মর্জিনা খাতুনের অষ্টপ্রহর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এখন আর ঝিম মারা দুপুর কই? স্বামীদের ভরপেট খাইয়ে কর্মস্থলে বিদায় দিয়ে বউ–ঝিরা গায়ে নুন, হলুদ আর লাকড়ি পোড়ানো ধোঁয়ার রান্নার গন্ধ মেখে গায়ে আলস্য জড়িয়ে ঘুমাবে। কানের কাছে রেডিওতে এন্ড্রু কিশোর গাইবে, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে, মন যেখানে হৃদয় যেখানে...।’ বাচ্চারা পা টিপে বাইরে সাথিদের সঙ্গে খেলার মাঠে যাওয়ার ফুরসত খুঁজবে আর মফস্বলের অফিসপাড়ায় হাই তুলতে তুলতে অবসন্ন হাতে ফাইলের পাতা উল্টাবে সফল কিংবা অতৃপ্ত পুরুষেরা। শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত বছরের পুরোনো বটের ছায়ায় রিকশা রেখে তাতে বসে ঝিমুবে শ্রান্ত রিকশার চালক আর বেকার যুবকেরা বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে বাজারের চাতালে বসে তাস পেটাবে। দোকানগুলোতে খদ্দের থাকবে না আর দোকানিরা সেই সুযোগে ঢুলে পড়বে ঘুমে। না এখন সেই দুপুর নেই।

এই দুপুরে মর্জিনা খাতুন দেখে সামনের রাস্তায় ইজিবাইক আর রিকশার উপচেপড়া ভিড়। কে কার আগে যাবে তার অস্থির প্রতিযোগিতা। সেগুলোতে গন্তব্যের উদ্দেশে বসা মানুষগুলোরও অবসর নেই। যেন এখনই সব জরুরি যোগাযোগ সেরে না নিলে পৃথিবীর আহ্নিকগতি–বার্ষিকগতি থেমে যাবে। মোবাইল ফোন কারও কানে, কারও হাতে। সবাই ব্যস্ত। গলির মোড়ে খুচরা মাছ, সবজিঅলাদের লম্বা লাইন। এই উৎপাত ইদানীং শুরু হয়েছে। রাস্তা বন্ধ করে এই ভরদুপুরে ভিড় করে কিনছে মানুষ। আসতে–যেতে পথচারীদের অসুবিধা হলে কার কী! এই কেনাই আসল, এই বেচাই আসল। এ শুধুই কেনাবেচার যুগ।

সে নিজেও ফিরেছে এই ভিড় ঠেলে। মাথার ওপর খুলে রাখা ছাতার ভেতর শিকে ঝুলে দেখেছি আমি। দেখে যাচ্ছি গত কয়েক মাস ধরে। আমি আসলে তার মায়ায় পড়ে গেছি। রান্নাঘরের মিটসেফ কিংবা বইয়ের তাকের স্বসমাজ ছেড়ে আমি গত কয়েক মাস যাবৎ একটা লোহার শিকে ঝুলে তার সঙ্গে লেগে আছি। লেগে আছি আর টের পাচ্ছি আমাদের দুজনের জীবনপ্রবাহ এক–অভিন্ন অভিযোজন ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী জীবন নিয়ে মিশে আছে একবিন্দুতে।

ঠক ঠক ঠক গেটে কেউ ডাকে। কলবেলের শব্দের যুগে পাড়ায় তাদের বাড়িটাতেই এখনো কড়া নাড়ার ঠক ঠক। চোরাপথ, গলিপথ, রোজগারের নানা ধান্দা করেও তরিকুল ইসলাম নিজের বাড়িটাকে আশপাশের বাড়িগুলোর মতো সম্ভ্রান্ত করে তোলার সুযোগ পায়নি। জায়গা কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু শুধু করতে পেরেছিল।

এই দুপুরে কে ঠক ঠক করে মর্জিনা খাতুন জানে। ছেলেটা। এই বাড়িতে এক কড়া ঠকঠকায় ছেলে আর বাড়ি বন্ধক নেওয়া জমিরুদ্দিন মিয়া। সে আসে বিকেল বিকেল। নির্দিষ্ট সময় অন্তর এসে চা-পান খেয়ে মর্জিনা খাতুনের শরীর–স্বাস্থ্যের খবর জানতে চায়, জানতে চায় প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত খায় কি না, সুগার শেষ কবে মেপেছে, তারপর পরামর্শ দেয় আর্থ্রাইটিসের ব্যথার জন্য পেইনকিলার যত কম খাওয়া যায় ততই মঙ্গল। তারপর নরম সুরে হিসাবটা জানিয়ে যায়। যে হারে সুদ জমছে বাড়ি দখল নিতে আর কয়েকটা মাস মাত্র! তার সুরে পেশাদার চাতুর্য। যেন এই শরীর–স্বাস্থ্যের খবর নেওয়াটাই মুখ্য উদ্দেশ্য তার। বাড়ি দখল নেওয়ার সময়ের হিসাবটা গৌণ।

