ইন্টারভিউ

সি-লায়নের চুল নেই। কিন্তু বড় বড় গোঁফ আছে। শুধু এটুকু মিল থাকার জন্য কোনো মানুষকে সি-লায়ন মনে করার কারণ নেই। কিন্তু লোকটাকে দেখে আমার তা-ই মনে হয়। সি-লায়নের রঙের একটা কোটও পরে আছে সে। সমুদ্র থেকে উঠে আসার পর সি-লায়নের মুখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তে থাকে। তার মুখেও বড় বড় ঘামের ফোঁটা। সে তা একবারও মোছার চেষ্টা করে না।

সি-লায়ন সম্পর্কে আমার জানার কথা না। কিন্তু অনেক দিন ধরে আমি বিসিএসের জন্য পড়ছি। আমার অভ্যাস খারাপ। পড়তে পড়তে যা ভালো লাগে তাই পড়া শুরু করি। কয়েক দিন আগেই পড়েছি সি-লায়ন নিয়ে। স্টেলার নামের সি-লায়নের ওজন হয় এক হাজার কেজি। এদের চাচাতো ভাই ওয়ালরাস নামের একটা দাঁতালো প্রাণী। তার ওজন হয় দুই হাজার কেজি। আমার ঠিক সামনে যে, তার ওজন অবশ্য এক শ কেজির বেশি হবে না।
সে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমারও চোখ পিটপিট করার অভ্যাস আছে। কিন্তু এখন এটা করা যাবে না। জোর করে চোখের পাতা খোলা রাখি। সে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে। বলে, আর্কিমিডিসের বাবার নাম কী?
আমার মৌখিক পরীক্ষা হচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চার নম্বর বোর্ডে। আমার জন্মসংখ্যা তিন। কাজেই চার আমার জন্য কুফা নম্বর। না হলে রুমে ঢোকার সাথে সাথে বকা খেতাম না। বকা খেয়েছি রুমে ঢুকেই বসে পড়ার জন্য। অথচ আগের বিসিএসে বসার অনুমতি চেয়েছিলাম বলে বকা খেয়েছিলাম। এক পণ্ডিত ব্যঙ্গ করে বলেছিল, বি স্মার্ট! এটা তোমার জন্যই রাখা চেয়ার।
এবার আমি স্মার্ট হতে গিয়ে ধরা খেয়েছি। কেন যেন পরীক্ষকেরা প্রথম থেকে রেগে আছে আমার ওপর। বোর্ডে আছে পাঁচজন। এখন প্রশ্ন করছে মাত্র দুজন। একজন বসে বসে ঝিমোচ্ছে। বাকি দুজন অনর্গল গল্প করছে। গল্পের বিষয় আইপিএল ক্রিকেট। ধোনি নাকি বিরাট কোহলি—কে ভালো ক্রিকেটার তা নিয়ে তর্কও হচ্ছে সরকারি কর্মকমিশনের এই দুই পরীক্ষকের মধ্যে।
আমি মন দিয়ে তা-ই শুনছিলাম। এসবের মধ্যে হঠাৎ আর্কিমিডিসের বাবা কীভাবে এল বুঝতে পারি না। আর্কিমিডিস বিরাট বড় বৈজ্ঞানিক। লোহা কীভাবে ভাসবে, এটা আবিষ্কার করে সে গোসল করার সময় ন্যাংটা অবস্থায়। সে অবস্থায় সে ইউরেকা ইউরেকা বলে রাস্তায় ছুটে গেছে। কাজেই আর্কিমিডিসকে নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু আর্কিমিডিসের বাবাকে নিয়ে কেন? আমার নিজের বাবার নাম জানতে চাইলেও এতটা অবাক হতাম না আমি।
সি-লায়নকে ভালো করে দেখি। আসলেই সে এই প্রশ্নটা করেছে। সে আবারও চোখ পিটপিট করে বলে, বাবার নাম?
আবদুস সামাদ।
আর্কিমিডিসের বাবার নাম আবদুস সামাদ?
জি না। আমার বাবার নাম।
সি-লায়ন চড়া গলায় বলে, আমি আর্কিমিডিসের বাবার নাম জানতে চেয়েছি।
আমি আর উত্তর দিই না। উত্তর জানলে তো দেব। বিসিএসে আমি চেয়েছি অ্যাডমিন ক্যাডার। আর্কিমিডিসের বাবার সঙ্গে জনপ্রশাসনের কী সম্পর্ক!
