প্রমিত বাংলায় পূর্ব বাংলা বা পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার উচ্চারণবিধি গুরুত্ব পায়নি

মোহাম্মদ আজম
মোহাম্মদ আজম

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে আমরা কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দুইজন শিক্ষকের কাছে। তারা হলেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ও সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। দুজনকে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাঁরা নিজেদের ভাবনাগুলো প্রকাশ করেছেন। এখানে পড়ুন মোহাম্মদ আজমের সাক্ষাৎকার।

প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলন বাঙালি সংস্কৃতির দিকে নজর ফেরাল। আপনি কি মনে করেন, এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে? এসে থাকলে সেটা কী? না এসে থাকলে কেন আসেনি?
মোহাম্মদ আজম: এ প্রশ্নের প্রথম বাক্যটি সিদ্ধান্তজ্ঞাপক। কথাটা এমনভাবে বলা হয়েছে যেন এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের অধিকাংশ বিবরণীতে কথাটা এভাবেই বলা হয়। সেদিক থেকে ঠিকই আছে। কিন্তু একটুখানি বিশ্লেষণাত্মক মন নিয়ে বাক্যটি পড়লেই ধরা পড়বে, আসলে প্রস্তাবটি গভীরভাবে সমস্যাগ্রস্ত। কারণ, এখানে দাবি করা হয়েছে, ভাষা আন্দোলনকারীরা কিংবা যে জনগোষ্ঠীর অংশ হয়ে তাঁরা কাজ করেছেন, সে জনগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতির আওতায় ছিল না। আরও দাবি করা হয়েছে, ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ একটি বহিস্থ উপাদান, যার দিকে ভাষা আন্দোলনের পর একটা জনগোষ্ঠীর নজর পড়েছে।
এ বিবৃতির সমস্যা এই যে এখানে সংস্কৃতিকে যাপিত জীবনের বাইরের একটি উপাদান হিসেবে দেখা হয়েছে। আরও খুলে বললে বলতে হয়, কলকাতায় ইংরেজিশি‌ক্ষিত নাগরিক হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির যে কাঠামো এবং তার আগের প্রায় দেড় শ বছরের প্রযত্নে গড়ে উঠেছিল, তাকেই এখানে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে দাবি করা হয়েছে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ সে সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ল। মুশকিল হলো, সংস্কৃতি অধ্যয়নশাস্ত্র, নৃবিজ্ঞান বা সমাজবিদ্যার—জ্ঞানের যে শাখাগুলো সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি বা পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে কাজ করে সেগুলোর বরাতে সংস্কৃতির এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ কাজ নয়। মানুষের জীবনযাপন এখানে, আর তার ‘ভালো’ সংস্কৃতি আছে ওখানে—আমার মতো দুনিয়াবি লোকের পক্ষে এতটা অধিবিদ্যা হজম করা মুশকিল।
আমার ধারণা, বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা আন্দোলনের আগে যা করত তাও বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি। সেদিক থেকে জীবনানন্দের কবিতা, ফররুখ আহমদের কবিতা এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র সাহিত্যকর্ম একই বাঙালি সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশমাত্র। একই কারণে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে এবং রাজনৈতিক তৎপরতার দিক থেকে আগের কয়েক দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনকে মিলিয়ে পড়া দরকার। গুলিয়ে না ফেলাটাই যথেষ্ট।
ভাষা আন্দোলনকে আমি পড়তে চাই কমপক্ষে বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ের মাপে; অর্থাৎ সেকালের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে। বাংলাদেশে এই বইটি প্রশংসিত হয়েছে, কিন্তু খুব একটা অনুসৃত হয়েছে বলে মনে হয় না। ভাষা আন্দোলনের দুটি বয়ান আমাদের জাতীয়তাবাদী আখ্যানের মূলধারায় প্রভাবশালী হয়েছে। একটি হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সের উত্থান ও পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়; অন্যটি হলো, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারা পরিহার করে সমন্বয়বাদী হয়ে ওঠা। খালি চোখেই দেখা যায়, এই দুই দাবি ঠিকই আছে। কাজেই আপনার প্রশ্নের জবাবে বলা যাবে, এই ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সুফলদায়ক হয়েছে।
