বইমেলা দেশে দেশে

‘ই-বুকের যুগে ছাপানো বইই আমার ভালো লাগে। কারণ, আমার কাছে বই হচ্ছে হাত দিয়ে ছোঁয়ার, গন্ধ শুঁকে নেওয়ার এবং দেখার জিনিস।’ ২০১৮ সালের হংকং বইমেলায় আগত এক তরুণী বিবিসিকে বলছিলেন। বই ঘিরে ঠিক এমনই শিহরণ কাজ করে সারা পৃথিবীতে বই-অনুরাগীদের মধ্যে। বিশেষভাবে আয়োজিত কোনো বইমেলার জন্য সারা বছরই তাই থাকে অন্য রকম উত্তেজনাময় অপেক্ষা। বইমেলার এই মাসে বিশ্বের বড় বড় বইমেলা সম্পর্কে জানাতে আমাদের এই নিয়মিত আয়োজন। আজ থাকছে কায়রো ও ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা সম্পর্কে।



কায়েরো বইমেলা

বাংলাদেশে আজ যখন অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯-এর দরজা খুলছে, ঠিক সে সময়েই আরব বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম বইমেলাটি চলছে মিসরের কায়রোতে। ২৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে তা চলবে ৫ ফেব্রুয়ারি অব্দি।

কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা। হাজার মিনারের শহর, উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রাচীন পীঠস্থান কায়রো নগরী প্রতিষ্ঠার এক সহস্রতম বছরকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৬৯ সালে মেলাটির শুরু। এবার এর সুবর্ণজয়ন্তীতে পুরোনো আয়োজনস্থল নাসর সিটি থেকে সরিয়ে নতুন কায়রোর প্রান্তে তাগামোয়া এল খামিসে নিয়ে আসা হয়েছে। মিসর দাবি করে থাকে, সাধারণের জন্য উন্মুক্ত এটিই পৃথিবীর প্রথম কোনো বইমেলা। এশিয়ার ১৬টি, আফ্রিকা মহাদেশের ১০টি, ইউরোপ থেকে ৭টি ও আমেরিকা মহাদেশ থেকে ৩টি দেশসহ মোট ৩৫টি দেশের অংশগ্রহণে জমে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী এ আয়োজন। প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রতিবছর এতে যোগ দেয়।

ঢাকার নীলক্ষেতের মতোই একসময় কায়রোর মেলাটির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সুর আল-আজবেকায়া। এখানে পুরোনো বা সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের বড় এক বাজার। অতি পুরোনো কোনো দুষ্প্রাপ্য কিংবা চড়া দামের বইগুলোর জন্য আজবেকায়াতে মেলার দর্শনার্থীরা একবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারতে পারতেন। এমনকি অন্য দেশের পাঠকও কোনো একটি বিশেষ বইয়ের সন্ধানে আজবেকায়ায় ছুটে এসেছেন। মার্ক্সের ক্যাপিটাল-এর দুষ্প্রাপ্য মূল সংস্করণ থেকে চীনের মাও জেদং, ইংরেজ অরওয়েল, রাশিয়ান শেখভ কিংবা ইসলামে পণ্ডিত আল কুরতুবিদের বই—সব দিগন্তকে নিয়ে আজবেকায়া কায়রোর এই মেলাকে দিয়েছিল আন্তর্জাতিকতার আবেশ। কিন্তু পরিবর্তিত ভেন্যু থেকে দেড় শ বছরের পুরোনো আজবেকায়া অনেকটা দূরে।

কায়রো বইমেলা
কায়রো বইমেলা

এবার আজবেকায়ার বইবিক্রেতাদের কাউকে কাউকে আমন্ত্রণ জানালেও তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। মেলার বই সাজানোর কঠিন দুরস্ত, এলোমেলো ঢাঁই করার বদলে নানান নিয়মকানুন তাঁদের ভালো লাগেনি। এমনকি পাল্টা একটা মেলার আয়োজনও তাঁরা করে ফেলেছেন!

২০০০ সালের পর থেকে কায়রোর এ মেলা নানান অস্থিরতার শিকার হয়। ফরাসি লেখক মিলান কুন্ডেরা, লেবাননের হানান আল শেইখসহ বেশ কয়েকজন বিদেশি সাহিত্যিকের বই মেলায় প্রদর্শন করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। সরকারবিরোধী, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বিতর্কে নানা তকমায় এগুলো বাদ পড়ে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা

কায়রোর চেয়েও অনেক পুরোনো ফ্রাঙ্কফুর্টার বুকামেসা বা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। আমপাঠকের মেলার চেয়েও এ হলো অনেক বেশি প্রকাশক আর ব্যবসায়ীদের মোকাম।

মধ্য-অক্টোবরের পাঁচ দিনব্যাপী এ মেলার শেষ দুই দিন সাধারণের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত। প্রায় চার মিলিয়ন বর্গফুটের আবদ্ধ জায়গায় আয়োজন। প্রথম তিন দিন প্রকাশক, সম্পাদক, প্রকাশনা সংস্থা, লাইব্রেরিয়ান, লেখক, লাইসেন্সবিষয়ক লোকেদের জন্য।

পাঁচ শ বছরেরও আগে, ১৪৫৪ সালে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার ও এর ব্যাপক প্রসারের আগ পর্যন্ত স্থানীয় বই ব্যবসায়ীরা মূলত এখানে পাণ্ডুলিপি কেনাবেচা করতেন।

১৯৭৬ সাল থেকে প্রতিবার একটি দেশকে এই মেলাতে সম্মানিত অতিথির মর্যাদা দেওয়া হয়। গত বছর জর্জিয়া সম্মানিত হয়েছিল। এ বছর হতে যাচ্ছে প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের দেশ নরওয়ে, প্রতিপাদ্য ‘যে স্বপ্ন আমরা বহন করি’। নির্বাচিত দেশটির জন্য বিশেষ কিছু সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে, যেমন—বিশেষ প্রদর্শনী হল, দেশটির সাহিত্যকর্ম থেকে পাঠ, নাটক, পাঠকদের আলোচনা, ওই দেশটির শিল্পকর্ম প্রদর্শনী, টেলিভিশন ও রেডিও অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এশিয়ার জাপান, চীন, কোরিয়া ও ভারত আগে এই মর্যাদা পেয়েছে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা

এ ছাড়া ১৯৫০ সাল থেকে ২৫ হাজার ইউরো অর্থমূল্যের একটি শান্তি পুরস্কার এতে ঘোষিত হয়। ২০১৭ সালে কানাডীয় সাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড তাঁর সাহিত্যকর্মে ‘মানবতা, ন্যায়বিচার ও সহিষ্ণুতা’র বৈশিষ্ট্যের জন্য এ পুরস্কারে ভূষিত হন।

একই সঙ্গে সবচেয়ে অদ্ভুত শিরোনামের বইকেও পুরস্কৃত করা হয়। এ বছর প্রথম একটি জার্মান ভাষার বই পুরস্কারটি বাগিয়েছে, যার নাম দ্য জয় অব ওয়াটার বয়লিং।

সূত্র: ইজিপ্ট টুডে, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি নিউজ