প্রকাণ্ড একটা টেবিলের মাঝখানে আমাকে বসানো হয়েছে। আমার চারপাশে এখন শিকারিদের মতো চোখ করে তাকিয়ে আছে ভাইভা নিতে আসা পণ্ডিতবৃন্দ। আর্কিমিডিসকে নিয়ে কথাবার্তা পছন্দ হয়েছে তাদের। আমি এখন কিছু বললেই খপ করে ধরবে তারা। সে সুযোগ না দিয়ে আমি নীরব থাকি।
বোর্ডে একজন মাত্র মহিলা আছে। সে আমাকে নীরব থাকতে দেয় না। শান্ত গলায় বলে, লুলুসিএফ মানে কী?
জি!

এলইউএলইউসিএফ। এটার মানে কী?
এলইউএলইউসিএফ মানেই তো লুলুসিএফ। আমি তাই বলি।
মহিলা পণ্ডিত এবার বিরক্ত গলায় বলে, আমি লুলুসিএফ মানে কী সেটাই তো জানতে চাচ্ছি!
লুলুসিএফ! এটা কি কোনো ভাইরাসের নাম? নাকি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর? আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। আমাকে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করার মানে কী?
মোটা ঘাড়ের মহিলার প্রশ্নে নীরব হয়ে গেছে ইন্টারভিউ বোর্ড। আমার কেন যেন মনে হয় এরা কেউ জানে না উত্তরটা। জানে শুধু মোটা মহিলা। সে বিপুল উৎসাহ নিয়ে বলে, লুলুসিএফ মানে হচ্ছে ল্যান্ড ইউজ, ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জ অ্যান্ড ফরেস্ট্রি। এটা কিয়োটো প্রটোকলের একটা মেকানিজম। কিয়োটো প্রটোকল কী তা সে সবিস্তার বর্ণনা করতে থাকে। বর্ণনা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে। একবার পানি খায়। পানি খাওয়া শেষ হলে মুখ হাঁ করে ওপরের দিকে তাকায়। বলে, এসি নষ্ট নাকি স্যার?
স্যার মানে সি-লায়ন। সে মন দিয়ে শুনছিল লুলুসিএফের বিষয়। মহিলার কথা শুনে সে এসির রিমোট নিয়ে টেপাটেপি করে কয়েকবার। বিরক্ত গলায় বলে, কী সব চায়নিজ এসি বানায় আজকাল।
এটা বলে সে রিমোট ছুড়ে মারে টেবিলে। তা প্রায় আমার বুকের কাছে এসে থামে। সে প্রচণ্ড রেগে বলে, কিচ্ছু জানে না এরা।
এরা মানে কে! এরা মানে কি চায়নিজরা? নাকি আমি? আমিই বোধ হয়। না হলে আমার দিকে এমন আগুন চোখে তাকিয়ে আছে কেন?
যা বোঝার বুঝে যাই। এবারও হবে না বিসিএসে। এমনিতেই লিখিত পরীক্ষায় নিচের দিকে আমার নাম। ভাইভায় কিছু না পারলে এবারও চাকরি হবে না।
অথচ আমি কিছুই পারি না তা ঠিক নয়। এমনকি কিয়োটো প্রটোকলও জানি আমি। আর্কিমিডিসের বাবার কথা চিন্তা করতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। না হলে শুধু কিয়োটো কেন, প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট নিয়েও কত কিছু বলতে পারতাম। আইএনডিসি মানে ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন। আইএনডিসিও পড়ে এসেছি আমি।
সি-লায়নের লোকজন বিড়বিড় করছে। বিড়বিড় শব্দগুলোর মানে হচ্ছে আমার কোনো আশা নেই আর। এখন আমি গেলেই খুশি ওরা। কাজেই এত ভিতু হয়ে থাকার মানে হয় না আর। আমি মোটা মহিলাকে বলি, ম্যাডাম আমি আইএনডিসি জানি।
তিনি অবাক হয়ে বলেন, আইএনডিসি কী?
আমি খুশি হই মনে মনে। তার মানে জানে না সে। গুড। আমি সি-লায়নের দিকে তাকিয়ে বলি, স্যার আমি আর্কিমিডিসের মায়ের নাম জানি।
মানে?
আর্কিমিডিসের মায়ের নাম অলিম্পিয়কস্।
আর্কিমিডিসের মায়ের নাম দিয়ে আমি কী করব?
তাহলে বাবার নাম দিয়ে আমি কী করব?