কিন্তু ওই যে বললাম, বদরুদ্দীন উমরের বইটির দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা অনুসৃত হয়নি, সেদিকটাও এখন বিশেষভাবে উচ্চারিত হওয়া দরকার। কোনো পুরোনো ঘটনা যখন জাতীয়তাবাদী আখ্যানে রূপ নেয় তখন সাধারণত দুটি ঘটনা ঘটে। এক. সমকালীন প্রেক্ষাপটের নানা বৈচিত্র্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি একটু সরল ও সাধারণ [কমন] হয়ে মসৃণ বিবরণী তৈরি হয়। দুই. ওই ঘটনার যে বাস্তব কার্যকর দিকগুলো ছিল, সেগুলো কার্যকরতা হারিয়ে মিথ বা কিংবদন্তির আকার নেয়। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ দুই ব্যাপারই ঘটেছে। আমি দুই দিক থেকে এখানে দুটি উদাহরণ দেব।
আরেকবার ফেরা যাক আপনার প্রশ্নের প্রথম বাক্যের দিকে। আমার আগের বক্তব্য অসতর্কভাবে পড়লে মনে হতে পারে, এরকম কিছুই ঘটেনি। আসলে তা নয়। বরং কথাটাকে আমি এভাবে বলতে চাই, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার মানুষ নিজেদের পরিচয়চিহ্নের ‌ক্ষেত্রে ভাষাকেন্দ্রিক পরিচয়কে এ সময় মুখ্য করে তুলেছিল। কলকাতার সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক বাঙালিয়ানার বিপরীতে এখানে কার্যকরভাবে বিকশিত হয়েছিল রাজনৈতিক-নৃতাত্ত্বিক বাঙালি-পরিচয়। তার মানে এ নয়, জনগোষ্ঠীর অপরাপর পরিচয়চিহ্ন সহসা মুলতবি বা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের দাবি শাস্ত্রসম্মত নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষী বিপুল মানুষ রাষ্ট্র তৈরি করেছে মুখ্যত ধর্মীয় পরিচয়ে; ইউরোপের খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষিক পরিচয়ে গড়ে তুলেছে জাতিরাষ্ট্র, যদিও একই রাষ্ট্রে একাধিক প্রধান ভাষাও খুবই সুলভ; আরবরা আবার শ্রেষ্ঠাংশে একই ধর্মানুসারী এবং ভাষাভাষী হয়েও আনন্দের সঙ্গে বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে দিনযাপন করছে। বলার কথাটা হলো, এসব পরিচয়-নিশ্চয়নের কোনো একহারা স্বীকৃত তরিকা নেই, সম্ভবত তা জরুরিও নয়; আবার এসব উপাদান পরস্পরবিরোধীও নয়। আমরা আমাদের মূলধারার আখ্যানে ভাষা আন্দোলনকে পরিচয়-নিশ্চয়নের কাজে খানিকটা সংকীর্ণভাবে ব্যবহার করে সম্ভবত জনগোষ্ঠী হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। উদাহরণ হিসেবে বলি, আমরা সম্ভবত আমাদের অতি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক-নৃতাত্ত্বিক বাঙালি পরিচয়কে যথেষ্ট কাজে না খাটিয়ে বেশি পরিমাণে কলকাতার সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের দ্বারস্থ হয়েছি। ভাষা আন্দোলনকে ছেদ হিসেবে না দেখে ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখলে সম্ভবত এই মুসিবত তুলনামূলক কম হতো। কথাটা বোঝার জন্য আরেকটা উদাহরণ দিই। ভাষা আন্দোলনের বর্তমানে চালু প্রভাবশালী ডিসকোর্সে আপনি সম্ভবত তমদ্দুন মজলিস বা আবুল মনসুর আহমদকে স্বস্তিকরভাবে আঁটাতে পারবেন না। অথচ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বলছে, আঁটানো দরকার। এসব ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা পরিহার করলে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিশ্চিতভাবেই সুদৃঢ় হবে।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় দিকের উদাহরণ হিসেবে বলছি, ভাষা আন্দোলনে ভাষা রাজনৈতিক বর্গ হয়ে উঠেছিল খুবই বাস্তব পটভূমিতে। বদরুদ্দীন উমরের পূর্বোক্ত বই আমাদের সেভাবেই দেখতে শেখায়। সংগত কারণেই উঠেছিল রাষ্ট্রভাষার দাবি। ‘রাষ্ট্রভাষা’ কথাটার সঙ্গে গণতান্ত্রিক জনমুখী রাষ্ট্রগঠনের প্রকল্প সরাসরি সম্পর্কিত। আমরা যে সে দাবি বহুদিন হলো ত্যাগ করে ১৯৫২–কে বেশ আরামদায়ক সাংস্কৃতিক বর্গে পরিণত করেছি, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আজকাল মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করছি এবং, দেখাই যাচ্ছে, বেশ তৃপ্তি ও সার্থকতা বোধ করছি। একে কী বলব? উন্নতি না অবনতি?
