপ্লব ঘটাতে পারে; অথবা এটি তার মৌলিক মূর্খতা।

জাকির: সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক সব সময়ই কম-বেশি থাকে। এখন খুব বেশি হচ্ছে। এ–সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন?

হাসান: সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে ভাবাভাবির বেশি কিছু নেই। সত্যিকারের লেখক যিনি, তিনি কখনোই পুরস্কারের কথা মাথায় রেখে লেখেন না। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান থাকে নিজের লেখাকে কীভাবে আরও উন্নত, আরও সমৃদ্ধ করা যায়। এই সমৃদ্ধ করার কোনো শেষবিন্দু নেই। কাজেই লেখকের সাধনারও কোনো শেষ নেই। পুরস্কারকে বলা যেতে পারে বাই-প্রডাক্ট। পুরস্কার পাওয়া বা না–পাওয়া প্রকৃত লেখককে ভাবিত করে না। পেলে মনে করতে হবে তিনি যে ধারায় কাজ করছেন, সে ধারাটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলো মাত্র। অনেক বড় লেখক কোনো পুরস্কার না পেয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁরা কেউ পুরস্কার না–পাওয়ায় নিজেদের লেখা বন্ধ করেননি বা তাঁদের রচনার সাহিত্যমূল্য কমে যায়নি।

হাসান আজিজুল হকের যত অজানা
ডাকনাম
হাসান আজিজুল হকের ছেলেবেলায় বাড়ির লোকজন ও পাড়া–প্রতিবেশীরা তাঁকে ডাকতেন ‘কালো’ বলে। গাত্রবর্ণের কারণে এমন নামকরণ। এ ছাড়া বন্ধুবান্ধব আর স্কুলের শিক্ষকেরা ‘আজুল’ নামেও ডেকেছেন।
জন্মভিটা ছেড়ে
ঠিক দেশভাগের পরপরই নিজের জন্মভিটা, অধুনা পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার যবগ্রাম ছেড়ে তখনকার পূর্ববঙ্গে আসেননি হাসান আজিজুল হক। আদতে ১৯৫৪ সালে যবগ্রামের মহারানি কাশীশ্বরী উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে তিনি খুলনায় বড় বোন জাহানারা নওশীনের শ্বশুরবাড়িতে থেকে কলেজে পড়ার জন্য বর্ধমান ত্যাগ করেন। পরে ১৯৫৬ সালে খুলনা ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
বিয়ের পর স্ত্রী শামসুন্নাহার বেগম মঞ্জুর সঙ্গে হাসান আজিজুল হক। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
বিয়ের পর স্ত্রী শামসুন্নাহার বেগম মঞ্জুর সঙ্গে হাসান আজিজুল হক। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
পরিবার
রাজশাহী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর বিয়ে করেন নিজের ফুপাতো বোন শামসুন্নাহার বেগম মঞ্জুকে। তিনি ২০১৩ সালে প্রয়াত হন। তাঁদের ঘরে তিন মেয়ে ও এক ছেলে।
ছদ্মনামে লেখা
লেখকজীবনের বেশির ভাগ সময় স্বনামে লেখালেখি করলেও গোড়ার দিকে ঘটনাক্রমে ছদ্মনামে কয়েকটি বই-আলোচনা লিখতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৬০ সালে রাজশাহী থেকে ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র পূর্বমেঘ প্রকাশ পেতে শুরু করলে তাতে নিয়মিতভাবে গল্প লিখতে শুরু করেন তিনি। পরে পত্রিকা-সংশ্লিষ্টদের অনুরোধে কয়েকটি বই-আলোচনাও তাঁকে লিখতে হয়। কিন্তু একই সংখ্যায় একই লেখকের গল্প ও বই-আলোচনা একত্রে ছাপাটা বেখাপ্পা দেখায়। তাই তিনি ফজলে রাব্বী ছদ্মনাম ধারণ করে বই-আলোচনা লেখা শুরু করেন। উল্লেখ্য, ওই কলামে তিনি সৈয়দ শামসুল হকের দেয়ালের দেশ ও রশীদ করিমের উত্তম পুরুষ উপন্যাস দুটি নিয়েও আলোচনা করেছিলেন।

সূত্র: হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের আলাপচারিতা এবং তাঁর অখণ্ড আত্মস্মৃতি স্মৃতিকহন