ও প্রাণ ও বর্ণমালা

ছবি: মাসুমা পিয়া
ছবি: মাসুমা পিয়া

১.

কখনো কৃষ্ণচূড়া
কখনো ফাগুন
মনের কৃষ্ণচূড়ার রং
ও মন তুই
কান পেতে শোন

২.
আসেনি সবুজ পাতা
: এসেছে

আসেনি হৃদয় শাখায়
ভোরের প্রথম রেখা
: এসেছে

আসব বলেই
এত দিন আসিনি
থরোথরো বুকে
মধ্যাহ্নের
প্রখর দুপুরে
শান্ত জলের স্রোতে
ভাসি-ডুবি
কৃষ্ণচূড়া
রাগে, অনুরাগে...

৩.
কৃষ্ণচূড়ার লাল
রোদের সুবাসে—
ভাসে দিন
ভাসে রাত
কাজে-অবসরে
আকাশও হাসে,
সবুজ পার্কে
শূন্য বেঞ্চে
বসে আছে
হারানো শৈশব
পিতার হাত ধরে
দীর্ঘ সবুজ পথ পাড়ি দিয়ে
ফিরে আসে প্রাণের দুপুর
জোছনার হাহাকার
জলের আয়নায়
অপেক্ষায় বসে থাকা
জননীর চোখ হয়ে ভাসে...

কৃষ্ণচূড়ার
চোখে চোখ রেখে
অশ্রুজলে লিখি
ফা ল্গু নে র
দীর্ঘশ্বাস...

৪.
আমার তৃষ্ণার চোখ
শুষে নেয়
হৃদয়ের রং—

শূন্য হৃদয়ের
হা হা কা র
প্রবল রোদের ভাষায় প্রকাশিত
রক্তলাল
অক্ষরে অক্ষরে
কৃষ্ণচূড়ার বর্ণে
লিখি শহীদের নাম

ও প্রাণ
ও বর্ণমালা
আগুনের ভাষায়
লেখো ইতিহাস
লেখো জন্মদাত্রীর
রক্তমাখা মুখ

৮ই ফাল্গুন...

৫.
যখন আঁধার নামে
একাকী বাড়ি ফেরে
ক্লান্ত হাওয়া...
বাড়ি?

ফুলে ফুলে কম্পন ওঠে
পাতায় পাতায় বিলি কাটে
হাওয়ার আঙুল
যে আমি রক্তিম
দিনের আলোয়
জমাট রক্তের মতো
সেই আমি শোকে-দুঃখে পুড়ি
রাতের আঁধারে
দিনের উচ্ছ্বাসমাখা
কৃষ্ণচূড়ার কান্না
শুনেছ কি কোনো দিন...!

ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
নেই তোর কোনো বাড়ি
আজ তুই ঘরছাড়া!

৬.
একবার তোমাকে দেখেছি
গনগনে চিতার আগুনে
দেখেছি তোমাকে
নিষ্ঠুর ইটের ভাটায়
দেখেছি রণক্ষেত্রে
প্রবল গুলিবর্ষণে
আবার তুমিই বিস্ফোরণে
জ্বলে উঠেছিলে
উড্ডীন এরোপ্লেনে...
তুমি গঙ্গার ধারে না
আকাশচুম্বী ম্যানহাটানে
তাতে কিছুই যায় আসে না
বাউলের একতারায়...
লালন ও লেননে
পার্থক্য নেই কোনো
বসন্তের রং
একই সুরে বাজে
যুগে যুগে

মানুষের রং
এখনো আলাদা!

৭.
জন্মের কাছে আমার যে ঋণ
মৃত্যুর পরও
সেই ঋণ বহমান...
যে পথিক পরিত্যক্ত ভেবে
আমার বুকের ওপর পা বাড়াল
তার প্রতিও আমার
কোনো খেদ নেই...
জীবনের আহ্বান
প্রেমে না বিষয়ে
সে হিসাব বুঝিনি আমি,
মৃত্যুর আলিঙ্গনে
শান্ত সবুজ ঘাসে
শুয়ে শুয়ে দেখি
দলবদ্ধ পিঁপড়ের
সং গ্রা ম

এত পথ হেঁটেও মানুষ
একাই রয়ে গেল!
যূথবদ্ধ কৃষ্ণচূড়া
জীবনে-মরণে তবু
তোমাদের জয়গান
গেয়ে যাবে...

৮.
যে বাতাস চলে যায়
আগের মতো করে
সে আর কখনো ফেরে না

একই ডালে দোল খাই
গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল
কে কার অন্তর
কতটুকু পড়ি

জীবন যদি মহাকাব্য
এক ফোঁটা অশ্রুর
ঝরে পড়ার গভীরতা
তবে মহাসিন্ধুর!