আপনি অবশ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির কথাই মুখ্যত জানতে চেয়েছেন। আমার পক্ষে সে উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ, সাহিত্য-সংস্কৃতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখার তরিকা আমি রপ্ত করতে পারিনি। আমি বরং মনে করি, সমাজ-রাজনীতির ইতিবাচক পরিবর্তন হলেই কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিবাচকতা সম্ভব। তবে এ কথা বলতে পারি, বাংলাদেশের বিকাশোন্মুখ মধ্যবিত্ত বিশ শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশকে যেসব তৎপরতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, সাহিত্য ও অপরাপর মাধ্যমে তার গভীর প্রতিফলন ঘটেছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকজুড়ে। ভাষা আন্দোলন নিঃসন্দেহে সেই যাত্রাপথের সবচেয়ে শনাক্তযোগ্য চিহ্নস্থল।

আমার ধারণা, বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা আন্দোলনের আগে যা করত তাও বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি। সেদিক থেকে জীবনানন্দের কবিতা, ফররুখ আহমদের কবিতা এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্ম একই বাঙালি সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশমাত্র। একই কারণে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে এবং রাজনৈতিক তৎপরতার দিক থেকে আগের কয়েক দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনকে মিলিয়ে পড়া দরকার। গুলিয়ে না ফেলাটাই যথেষ্ট।

প্রশ্ন: প্রমিত বাংলা বিষয়ে বেশ কিছু বিতর্ক আছে। পূর্ব বাংলায় যে ভাষায় কথা বলা হয়, প্রমিত বাংলার সঙ্গে তার কি কোনো বিরোধ আছে? থাকলে কীভাবে এ বিতর্কের নিরসন করা যায়?
মোহাম্মদ আজম: প্রমিত বাংলা নিয়ে বিতর্ক বলতে আপনি বোধ হয় গত প্রায় তিন দশক ঢাকায় প্রমিতপক্ষীয় এবং প্রমিতবিরোধীদের তর্ক-বিতর্ককে বুঝিয়েছেন। এই তর্ক তো আছে এবং বেশ জোরালো আর তাজা অবস্থাতেই আছে। সে আলাপে ঢোকার আগে বলা দরকার, প্রমিত ভাষা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। কারণ, প্রমিত সব সময়েই এক জবরদস্তিপূর্ণ ভাষারূপ, এই অর্থে যে অন্য দশ ভাষারূপকে নাকচ করে বা অন্তত কোণঠাসা করেই প্রমিত নিজের মান্যতা ঘোষণা করে। মিখাইল বাখতিনের শব্দ ধার করে বলতে পারি, প্রমিত ভাষা হলো ভাষার বহুমাত্রিক বাস্তবতার মধ্যে একরৈখিকতার সন্ত্রাস। এই জবরদস্তি বা সন্ত্রাস সে চালাতে পারে, অর্থাৎ বহুজনের অভ্যাস ও আরামকে বরবাদ করে প্রমিত যে বহাল তবিয়তে জায়মান থাকে তার কারণ আসলে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নিজেই একটা নিপীড়ক অথচ ভীষণ দরকারি প্রতিষ্ঠান। এই রাষ্ট্রের কেন্দ্রত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কেন্দ্রীয় ভাষারূপ প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী নিজেদের ভাষারূপকে প্রতিষ্ঠা দেয় প্রমিত ভাষা হিসেবে। দুনিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সাধারণত রাজধানী অঞ্চলের ভাষাই কালক্রমে মান্যভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। এখানে বলা হয়ত অসংগত হবে না, রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে প্রস্তাব করেছিলেন ‘প্রমিত ভাষার রাজধানীতত্ত্ব’।
