নির্বাসিত সময় কিংবা জীবনের পুনরুত্থান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
>ঠান্ডা জার আর সারা দিনের অভুক্তিতে কাঁপতে কাঁপতে দরজার হুড়কো খোলে সূর্য বেওয়া। আর খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তেড়ে এল একটি উত্তুরে হাওয়ার চাবুক। ধারালো চাকুর মতো তার হাড়-মজ্জায় আঘাত করল। অস্ফুট স্বরে ককিয়ে উঠল সূর্য বেওয়া। খুব সাবধানে উঠোন পেরিয়ে ও ঘরের দিকে গেল। আলো নেই সেখানেও। গাঢ় অন্ধকারেও ঘর ভেংচি কেটে সূর্য বেওয়াকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ও ঘরের বন্ধ দরজায় রুগ্‌ণ হাতে ধাক্কা দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। জীবনের সত্যিটা আজ তাকে নিজের বাড়িতেই সম্পর্কহীন করে দিয়েছে। শীতের শুকনো উঠোন, বদ্ধ জলার ডোবা, ঘরের পাশের ঝোপ আজ তাকে নির্বাসন দিতে চাইছে। আর ও ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষটি যেন সবার আগে সূর্য বেওয়াকে পরিত্যাগ করল।

কান পেতে শব্দটা বোঝার চেষ্টা করে সূর্য বেওয়া। বাতাসে পাতা ঝরার শব্দ কিংবা টিনের চালে গাছের পাতা থেকে চুইয়ে পড়া হিমের শব্দ। সকল শব্দেই সূর্য বেওয়া সচকিত হয়ে উঠছে আজ।

আজ প্রায় সারা দিনই সূর্য বেওয়া শব্দ আন্দাজ করে চলেছে। শীতের শুরু এখন। উত্তুরে হাওয়া বিরাম দিয়ে দিয়ে ঘরের চালে আশ্রয় পাতা ইউক্যালিপটাসগাছের ডালে আজ সারা দিন ঝাপটা দিয়ে গেল। ইউক্যালিপটাসের সে হুটোপুটি বিকেলের পরে থেমে গেল। স্তব্ধতা তবু এল না। সে সময়ের গাজুড়ে সূর্য বেওয়ার বুকের শ্বাস কলরব করে গেল। এরপর সন্ধ্যার আগ দিয়ে ‘আয় আয়’ ডাকে ছিলছিলে পানি জমা ডোবা থেকে বাড়ির হাঁসগুলো ‘প্যাঁক প্যাঁক’ শব্দে চারপাশ মুখর করে খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকল।

ঘরের পাশে আধমরা হলুদ হয়ে আসা লতাগুল্মের জঙ্গলে একটি কুকুর অনেকক্ষণ একঘেয়ে কেঁদে কেঁদে একটু আগেই থামল। এরপরই চারপাশের সব শব্দ থেমে গেছে। আর তারপর থেকেই সূর্য বেওয়া অপেক্ষায় আছে একটি শব্দের। টুপ করে শুকনো পাতায় শিশির পড়লে বা বাতাসে একটা-দুটো পাতা খসে পড়লে সে চকিত হয়ে উঠছে প্রতীক্ষিত একটি পদধ্বনির জন্য।

এমন বিবর্ণ নিস্তব্ধতা এ বাড়িতে আগে কোনো দিন দেখেনি সূর্য বেওয়া। রাত কিংবা গভীর রাতেও এ বাড়ির বাতাসের পরতে শব্দ আশ্রয় নিত। সূর্য বেওয়ার এই ঘরের পেছনে বেশ কিছু ফসলি জমি পেরিয়ে বিশ্বরোডের একটা আবছা ছায়া দেখা যায়। অনেক দূরের সে রাস্তা দিয়ে বাস-ট্রাক গেলে গোঁ গোঁ আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা চুরি হয়ে যায় এ বাড়ির। আজ সে আওয়াজও এ বাড়ি এড়িয়ে যাচ্ছে। নাকি রাত এখনো গভীর হয়নি?

একটি পদধ্বনির জন্য সূর্য বেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই উৎকণ্ঠায় পরিণত হলো। সারা দিনে একবারের জন্য এ ঘরের সামনের পইঠায় কেউ এসে দাঁড়ায়নি। আর কেউ না এলেও আধভাঙা নড়বড়ে দরজার ওপাশে একজন এসে দাঁড়াবে, জংধরা করাতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে নিচু গলায় বলবে—
‘ঘুমাইছ?’
এখনো কেন এল না সে? সূর্য বেওয়ার বুকের ভেতর দুরুদুরু করে। কুকথা ভিড় করে মনের ভেতর।
বাড়ির পেছনে ফসলি জমিতে বাতাস হু হু করে পাকা ধানের ঘ্রাণ মেখে ছুটছে।