মানে কী? এই ছেলে, হোয়াট ডু ইউ মিন?
কিছু না। আসি স্যার।
আসি মানে? তোমার ভাইভা তো শেষ হয়নি।
আমি মুচকি হাসি। হয়েছে, স্যার, হয়েছে।
বাইরে শরতের আকাশ। সাদা সাদা মেঘফুল মাথার ওপর। আমি সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিই। তার ছায়া খুঁজি ভিআইপি সড়কে। সেখানে শুধুই ঝলসে দেওয়া গাড়ির ছাদ।
ক্যান্টনমেন্টের কাছে এই জায়গাটায় রিকশা চলে না। সিএনজিও থামে না। আমি ক্রিসেন্ট লেকের দিকে হাঁটা ধরি। মোবাইল ফোন অন করে দেখি আটটা মিসকল। আটটাই শর্মিলার। অন্য কারও অবশ্য ফোন করার কথা না। আজকে যে চাকরির ইন্টারভিউ, এটা বলিনি কাউকে। কতবার বলা যায় এসব।
আমার ফোন বাজছে আবার। ফোন সামনে ধরে অবাক হয়ে যাই আমি। অচেনা নাম্বার। কেটে দিই। আবার ফোন! আমি ধমকের সুরে বলি, কে?
আমি। তুমি কই সোনা? কেমন হলো ভাইভা।
শর্মি, কার ফোন এটা?
এই যে একটা আপুর ফোন থেকে করলাম। তুমি আসো তাড়াতাড়ি।
তোমার ফোন কই?
চার্জ শেষ। তোমার পরীক্ষা?
পরীক্ষা! খুব ভালো। খুবই।
সত্যি! সত্যি শব্দটা লম্বা টানে উচ্চারণ করে শর্মি। হেসে দিই আমি। সে বলে, বুঝছি আমি। আসো তাড়াতাড়ি।

২.
ক্রিসেন্ট লেকে শর্মি কোথায় থাকবে, জানি আমি। ওর কাছে যেতে যেতে তিনটা সিগারেট খাই। শর্মি জানলে রাগ করবে। সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না সে। তার ভাই থাকে দুবাইয়ে। সিগারেট যেন ছেড়ে দিই, এ জন্য সে দুবাই থেকে ইলেকট্রিক সিগারেট আনিয়েছে। সেই সিগারেট গাঁজাখোরের মতো জোরে জোরে টানতে হয়। তারপর তার পশ্চাদ্দেশ থেকে অতিসামান্য একটা পচা গন্ধের মতো কিছু বের হয়। আমি শর্মির সামনে মুখ কুঁচকে তা-ই টেনেছিলাম কয়েক দিন।
সে অন্তর্যামী টাইপের একটা মেয়ে। নিজেই একদিন ইলেকট্রিক সিগারেট ফেলে দিয়েছে ক্রিসেন্ট লেকে। আমাকে শুধু বলেছে কম খেতে। কম খাওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু কম কেন খেতে হবে, তা বুঝতে পারি না। সিগারেট খেলে খারাপ অসুখ হয়, মানুষ তাড়াতাড়ি মরে যায়। তাড়াতাড়ি মরে গেলে অসুবিধাটা কী?
অসুবিধা একটাই। শর্মি তাড়াতাড়ি বিধবা হয়ে যাবে। সেটাও হবে যদি সত্যি তার সাথে বিয়ে হয় আমার কোনো দিন।
শর্মি ইন্টারভিউ বৃত্তান্ত শুনে হাসে অনেকক্ষণ। ক্রিসেন্ট লেকের পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা এসেছি আসাদগেট আড়ংয়ে। আড়ংয়ের ক্যানটিনের বেসন দিয়ে চিংড়ি ভাজা খুব প্রিয় আমার। শর্মিরও। সে দু প্লেট প্রন অর্ডার দিয়ে বলে, কিন্তু অলিম্পিয়কস্ নামটা তুমি জানলে কীভাবে?
জানব না কেন! এটা তো গ্রিসের ফুটবল টিম।
কীইই! অলিম্পিয়কস্ আসলে মা না? শর্মির হাসি থামেই না। ফুটবল টিম আর্কিমিডিসের মা। তুমি পারোও।
শর্মি মায়াময় চেহারার একটা মেয়ে। হাসলে তাকে আরও মায়াময় মনে হয়। তার চোখ চিকচিক করে ওঠে, মুখে মায়াজল টলমল করতে থাকে, পুরো শরীর দুলতে থাকে। তার হাসির শব্দটাও খুব সুন্দর। শর্মি জানে না ওকে হাসানোর জন্য কত রকম চেষ্টা করি আমি।
শর্মি আমার ঘোর লাগা চোখ দেখে থামে। কী হলো তোমার?