প্রমিত বাংলার গোড়ার গলদ এই যে এই ভাষা কলকাতার ভদ্রলোকগোষ্ঠীর মুখের ভাষা থেকে গৃহীত হয়নি। ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় মুখের ভাষা থেকে দূরবর্তী এক লেখ্য ভাষার চর্চা হয়েছিল এবং কালক্রমে শি‌ক্ষিত নগরবাসী জনগোষ্ঠীকে নিজেদের মুখের ভাষার সাথে সে ভাষার সমঝোতা করে প্রমিত ভাষারূপ তৈরি করতে হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী এ প্রক্রিয়াকে ‘ভাষা মুখ থেকে কলমে না এসে কলম থেকে মুখে আসা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। যাই হোক, কলকাতার প্রমিত বাংলা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে নদীয়া অঞ্চলের ভাষা মূল ভূমিকা পালন করেছিল বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। এ কারণেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষারীতির সঙ্গে ওই প্রমিতের তুলনামূলক বেশি সংগতি পরিলক্ষিত হয়। যতই পুবে যাওয়া যায়, এই অসংগতি বাড়তেই থাকে। সিলেট বা চাটগাঁ অঞ্চলে ফারাকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাপারটা বিশুদ্ধ ভৌগোলিক এবং শরীরতাত্ত্বিক ব্যাপার; মোটেই সাংস্কৃতিক মানের উচ্চতা বা নিম্নতার মামলা নয়।
এখন আসা যাক ঢাকা বা বাংলাদেশের প্রমিত ভাষায়। বাংলাদেশে প্রমিতের বাতচিত যখন হচ্ছিল বা হওয়ার কথা, সে সময় আমরা ছিলাম পাকিস্তান নামক এক আজদাহার খপ্পরে। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বিচড়ে দেখলেই বোঝা যাবে, আমরা ওই সময় ব্যস্ত ছিলাম নিজেদের কাছা সামলানোর কাজে। পাকিস্তানের রাষ্ট্র-প্রযোজিত সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা বাধ্য হয়েছি কলকাতার দ্বারস্থ হতে। কলকাতায় জমে ওঠা প্রমিত ভাষাটিকেই আমরা হুবহু আমাদের প্রমিত হিসেবে গ্রহণ করেছি বা করতে বাধ্য হয়েছি। এখানে উল্লেখ করা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না, এই কারবারে যাঁরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ একাংশ কলকাতার প্রমিত বাংলায় অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে বাংলাদেশের প্রমিত বাংলার মূল সংকট এই যে বিধিবদ্ধ হওয়ার কালে এতে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার উচ্চারণবিধি মোটেই গুরুত্ব পায়নি। ব্যাকরণে, অভিধানে, উচ্চারণ অভিধানে এ অবস্থা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অব্যাহত আছে। এই প্রমিতে অসম্মতি বা অনাগ্রহ দেখিয়ে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ তাই মোটেই অন্যায্য অবস্থান নেয়নি।
এ অবস্থার অবসানের জন্য আসলে ‘প্রমিত ভাষার তত্ত্ব’ সম্পর্কে সচেতন হওয়াই যথেষ্ট। প্রমিতবিরোধীদের খেয়াল রাখা দরকার, প্রমিত ভাষার ধারণা একটা জরুরি ধারণা। কারণ, ভাষা শুধু বাতচিতের জন্য নয় বা সাহিত্য-শিল্প করার জন্য নয়। বরং এতে শিক্ষা চালাতে হয়, আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম চালাতে হয়। অন্যদিকে পুরোনা প্রমিতপন্থীরা একে যেভাবে ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে দেখেন, যেভাবে পরিবর্তনহীন অনড় অবস্থানের নিরিখে দেখেন, আর ভাষা-ব্যবহারকারীদের প্রবণতার দিকে অমনোযোগী থাকেন, তার কোনোরূপ যুক্তি খোদ প্রমিতের তত্ত্বের দিক থেকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। জনগোষ্ঠীর শি‌ক্ষিত নাগরিক অংশের উচ্চারণ ও ব্যবহারভঙ্গি আমলে এনে প্রতিনিয়ত গ্রহিষ্ণু এবং পরিবর্তনশীল থাকার মাধ্যমেই কেবল প্রমিতরীতি নিজের অবস্থানকে তুলনামূলক সর্বজনীন করে তুলতে পারে।

প্রশ্ন : এখন বই বা পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা না হলেও লেখকেরা নিজেদের প্রকাশের জন্য ফেসবুক বা অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম বেছে নিচ্ছেন। সেগুলো পড়াও হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন, সাহিত্যও একসময় এ মাধ্যমগুলোতেই টিকে থাকবে? বই বা ছাপা মাধ্যমগুলোর জায়গা কি এ মাধ্যমগুলো নিয়ে নেবে?
