বইমেলা বই ম্যালা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

প্রতিবারই বইমেলা শুরু হওয়ার আগে একটা কথা খুব শোনা যায়, ‘এবার নতুন আঙ্গিকে হচ্ছে একুশে বইমেলা’। নতুনত্বটা যে কী তা অবশ্য আমার চোখে পড়ে না। এখনো সেই আগের মতোই বিকট শব্দে মাইকে ঘোষণা বাজতেই থাকে অবিরাম। কোন কোন বই এসেছে, সেটা দেখতেই তো মেলায় আসে মানুষ। একটানা ঘোষণা দেওয়ার কী আছে তা আমার মাথায় ঢোকে না (ঢুকবে কী করে? মাথার ভেতর ঢুকে বসে আছে ‘মেলায় নিয়োজিত বিদ্যুৎকর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি…’)। বইমেলায় এখনো আগের মতোই বহমান ধুলার মেলা—ম্যালা ধুলা। কোনো একটা বইয়ের প্রচ্ছদে হাত রাখলেই ধুলা ফ্রি। ‘ধুলোতে সমস্যা কী?’ কবি বলে গেছেন, ‘শত সন্তান সাধ করে এর ধূলি মাখি সারা গায়…।’ ‘মেলায় ধুলা থাকবেই। এটাই মেলার ঐতিহ্য।’—এই কথাও হয়তো বলবেন কেউ কেউ। নিশ্চয়ই ধুলাবালুর পক্ষেও অনেক লোক আছে। নইলে এত বছর চলে গেল, বাংলা একাডেমি থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে এল বইমেলা, কিন্তু মেলা প্রাঙ্গণটা ধুলামুক্ত করতে পারল না কর্তৃপক্ষ। ধুলার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মুখে মুখোশ পরে ঘুরতে দেখি অনেককে। এতে অবশ্য একটা সুবিধাও আছে। ফেসবুকের কল্যাণে আজকাল সবারই প্রচুর ফলোয়ার—ভক্ত। এমনকি যিনি কিছুই করেন না, ভক্ত পাওয়া যাবে তাঁরও। ‘ভাই, আপনি কেমনে পারেন? এই যে আপনি কিছু করেন না, এটা আমার খুব ভাল্লাগে, ভাই। আমি কিন্তু আপনার ফ্যান।’ তা ছাড়া ফ্রেন্ডলিস্টের সবারই তো মোটামুটি বই বের হয়। কখন কোন লেখকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার নিশ্চয়তা কী? মেলার নতুন লেখক ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। বই না কিনে মুক্তি পাওয়া কঠিন। তো এইসব ভক্ত অনুরাগীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে, পরিচিত লেখকদের বই কিনতে কিনতেই মেলার সময় ফুরিয়ে যায়। মুখে মুখোশ থাকলে আপনি বিরতিহীনভাবে আপনার সুবিধামতো মেলায় ঘুরতে পারবেন। কারও চোখে যদি পড়েও যান, বলবেন, ‘আর বলবেন না, এত ধুলা!’ আমি নিশ্চিত বইমেলায় মুখোশের একটা স্টল থাকলে তারাই বেস্ট সেলার খেতাব জিতে নিত। লাইন ধরে মুখোশ কিনত মানুষ।

বাঙালিদের কাছে লাইনের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। বইমেলাতেও লাইন করেই ঢোকে সবাই। ভেতরে ঢোকার আগে সবাইকে চেক করেন পুলিশ সদস্যরা। সেদিন দেখি ঢোকার মুখে বেশ জটলা। পুলিশের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন এক যুবক। পুলিশের এক কথা, সিগারেট লাইটার নিয়ে ভেতরে ঢোকা যাবে না। যুবকও হাত নেড়ে কী কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কাছে যেতেই ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেল। যুবকের ব্যাগে সিগারেট লাইটার আছে, ফলে পুলিশ তাঁকে ঢুকতে দেবে না। পুলিশের যুক্তি একেবারে সঠিক। কিন্তু একটু পর যুবক যে যুক্তি দিল, তাতে বিস্মিত হলো সবাই। ‘আরে ভাই, কতবার বলব, এটা একটা বইয়ের নাম। এই যে দেখেন বই।’ পুলিশ সদস্য এবং আমি দুজনই বড় বড় চোখে দেখলাম সত্যি সত্যি এই নামে একটা বই আছে। ইংরেজি বই। জ্যাক পেনডারভিসের লেখা। ব্লুমসবারি অ্যাকাডেমিক থেকে বেরিয়েছে বইটা। পুলিশ যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সিগারেট লাইটার আছে?’ যুবক বলেছিলেন, ‘ইয়ে…মানে…না…আসলে হয়েছে কি…’ ব্যস, আর কী লাগে! বাকিটা পুলিশ সদস্য বুঝে নিয়েছেন ( আমতা আমতা করলেই পুলিশ সদস্যরা বোধ হয় ভাবেন এর মধ্যে ঘাপলা আছে।) তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্য যুবককে যেতে দিয়ে বললেন, ‘আগে বললেই হইতো!’

