এই পথে আলো জ্বেলে

>এই বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে আনিসুল হকের উপন্যাস এই পথে আলো জ্বেলে। এখানে লেখা হয়েছে উত্তাল বাংলাদেশের ইতিহাস। সেই উপন্যাসের শেষ অধ্যায়।

সেদিন রাত সাড়ে আটটা। রেডিও পাকিস্তানে তখন গজল পরিবেশিত হওয়ার কথা। এই সময় সাধারণত উর্দু গজল বাজানো হয়ে থাকে। হঠাৎই ঘোষণা শোনা গেল, এখন শুনবেন দুটো রবীন্দ্রসংগীত।

রেডিও পাকিস্তানে বেজে উঠল:

‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।

একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো।।’

এরপর বাজল:

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসার দোতলায় ১২ বছরের রেহানা একলা একলা বসে রেডিওর নব ঘোরাচ্ছিল। সে হঠাৎই রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পেয়ে মাকে ডাকতে গেল। তাঁরা তিনজন—হাসিনা, রেহানা, কামাল—তিনজনই ছায়ানটের ছাত্র। তাঁরা অন্যান্য গান ও যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতও শেখেন। মোনায়েম খান যে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো বন্ধ করে দিয়েছে, এটা রেহানা জানে। ছায়ানটেও এই নিয়ে তাঁদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা কথা বলেছেন। আর তাঁদের আব্বা যে রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতা খুবই পছন্দ করেন, এটাও তার অজানা নয়। বিশেষ করে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা আব্বার খুবই প্রিয়। রেহানা তিন সিঁড়ি করে লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে মায়ের হাত ধরে ওপরে নিয়ে এল।

রেনু বললেন, ‘কী!’

রেহানা বলল, ‘শোনো, আজকে আব্বা এসেছে, আর রেডিওতে কী গান বাজছে, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

রেনু রেডিওর পাশে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে হলুদ, তেল লেগে আছে। নিচে চুলায় রান্না উঠেছে। কত মানুষ না জানি আজ রাতে খাবে! সময় কই তাঁর? তিনি তবু গান শুনতে লাগলেন। শুনতে শুনতে তাঁর মনে হলো, দুই–তিন রাত আগেও মানুষটা ছিল মৃত্যুর মুখে। আর তাঁকে জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চিত দোলাচলে রেখেও তিনি, তাঁর দুই মেয়ে রেহানা আর হাসিনা বারবার করে বলছিলেন, ‘প্যারোলে মুক্তি নিয়া আসবা না। আসলে বাড়িতে ঢুকতে দিব না।’

রেডিওতে গান হচ্ছে:

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি।।

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

রেনু চোখের জল মুছতে পারছেন না। হাতে তেল-হলুদ-মরিচ বাটা লেগে আছে। চোখ মুছলে চোখ জ্বালা করবে। বরং জল ঝরুক। অশ্রুর প্লাবন মুছে দিক বুকের ভেতর জমে থাকা যত কষ্ট!