কিছু না।
কিছু না মানে? কোথাও হারিয়ে যাও তুমি হঠাৎ?
তোমার ভেতরে।
ধুত। শর্মি তার ওড়না ঠিক করে। আজকে সে আকাশ-নীল কামিজ পরেছে, তার মধ্যে বহু রঙের কারুকাজ। তাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে রাধাচূড়ার মতো হলদে রঙে। আড়ংয়ের ক্যানটিনে ঢোকার আগে কাপড় দেখছিলাম আমরা। সেখানে রাধাচূড়া রঙের জমিনে গোলাপি একটা কামিজ দেখে কেনার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু দাম দেখে সরে যাই। শর্মি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। হাসলেও কিছু করার নেই। দুই হাজার টাকা কেন, এক হাজার টাকাও নেই আমার কাছে। কখনোই থাকে না।
শর্মি তর্জনী ছোঁয়ায় আমার নাকে। এই, কী হয়েছে?
কিছু না। চাকরি নিয়ে চিন্তা হয়।
কেন, চাকরি না হলে অসুবিধা কী?
আমি হাসি। অসুবিধা নাই। যত দিন তুমি আছো, অসুবিধা নাই।
আমি তো আছিই।
শর্মি গাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। শুধু ওর চোখ দুটো যদি আমার জগৎ হতো, তাহলে চাকরির দরকার থাকত না। কিন্তু সেই চোখে কতক্ষণ আর তাকিয়ে থাকতে পারি আমি।
খাওয়ার পর শর্মি হঠাৎ একটা কাণ্ড করে। তিনটা এক হাজার টাকার নোট বের করে। বলে, ধরো, তোমার পুরস্কার।
কিসের?
আর্কিমিডিসের মায়ের নাম বলার।
শর্মি টেবিলের ওপর ঝট করে তিনটে নোট রাখে। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক দুর্দান্ত মোচড়ে কাউন্টারের কাছে পৌঁছায়।
এমন না যে শর্মি আমাকে টাকা দেয়নি আগে। তাই বলে এত টাকা! আমি তাকে কিছু বলার সুযোগও পাই না। সুযোগ পেলেও লাভ হবে না কোনো।
সে এখন তন্ময় হয়ে বিছানার চাদর দেখছে। আমি ঘুরতে ঘুরতে কামিজ রাখার জায়গাটায় যাই। যখন আমার চাকরি হবে আমি শর্মিকে একসাথে পাঁচটা সালোয়ার-কামিজ কিনে দেব। পাঁচটা না, প্রথম মাসের টাকা দিয়ে যতগুলো পাওয়া যায় সবগুলো। কিন্তু আমার চাকরি কি হবে কেনো দিন? কোনো দিন না।
টের পাই না কখন রাধাচূড়া রং কামিজের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। হাত বুলিয়ে দেখি তা। এত মোলায়েম! শুধু শর্মিকেই মানায় এটা।
এই কামিজটা কিনতে পারি আমি এখন। এটার দাম দুই হাজার দুই শত টাকা। এক হাজার টাকার তিনটা নোট আছে আমার কাছে এখন।
শর্মি নুয়ে নুয়ে চাদর দেখছে। একটু দূরে সরে আবার কাছে আসছে। কী একটা কথায় হেসেও উঠছে। এত হাসতে পারে মেয়েটা!
আমার দিকে একবারও তাকায় না সে। আমি যে আছি এটাই যেন মনে নাই তার। একা একা কামিজটা হাতে নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। এটা কিনতেই সে আমাকে টাকাটা দিয়েছে।
এতক্ষণ লাগল এটা বুঝতে আমার!

৩.