মোহাম্মদ আজম: আপনার আশঙ্কা বা অনুমান যদি সাহিত্যের রূপ নিয়ে হয় তাহলে আলাপটা হবে একরকম, আর যদি কাগজে ছাপা বই-পত্রিকার বিপরীতে সফট কপির দৌরাত্ম্য নিয়ে হয়, তাহলে আলোচনাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে গড়াবে। আপনার প্রশ্নে দুই দিকেরই ইশারা আছে। তবে ছাপানো বই বা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগটাই প্রধান মনে হলো।
আমার কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্বেগ নাই। নানা বোধগম্য কারণে আমি কম্পিউটারের স্ক্রিনে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ছাপা বই পড়ার পারসেপশনজনিত কিছু বাড়তি সুবিধা সত্ত্বেও। জরুরি আলাপটা হলো, এর মধ্য দিয়ে আমি আসলে বইই পড়ি বা খবরের কাগজই পড়ি। পরিবেশনার রীতি বা মাধ্যম বা প্রযুক্তি বদল হওয়ার কারণে কিন্তু বই বা পত্রিকার মৌলিক বদল ঘটে না। তবে এ অবস্থা অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে খোদ বই বা পত্রিকা-বিষয়ক পারসেপশনে বেশ কিছু বদল ঘটবে, যার নানা লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত বলা যাক, কাগজে ছাপা বই বা পত্রিকার ভার বোধ হয় দুনিয়া বেশি দিন সইতে সম্মত হবে না। হওয়ার খুব একটা কারণ দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত কাগজের বুকে ছাপা বই দুনিয়াতে থাকবে অপ্রয়োজনীয় বিলাসী উপাদান হিসেবে।
আমার কাছে বরং পুরো প্রক্রিয়ার অন্য দিকটিই বেশি আকর্ষণীয়। নতুন প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমগুলো সাহিত্যের রূপ-সম্পর্কিত এবং উপভোগ-সম্পর্কিত আমাদের বর্তমান ধারণায় দ্রুত মৌলিক পরিবর্তন ঘটাবে বলেই মনে হয়। এরকম তিনটি সম্ভাবনার কথা এখানে উল্লেখ করছি, যদিও আরও বড় ধরনের উল্লম্ফনের সম্ভাবনাই অনেক বেশি। এক. অংশগ্রহণমূলকতার ভিত্তিতে সৃষ্টিশীল বা বুদ্ধিবৃত্তিক রচনাদির পরিমাণ বাড়ার কথা। দুই. লিখিত মাধ্যম এবং ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের যৌথতায় নতুন নতুন ফর্ম বিকশিত হওয়ার বা স্বীকৃত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তিন. সাহিত্য-শিল্পের উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যকার দূরত্ব সম্ভবত নতুন রূপ নেবে। ফলে উৎপাদন ও ভোগের প্রক্রিয়াও বদলে যাবে।
মনে রাখা দরকার, বই হিসেবে ছাপার কথা মাথায় রেখে লেখা সাহিত্যকর্ম ফেসবুকে পোস্ট করা এক জিনিস, আর সরাসরি অনলাইন মাধ্যম বা প্রযুক্তিনির্ভর অন্য মাধ্যমের জন্য লেখা অন্য জিনিস। ছাপা বইয়ের বা কাগজের রাজত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা ওই শেষোক্ত ধারায় প্রবেশ করব। মনে হচ্ছে, সেদিন খুব দূরে নয়। আমার কাছে সম্ভাব্য সেই বাস্তবতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হবে অধিকতর অংশগ্রহণমূলকতা এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। আর ছাপাখানার আবিষ্কার বা ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার আবিষ্কার মানুষের সামগ্রিক শিল্পবোধে যে বদল ঘটিয়েছিল, এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা তার চেয়েও বড় হওয়ার কথা।

প্রমিত ভাষা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। কারণ, প্রমিত সব সময়েই এক জবরদস্তিপূর্ণ ভাষারূপ, এই অর্থে যে অন্য দশ ভাষারূপকে নাকচ করে বা অন্তত কোণঠাসা করেই প্রমিত নিজের মান্যতা ঘোষণা করে। মিখাইল বাখতিনের শব্দ ধার করে বলতে পারি, প্রমিত ভাষা হলো ভাষার বহুমাত্রিক বাস্তবতার মধ্যে একরৈখিকতার সন্ত্রাস। এই জবরদস্তি বা সন্ত্রাস সে চালাতে পারে, অর্থাৎ বহুজনের অভ্যাস ও আরামকে বরবাদ করে প্রমিত যে বহাল তবিয়তে জায়মান থাকে তার কারণ আসলে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নিজেই একটা নিপীড়ক অথচ ভীষণ দরকারি প্রতিষ্ঠান। এই রাষ্ট্রের কেন্দ্রত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কেন্দ্রীয় ভাষারূপ প্রয়োজন হয়।

প্রশ্ন : ইতিহাসভিত্তিক লেখায় অনেক সময়ই রেফারেন্স উল্লেখ করা হয় না। কিংবা বিতর্কিত রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়। আপনি কি মনে করেন যেকোনো লেখাই তথ্যসমৃদ্ধ হতে হলে গবেষণার দরকার আছে? বলতে চাইছি, ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে লেখালেখি কি সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে?