কত ঝড় এসে
আমাকে
চুরমার করে দিয়ে গেল
তবু আমি ঝরিনি

আজ আমি স্বেচ্ছায়
ঝরে পড়ি

ভি
মা
নে
আমার পড়ার ছন্দ
শূন্যতার
সফেদ পাথরে
সুরে অক্ষরে
পোড়ে!

৯.
কেন যে দিনভর
ভাবি আনমনে
কে গো তুমি সুর তোলো
কোকিল-আড়ালে!

আমার আড়াল নেই
রক্তিম আভায় তুলি মুখ
তৃষ্ণার্ত পাখির ছানা
যেভাবে তুলে ধরে ঠোঁট

সবুজ উচ্ছ্বাসে
আড়ি পেতে শুনি
বসন্ত বাতাসের
গুন গুন

সুরে সুরে
আনে সুখ
নিদ্রা-জাগরণে
জীবনের জয়গান...

১০.
দুরু দুরু বুকে
দুলে ওঠে দারুণ দুপুর
কৃষ্ণচূড়ার দ্বীপে
টিপ টিপ বৃষ্টির ফোঁটার মতো
ঝরে পড়ে রং
মনে বনে ফাল্গুনে
থইথই সবুজ পাতার নদী
বহতা ব্যাকুল...

আমি দাঁড় বাই
এ ক লা
আকাশেরও নেই কোনো সাথি
মেঘ আসে মেঘ যায়
নেই কেউ কারও অপেক্ষায়
দংশনে দংশনে
নীলও নীরব নীলিমায়
নিবিড়তা খোঁজে
কে জানে কোন শুভক্ষণে
নিজের সঙ্গে হবে দেখা

বাতাস বাকিটা জানে!

১১.
আমি সুরের পথে
প্রাণ খুলেছি
আমার চিতায় হাঁটও!

তোমার পায়ের পাতায়
আঙুল ছুঁয়ে
ফাগুন দিন আঁকি!


১২.
যে আছে প্রাণে
তার গান
অবিরল বসন্তস্রোতে
মৃদু সমীরণে
দোল খায়

সুর অক্ষরের ডিঙি
মহাকাল পানে ছোটে

এত গান চারিধারে
বসন্তের গুন গুন
গাঙচিল হয়ে ওড়ে
জলে-স্থলে হৃদয়-নীলে

আমার বসন্ত তুমি
তোমার কৃষ্ণচূড়ায় পুড়ি
হাসিমুখে!

১৩.
শুনেছি মনের চোখে
দেখেছি সুরের মায়ায়
তুমি ফাল্গুন
আমার প্রথম রোদ
প্রসন্ন আলোর মায়াবী অক্ষর
লিখে রাখে নিজের জন্মের তিথি
ফিরেছে ফাল্গুন
ফিরেছে নির্জন দ্বীপে
হৃদয় রঙিন দিন

আমি কোন পথে
গন্তব্যে পৌঁছাব?

হলুদ হলুদ ঘাসে
হামাগুড়ি দিয়ে
পায়ে-পায়ে দুলে ওঠে প্রাণ

ও বসন্ত বাতাস
আজ বারো মাস
তোর স্বপ্নের একটি জীবন
গুন গুন সুরে
বলি অক্ষর বলি
আমি ভালোবাসি!

১৪.
পাখি হয়ে ফিরলাম
কৃষ্ণচূড়ার খাঁচায়
লাল-সবুজ পতাকায়
চেনা পথে
শীতের পাখিরা ফেরে
আমি ফিরি
হৃদয়ের পথ ধরে
গনগনে আগুনের আঁচে...
আমার বসন্তদিন
উদ্দাম-উত্তাল কার্নিভ্যাল
‘একুশ ভুবনময়’
ঢাকা কিংবা রিও ডি জেনিরো
তোমার সঙ্গে পা মেলাবে
আমার প্রভাতফেরি...


১৫.
তোমাকে শোনাব
যে ভাষায়
সেই কবে এক রক্তিম সকালে
তার নবজন্ম হলো
মায়ের চরণ ছুঁয়ে
আকাশের দিকে উড়ে গেল
কয়েকটি বর্ণমালা
সালাম, জব্বার, রফিক
বরকত, শফিউর
বায়ান্নর যিশু!

কৃষ্ণচূড়ার চোখ
আজও খোঁজে তার
হারানো সন্তান
ভাষায় ভালোবাসায়...