চাকরি একটা দরকার আমার। আমার হলে থাকতে সমস্যা হচ্ছে। মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার সাথে সাথে হল থেকে চলে যাওয়ার নিয়ম আছে। এই নিয়ম মানতে হয় না সবার। কিন্তু আমি তাদের মতো না। কোনো ছাত্রনেতার হাতে-পায়ে ধরে আমি হলে থাকতে রাজি না। সায়েম আমাকে বলেছিল সরকারি ছাত্রসংগঠনে ঢুকে যেতে। হলে সিট পাওয়ার জন্য, হলে থাকার জন্য সবাই করে এটা। আমিও একসময় করেছি এসব। কিন্তু এখন আর রুচি হয় না।
আমার রুমে দুজনের থাকার কথা। দুজনই ছিলাম। কিন্তু হলের নেতা মাসখানেক হলো আরও দুজনকে তুলে দিয়েছে। সেই দুজনের একজনের কাজিনও এসে থাকে মাঝে মাঝে রাতে। তিনজন একসঙ্গে হইহুল্লোড় করে তাস খেলে, এনার্জি ড্রিংক খায়। মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেলে এরা। আমাকে একদিন বলে, ভাইজান খেলবেন নাকি?
ইচ্ছে হচ্ছিল চড় দিয়ে কান ফাটিয়ে দিই। কিন্তু আমি কিছু বলিনি এদের। বলে কী হবে? রাতবিরাতে মিছিল করে ফেরে এরা। মিছিলে গেলে, স্লোগান দিলে এমনিই গা গরম হয়ে থাকে। আমাদেরও থাকত। তাই বলে সিনিয়রদের আমরা ‘ভাইজান তাস খেলবেন নাকি’ বলে বসতাম না। এরা বলছে। আমার রেজাল্ট শেষ হলে হয়তো এদের সাথে তাসই খেলতে হবে। রাতবিরেতে মিছিলে যেতে হবে। কোনো কোনো রাতে নাকি মাঠে জড়ো করিয়ে নেতার ভাষণ শোনানো হয়। তারপর সেই ভাষণের ওপর আলোচনাও হয়।
এসব আমার পক্ষে সম্ভব না। রেজাল্ট বের হলেই হল ছেড়ে দেব আমি। বকশীবাজারের দিকে কিছু মেস আছে। সেখানেই উঠব। সেখানে থাকতে হলেও টাকা লাগবে। এই টাকা কি বাবার কাছে চাওয়া সম্ভব? সম্ভব না।

চোর বংশের বড়লোক বন্ধু আছে একজন আমার। পুরো চারটা বছর সে আমার কাছেই পড়া বুঝেছে। আমাকে চাকরি দিতে চেয়েছিল তার বাবার রিয়েল এস্টেট ফার্মে। আমি খুশি মনে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম শর্মির সঙ্গে। কিন্তু সে শর্মির দিকে খুব খারাপভাবে তাকিয়েছিল। শুধু তাই না। শর্মির সামনেই উচ্ছল চিৎকার করে উঠেছিল, ওয়াও! ইউ গট এ জুসি গার্লফ্রেন্ড!
সে হয়তো আশা করেছিল খুশি হব আমি। কিন্তু আমার ভালো লাগেনি কথাটা। মানুষ কি আম-কাঁঠাল নাকি যে জুসি হবে!
আমি তাকে বলি, জুসি কী রে গর্দভ।
সাদমানকে কোনো দিন এভাবে ডাকিনি আগে। সে গর্দভ শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খায়। বলে, কে গর্দভ?
তুই।
আমি গর্দভ?
হ্যাঁ। মাথায় গুঅলা গর্দভ।
সাদমান এরপর থেকে আমার সঙ্গে কথা বলে না ঠিকমতো। আমিও বলি না। তার কাছে চাকরি চাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
চাকরির চেষ্টা তাই বলে কম করিনি আমি। বিসিএস ছাড়াও বিভিন্ন নন-ক্যাডার চাকরির আবেদন করেছি, বড়-ছোট কোম্পানিতে করেছি। এমনকি একবার একটা কলেজে পর্যন্ত চেষ্টা করেছি। ইন্টারভিউ পর্যন্ত যেতে পেরেছি মাঝে মাঝে। কিন্তু সেখানে এমন সব অদ্ভুত প্রশ্ন করে তারা আমাকে! একবার একজন বলে, তোমার বাবার নাম আবদুস সামাদ। তোমার নাম রাজীব আহমেদ কেন? আমি কলেজের আগে পড়েছি সোনাকান্দা স্কুলে। এক চাকরির ইন্টারভিউতে এ নিয়ে কী হাসাহাসি তাদের। একজন বলে, সোনাকান্দা মানে কী মিয়া?
মিয়া শুনেই কি না জানি না, মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল আমার। বলি, সোনাকান্দা মানে সোনার কান্দা, সোনার কান্না!
সোনা আবার কাঁদে নাকি।
কোনো কোনো সোনা কান্দে স্যার।
বলে কি বেয়াদব!