আসলেই কিছু কিছু ব্যাপার আগেই বলে নেওয়া দরকার। মেলায় ঢুকেই দেখি একপাশে বিশাল লাইন। ‘অমুক লেখকের বই মানুষ লাইন ধরে কিনছে, লাইন ধরে অটোগ্রাফ-ফটোগ্রাফ নিচ্ছে…’—এসব মেলায় যাওয়ার আগেই শুনেছি। লাইন দেখে ভাবলাম নিশ্চয়ই কোনো লাইনজয়ী জনপ্রিয় লেখকের জন্য জড়ো হয়েছে মানুষ। অতি উৎসাহে আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। পরে টের পেলাম, ওটা বিনা মূল্যে পানি খাওয়ার লাইন। পুলিশ সদস্যের মতো আমিও বললাম, ‘আগে বললেই হইতো।’

কয়েক বছর হলো বইমেলায় একশ্রেণির ক্রেতার আবির্ভাব ঘটেছে। এই ক্রেতারা মূলত বই না, অটোগ্রাফ কেনেন। আগেই ফেসবুক বা ফোনে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, আজকে মেলায় আসছেন তো?’

‘আজ তো আসতে পারছি না, একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে।’

‘ওহ, ভাবলাম আপনার বইটা কিনব। আপনি যেহেতু নাই, থাক তাহলে। আরেক দিন…’

ফোনের ওপাশে লেখকের তখন চুল ছেঁড়ার দশা, ‘আপনি বইটা কেনেন ভাই, দরকার হলে আমি বাসায় গিয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে আসব’।—এই কথা তো আর বলা যায় না! আহারে, একটা বই বিক্রি হাতছাড়া হয়ে গেল! এমনিতেই বই বিক্রি হয় না! ফলে বুদ্ধিমান লেখকেরা প্রতিদিন বইমেলায় যান। যাওয়ার আগে ফেসবুকে পোস্ট দিতে ভোলেন না, ‘বন্ধুরা, আজ থাকছি অমুক স্টলে। চলে আসুন।’

লেখকেরা স্টলে থাকলে বিক্রেতাদেরও লাভ। ‘এই বইটা নিতে পারেন, লেখক পাশেই আছেন’ বলে ক্রেতার হাতে বই ধরিয়ে দেন বিক্রেতারা। ক্রেতা ভাবেন, ‘একটা বই তো না নিলে খারাপ দেখায়। কোনটা নেব? আচ্ছা, এটার লেখক যখন আছে, তাইলে এইটাই নেই। বই-ই তো। একটা কিনলেই হয়। ‘বই কিনে সেলফি তোলেন লেখকের সঙ্গে।’ একজন সেলফি তুললেই লোক জমে যায় চারপাশে। আরও কয়েকজন এসে সেলফি তোলেন। তারপর পাশের জনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘উনি যেন কে?’ এভাবে সেদিন আমার বন্ধুর বাবার সঙ্গেও সেলফি তুলেছে কয়েকজন (উনি লেখক নন, তবে কাঁচাপাকা চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমার সঙ্গে সেদিন আবার পাঞ্জাবিও পরেছিলেন)।

ক্রেতা যদি শিশুকিশোর হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সঙ্গে থাকা মা-বাবা জোর করে ঠেলে দেবেন, ‘ওই যে দেখো, লেখক। যাও যাও, অটোগ্রাফ নাও।’

‘থাক না মা। আমি তো চিনিই না তাঁকে।’

‘চিনতে হবে না। দেখছ না সবাই নিচ্ছে? যাও বলছি। নইলে পিছিয়ে পড়বে!’

শিশুকিশোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও অটোগ্রাফ নিতে যায়। পেছন থেকে মা বলেন, ‘আমার মেয়ে আপনার খুব ভক্ত। সবগুলো বই ওর পড়া।’ লেখক শুকনো হাসি হেসে মনে মনে বলেন, ‘আমার তো এই একটাই বই।’

তা–ও ভালো যে এভাবেও বই বিক্রি হচ্ছে। তবে প্রকাশকদের কাছে এই বই বিক্রি অনেকটা জীবাণুর মতো—বিক্রিগুলো তাঁরা খালি চোখে দেখতে পারেন না। একটা হতাশ শূন্য দৃষ্টি নিয়ে স্টলে বসে থাকেন তাঁরা। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘নারে ভাই, বেচাবিক্রি নাই। আজকাল কেউ বই কেনে না।’ অথচ একের পর এক সংস্করণ আসছেই। মানুষের হাতে হাতে বইয়ের প্যাকেট। এই বইগুলো তাহলে কিনছে কোত্থেকে? কে জানে, হয়তো মেলার ভেতরেই আরেকটা অদৃশ্য মেলা আছে। আশা করি, সেই মেলাটায় ধুলাবালু নাই আর একঘেয়ে ঘোষণা নেই।