মোহাম্মদ আজম: এ প্রশ্নটিকে বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। বোধ হয় আপনি রেখে-ঢেকে কথা বলেছেন। কারণটা অবশ্য পরিষ্কার নয়। তবে যদি আক্ষরিক অর্থে নিই, তাহলে বলতে হবে, আপনার প্রশ্নের উত্তর আসলে প্রশ্নেই দেওয়া আছে। যদি রেফারেন্স ছাড়া কেউ লেখে, যদি ভুল রেফারেন্স দিয়ে লেখে, যদি গবেষণামূলক না হয়, তাহলে খারাপ তো বটেই। ভুল তথ্য বিপদও ডেকে আনে। কিন্তু অনুমান করছি, ব্যাপারটা এত সরল নয়। কারণ, যে লেখা লেখা হয়নি, তা নিয়ে আমরা কথা বলব কেন? আর কোনো লেখাকে লেখা হতে গেলে তাতে রেফারেন্স থাকতেই হবে, তা গবেষণামূলকও হতে হবে। কায়দামাফিক রেফারেন্স নাও থাকতে পারে, আর গবেষণার পদ্ধতিগত দিক অনুসৃত নাও হতে পারে। মুশকিল হলো, এগুলো ঠিক করার কোনো পদ্ধতি সাব্যস্ত করা আসলেই খুবই জটিল। এবং ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, বিতর্কিত রেফারেন্স কথাটার কি কোনো সংজ্ঞা আছে? বিতর্ক আছে এমন জিনিস যদি আমরা এড়িয়ে চলতে থাকি, তাহলে বিদ্যমান প্রভাবশালী ডিসকোর্সের মধ্যেই কি আমরা আটকে যাব না? ‘ভুল তথ্যের’ সাহিত্য বলতেই বা কী বোঝায়? সৃষ্টিশীল সাহিত্যে তথ্যের ভুল-শুদ্ধ কীভাবে নির্ধারিত হবে? আপনার প্রশ্নের টোন যদি আমি ঠিকমতো আঁচ করতে পারি, তাহলে বলব, চিন্তার এই ধরন নানা মাত্রিক ফ্যাসিবাদী চর্চাকেই উৎসাহিত করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎপরতা যেখানে প্রভাবশালী, কিংবা যেসব সমাজে শিক্ষার গভীরতা বা বিস্তার আছে, সেসব জায়গায় গবেষণা বা ইতিহাস প্রণয়নের ব্যাপারটা পদ্ধতিমাফিকই সম্পন্ন হয়। ওই মানদণ্ডে ঘাতসহ না হলে বাতিল জিনিসগুলো আপসে-আপ ঝরে পড়ে। ক্ষতি করার সুযোগ পায় না। সৃষ্টিশীল সাহিত্যে বা অ-অ্যাকাডেমিক রচনাদিতে এই মূল্যায়নটা হয় সরাসরি বাজার মারফত। এর মধ্যে ভোক্তা আছে, পত্র-পত্রিকা আছে, রিভিয়্যুয়ার আছে। অচল মালগুলো এসব ছাঁকনিতে অচিরেই অদৃশ্য হয়ে যায়। আসলে বলা উচিত, এরা বাজারে আসারই সাহস পায় না। আমাদের সমাজে এর কোনোটিই নেই, অথবা না-থাকার মতো করে আছে। তারপরও যার কাজ তাকেই করতে দেওয়া উচিত। অন্যথায় সমাজ-বিকাশের গতি রুদ্ধ হবে। ‘বিতর্কিত রেফারেন্স’ ব্যবহার করার বিপদ আছে, কিন্তু কোনো রেফারেন্সকে ‘বিতর্কিত’ নামে ডাকার ছাড়পত্র আরও বেশি বিপদ ডেকে আনতে পারে।