আমি মনে মনে বলি, তুই বেয়াদব।
সে বলে, ইতর কোথাকার।
আমি এবার স্পষ্ট উচ্চারণে বলি, তুই ইতর! ইতরের বাচ্চা ইতর।
শর্মি খুব খুশি হয়েছিল আমি এটা বলতে পারায়। ওর জন্যই হয়তো ব্যাপারটা নেশার মতো হয়ে যায় একসময়। চাকরির ইন্টারভিউতে যাই। আমার সাথে উল্টাপাল্টা করলে আমিও ডাবল উত্তর দিয়ে দিই। শর্মির কাছে এসে গল্প করি। সে হেসে কুটিকুটি হয়। সাবাস বলে পিঠও চাপড়ায় মাঝে মাঝে।
কিন্তু এভাবে আর কত দিন! শর্মি আমাকে বাসায় যেতে বলেছে আজ। মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে সে মালিবাগে থাকে। বাবা নেই, দুবাইতে থাকা বড় ভাইয়ের টাকায় সংসার চলে তাদের। সেই ভাই আসবে সামনের মাসে।
শর্মি আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করে। তার হোম ইকোনমিকস কলেজের গল্প। ছোটবেলার গল্প। ভাইয়ের গল্প। ভাই আসবে দুই মাসের জন্য। এবার নাকি বিয়ে ঠিক করে যাবে তার।
শর্মি করুণ কণ্ঠে বলে, চাকরি-টাকরি পাবে না কিছু?
এতক্ষণে বুঝি, কেন সে ডেকেছে বাসায়। কিন্তু আমি চাকরি পাব কীভাবে? এটা তো আর আমার ওপর না। বিরস গলায় বলি, সামনের সপ্তাহে ইন্টারভিউ আছে একটা।
শর্মি খুবই উৎসাহিত হয়ে ওঠে। কোথায়?
ঢাকার একটা কলেজে। ইংরেজির শিক্ষক।
তাই নাকি! তাহলে তো ভালো চান্স আছে তোমার।
কী জানি। আগেও তো এমন চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছি। হয়নি।
এবার হতে পারে। শর্মি হঠাৎ হাত ধরে আমার। তুমি প্লিজ উল্টোপাল্টা বোলো না কিছু ইন্টারভিউতে।
উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করলেও না?
প্লিজ না। হয়তো উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে টেম্পারামেন্ট দেখে তোমার! একটু সহ্য করে দেখো না।
শর্মি করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি বলি, আচ্ছা, উল্টোপাল্টা বলব না। ভালোমতো প্রিপারেশন নিয়ে যাব।
খুশি হয়েছে শর্মি। খুশিতে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে আমাকে। কিছুক্ষণ পরে অবাক হয়ে দেখি, কাঁপছে ওর শরীর। আমার গলার কাছটা ভিজে যাচ্ছে। সামনে ধরি ওর মুখ। কী হয়েছে বেবি?
কিছু না। স্যরি আমি।
কেন?
তুমি যা ইচ্ছে বলো ইন্টারভিউতে। উল্টোপাল্টা বললে আরও উল্টোপাল্টা বলবে। তোমাকে অপমান করলে ওদেরও অপমান করবে।
কী বলো তুমি!
শর্মি আকুল চোখে তাকিয়ে আছে, প্রমিজ করো।
প্রমিজ!
প্রমিজ করো, যা ইচ্ছে শুনিয়ে দেবে ওদের।
যা ইচ্ছে! চাকরির গুষ্টি কিলাই।
শর্মি জলভেজা চোখে হাসে। আবারও জড়িয়ে ধরে আমাকে। ভাইয়াকে যেভাবে হোক সামলাব আমি। তুমি চিন্তা কোরো না।
শর্মিকে ঠেসে ধরি বুকের ভেতর। ওর দেয়ালে বিদ্রোহী কবির ছবি। নিচে লেখা কবিতা, ‘বলো বীর, চির উন্নত মম শির।’
শর্মি জানে না আসলে উন্নত না আমার শির। ইন্টারভিউ বোর্ডে কখনোই উল্টোপাল্টা কিছু বলি না আমি। একটা চাকরির জন্য নত শিরে সব অপমান সহ্য করি। যা কিছু এসে বলি ওকে, যা এতক্ষণ বললাম আপনাদের, তা শুধু কল্পনা আমার।
তবুও উন্নত শির থাকুক তার কাছে। থাকুক আমার কল্পনায়। না হলে বেকার থেকে আর কী লাভ আমার।