এবার শীত তাড়াতাড়িই চলে এল। পৌষ পড়তে না পড়তেই গাছের মাথায় মাথায় কুয়াশার কুণ্ডলী জমতে থাকে।
সে বছরও এমন কুয়াশার কুণ্ডলী জমে থাকত গাছের মাথায় মাথায়। উত্তুরে হাওয়া সে বছর দেশটিকে বিবর্ণ করে দিয়েছিল। দেশ যতই বিবর্ণ হোক, সূর্য বেওয়ার আব্বার জমিতে সে বছর রোদ হেসেছিল। জমির সে রোদের আঁচ লেগেছিল সূর্য বেওয়ার শরীরেও। সারা রাত শিশিরে ধুয়ে পাকা ধানের শিষ সকালের রোদে সোনারং ছড়াত। তেমন করে সোনারং ছড়াত সূর্য বেওয়াও।

কিন্তু সে রোদ, সে সোনারং মিশমিশে কালো রঙের কাদায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সোনারঙের ধানখেত নির্মম রুপালি কাস্তে দিয়ে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ওরা। ফসলহীন ন্যাড়া মাঠের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার বুকের ভেতর পাড়ভাঙার আগেই সূর্য বেওয়াকে পালাতে হয়েছিল। নিজের সোনারং ঢাকতে কালচে কাদার তলায় লুকোতে হয়েছিল তাকে। লুকিয়েও লাভ হয়নি, সূর্য বেওয়াকে লম্বা ঠোঁটের সারি সারি সারস ক্ষতবিক্ষত করেছিল সেই বছর, সেই শীতে।

সে ক্ষতে কুয়াশা মেখে নিথর হয়ে গিয়েছিল সূর্য বেওয়া। সংকুচিত শীতের দিন আর সংকুচিত নিজেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল সবুজ বিলুপ্ত হওয়া কালো কাদা আর সারসের দেশ থেকে। আব্বা তাকে নিয়ে চলে এসেছিল আরও উত্তরে। নিজের গ্রাম আর সেই ন্যাড়া খেতের দীর্ঘশ্বাস পেছনে ফেলে সূর্য বেওয়াকে আব্বা এগিয়ে দিয়েছিল নতুন সময়ের দিকে। ধূসর হাওয়া আর ঘাসপাতার ফ্যাকাশে রঙের প্রলেপ মেখে সে ক্ষত লুকিয়ে ফেলেছিল সে অনন্তকালের জন্য। তবে সূর্য বেওয়ার মনে সেই দিনের ছবিটা সব সময়ই পুঙ্খানুপুঙ্খতায় সজীব ছিল।

তবে শুধু সজীব বললে তার সত্যতা পুরোপুরি আসবে না। বরং বীভৎস সেই ছবি মনের কোথাও অহংকারের আলোও ছড়াত। শুধু মৃত আব্বাকে দেওয়া কথার জন্য সে আলোয় এত দিন পর্দা দিয়ে রেখেছিল সূর্য বেওয়া। সেদিনের উড়ুক্কু হাওয়ায় গাছের কয়েকটি পাতার সঙ্গে সে পর্দাও উড়ে গেছে বা বলা চলে পর্দাটা উড়িয়ে দিয়েছে সূর্য বেওয়া।
কয়েক মাস আগে, তখনো হেমন্ত আসেনি, জমির মাটি তখনো কুমারী। গ্রামের সবাই ভারী বর্ষণের অপেক্ষায়। শুকনো জমির যৌবনবতী হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
ঘরের পেছনে জংলা-ঝোপের পাশে বসে ছিল সেদিন সূর্য বেওয়া। নির্জন কুমারী জমির ওপর দিয়ে কয়েকটা বক উড়ে গেল। আর তারপর একটি একাকী শালিক। সে এসে বসল সূর্য বেওয়ার পাশে।
‘অরা তোমার লগে দেখা করবার চায়।’
‘কারা?’
‘একখান বছরের কথা, তোমার কথা জানবার চায় অরা।’
সূর্য বেওয়ার মাথার ওপর দিয়ে পায়রাগুলো উড়ে বাড়ির দিকে আসে।
এরপর বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতা মাড়িয়ে কতগুলো পায়ের সঙ্গে সেই দিনটি ফিরে এসেছিল। ওরা বলছিল সে বছর, সে দিন, সেই শীত, সে খেত, ভয়, আত্মরক্ষার চেষ্টা, ফসল পোড়া মৃত মাঠ, খড়ের গাদা, স্কুলঘর, আর্তচিৎকার, ক্ষতবিক্ষত সময়। সূর্য বেওয়ার মনের দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ছবি অবিকল ওরা সামনে ধরল। খোলা চোখেও একের পর এক সব দেখতে পাচ্ছিল সূর্য বেওয়া। নতুন রঙে রং করা ছবির মতো টাটকা। সে সময়ে যা ছিল মানুষ কিংবা সারস, শঙ্খচিল বা বেয়নেট সবকিছুই যেন সূর্য বেওয়ার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

উঠোনে মানুষের ভিড় কমেছিল ওরা চলে যাওয়ার পর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোলাটে কুয়াশার আস্তরণে কমলালেবুর মতো রোদ ফুটেছিল। কিন্তু উঠোনের এক কোণে তার আশপাশে কুয়াশা জলো অন্ধকার করে রেখেছিল। মাথা নিচু করে বসে ছিল সে। সূর্য বেওয়া নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শীত আর বয়সের মেলবন্ধনে রুক্ষ আর শিরা ফুলে ওঠা হাত তার শরীরে ছোঁয়াতেই সে আড়ষ্ট হয়েছিল। এরপর আর সেখানে দাঁড়ায়নি সূর্য বেওয়া। ফিরে এসেছিল নিজের জীর্ণ ঘরে।

ফসল কাটা মৃত মাঠের মতো কঠিন হয়ে উঠল সূর্য বেওয়ার জীবন এরপর। শরতেই তার জীবনে হুড়মুড় করে জার এসে পড়ল।

‘সবকিছু অস্বীকার করা লাগব’, ‘মাইয়াডার কপাল খাইবা তুমি’, ‘সমাজ আমাগোরে ত্যাগ করব’, ‘এই বয়সে এত শরমের কথা ক্যামনে মুখে আনলা’
কত রকম শব্দ! সূর্য বেওয়ার সারা শরীরে শব্দের কালশিটে পড়ে। সে বছরের ক্ষত লুকিয়ে ফেললেও এই কালশিটে কোনো কিছুতেই লুকোতে পারে না সে।
সূর্য বেওয়া এ কয় মাসের বীভৎস আর বর্বর আঘাতগুলো সামলে নিতে পারলেও আজকের সকালের তীব্র আঘাতে অবশ আর অসাড় হয়ে গেল।
‘আইজক্যার মইধ্যে অগোর কথা অস্বীকার করতে হইব। এরপর কাগজে-কলমে সবকিছু পাকা হইয়া যাইব। এরপর কিন্তুক আমি তোমারে অস্বীকার করুম।’
এই শব্দ কয়টা ছাড়া এ বাড়ির সকালে আর কোনো শব্দ ছিল না। কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে গিয়েছিল সারা বাড়ি। আর সূর্য বেওয়া বন্দী করে নিয়েছিল নিজেকে অন্ধকারে।
আজ সারা দিন এভাবেই কেটে গেছে তার। ঘরের ভেতর থেকে শুনেছে কত রকম শব্দ। বিবশ মনে প্রতীক্ষা করেছে একটি শব্দের, একটি পদধ্বনির।
কিন্তু যে শব্দের জন্য সে অপেক্ষায়, তা এখনো এল না।

ঠান্ডা জার আর সারা দিনের অভুক্তিতে কাঁপতে কাঁপতে দরজার হুড়কো খোলে সূর্য বেওয়া। আর খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তেড়ে এল একটি উত্তুরে হাওয়ার চাবুক। ধারালো চাকুর মতো তার হাড়-মজ্জায় আঘাত করল। অস্ফুট স্বরে ককিয়ে উঠল সূর্য বেওয়া।

খুব সাবধানে উঠোন পেরিয়ে ও ঘরের দিকে গেল। আলো নেই সেখানেও। গাঢ় অন্ধকারেও ঘর ভেংচি কেটে সূর্য বেওয়াকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ও ঘরের বন্ধ দরজায় রুগ্‌ণ হাতে ধাক্কা দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। জীবনের সত্যিটা আজ তাকে নিজের বাড়িতেই সম্পর্কহীন করে দিয়েছে। শীতের শুকনো উঠোন, বদ্ধ জলার ডোবা, ঘরের পাশের ঝোপ আজ তাকে নির্বাসন দিতে চাইছে। আর ও ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষটি যেন সবার আগে সূর্য বেওয়াকে পরিত্যাগ করল।

উত্তর দিক থেকে আসা ঝাপটায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অবশ দেহ টেনে টেনে নিজের ঘরে আসে সূর্য বেওয়া। অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকে। ঘস ঘস শব্দ হয়। একটি ইঁদুর দৌড়ে গেল সূর্য বেওয়ার গা ঘেঁষে। এরপর আরেকটি ইঁদুর। ঘরজুড়ে কয়েকটি ইঁদুরের অতর্কিত দৌড়াদৌড়ি। সূর্য বেওয়া নিশ্চিত হলো, ইঁদুরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সে-ও আজ পরিত্যাজ্য।
পরদিন সব মিডিয়ায় খবর ছড়াল, ‘পঞ্চগড়ের সদ্য স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীরাঙ্গনা সূর্য বেওয়া আত্মহত্যা করেছেন।’

কুয়াশার কুণ্ডলী বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়নি এ বাড়িতে। ধোঁয়াটে সে আস্তরণ ভেদ করে কয়েক দিন পরই সূর্য বেওয়ার বাড়ি অজস্র আলোয় ভরে উঠল। বাতাসে বাতাসে অজস্র শব্দের গুঞ্জন এ বাড়ির আকাশে সুর তুলল। এ সুরের নাম জীবন, বেঁচে থাকার চিরকালীন আবেদন।

মৃত বীরাঙ্গনা সূর্য বেওয়ার একমাত্র সন্তান রহমালি সেদিন লজ্জায় মাকে পরিত্যাগ করলেও মায়ের কোটায় পাওয়া সদ্য স্কুলের চাকরিটা কোনো দিনই পরিত্যাগ করতে পারেনি।