শরীরের ঘাম শুকায়নি এখনো মর্জিনা খাতুনের। জেলা অ্যাকাউন্টস অফিসে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে মাত্রই হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। আজও চেকটা হাতে আসেনি। ছেলের মুখোমুখি হতে ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করে। ছেলেটা ঢুকে অকারণেই বারান্দায় রাখা মোড়াটায় গায়ের জোরে লাথি মারে। মোড়াটা গড়িয়ে গড়িয়ে ছাতায় হুমড়ি খায়। ছাতার ভেতরে শিক ধরে ঝুলে থাকা আমি দৌড়ে পালাই। এই ছেলেটিকে আমিও খুব ভয় পাই, মর্জিনা খাতুনের মতো। ভয়ে আমি পালাতে পারি, মর্জিনা খাতুন পারে না। তার পালানোর জায়গা নেই। প্রতিদিন ছেলেটা ঘরে ঢুকেই কাপ ভাঙে, প্লেট ভাঙে, গ্লাস ভাঙে। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। সে বাড়ি ফিরলে মর্জিনা খাতুনের সঙ্গে আমারও বুকটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে।

টাকাটা পেয়েই তাকে দিয়ে দেবে এমন আশ্বাসে ছেলেটা বিশ্বাসও করে না, ভরসাও করে না। এই অবিশ্বাস আর ভরসাহীনতা তার নিজেরই অন্তর্জাত। নিজের চরিত্র বিশ্লেষণে সে বোঝে, এত্তগুলো টাকা পেলে সে হাতছাড়া করত না। কাজেই মর্জিনা খাতুন হাতছাড়া করবে এ ভরসাটুকু নেই তার। হোক গর্ভধারিণী মা। মানুষ আসলে অন্যকে যাচাই করে নিজেকে দিয়েই। সে নাড়ি ছিন্ন করা জননী হোক কিংবা আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু। নিজেকে জানার গণ্ডি ভেঙে অন্যকে চিনতে পারার শিক্ষা নেই তার। বিশ্বাস আর ভরসাহীনতায় সে প্রতিদিন গালাগালি করে মর্জিনা খাতুনকে, এত দেরি হয় পেনশনের টাকা পাইতে! কারে শিখাস তুই! আমার সঙ্গে চালাকি করছ? মর্জিনা খাতুন ছেলের মরা বাপের দিব্যি দেয়। কী হয় তাতে! বাপের চুরি-চামারি, আরা কথায় কথায় মাকে চড়–থাপ্পড় মারা দেখে বড় হয়েছে সে। মরা বাপের দিব্যি চুল পরিমাণ আবেদনও রাখে না তার উদ্দেশ্য হাসিলের ধান্দায়। বরং পাল্টা চোখ রাঙায়, চেক পাইছস কি না খবর নিতে আমার পাঁচ মিনিট লাগব। হাছা কথা ক... ছেলে গজরাতেই থাকে। সিস্টেমের দীর্ঘসূত্রতা, ছেলের স্বভাবজাত অবিশ্বাস আর ভরসাহীন চেঁচানোর মাশুল দিতে দিতে এভাবেই তার শ্রান্ত দুপুরগুলো প্রায় প্রতিদিন অবসন্ন বিকেল পেরিয়ে অলস সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে যায়।

সম্প্রতি ছেলের চেঁচানোতে নতুন যুক্ত হয়েছে মেয়ের প্রসঙ্গ। স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটার। শহরে চেহারা দেখানো যায় না বদনামে। ভাইয়ের ভয়ে বাড়ি বয়ে কাউকে নিয়ে আসে না বটে, কিন্তু যখন তখন ছেলেদের মেসে যায়। আশপাশের সবাই দেখে। মেয়ের এই বখে যাওয়ার দায়ও মর্জিনা খাতুনের ওপরই বর্তায়। নিশ্চয়ই এ তারই দোষ। মেয়েটাকে যথেষ্ট শাসনে রাখতে পারেনি সে। অবশ্য চেষ্টাই তো করেনি কোনোদিন। হোক জন্মদাত্রী। ছেলেমেয়ে কাউকেই শাসন করার ধৃষ্টতা ছিল নাকি তার! তরিকুল ইসলাম একচ্ছত্র অধিপতি ছিল সংসারের। তার ইচ্ছায় এ সংসারে যেমন তেল-নুন আসত, তেমনি সেসহ ছেলেমেয়েরাও নড়ত–চড়ত। তার অবর্তমানে ছেলেমেয়েদের শাসন করতে হবে, তার না আছে এমন প্রস্তুতি, না আছে ক্ষমতা!

ছেলে বাড়ি ফিরলেই মর্জিনা খাতুন দুরুদুরু বুকে নিত্যদিন তটস্থ থাকে তার চাওয়ামাত্র সব হাজির করার প্রস্তুতি নিয়ে। আমার জীবনের দুরুদুরুটা তার সঙ্গে যুক্ত হলো সেদিন থেকে, যে দিন মো. তরিকুল ইসলাম, সরকারের উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান সহকারী, আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে বরখাস্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। আর ফিরেই বড় কর্তাদের সামনে হেনস্তা হওয়ার ক্ষোভ ঝাড়তে থাকল সে পুত্রকন্যার সঙ্গে। রাবণের গোষ্ঠীর খোরাক জোগাতে গিয়ে আজ তার এই অবস্থা। মর্জিনা খাতুন শুধু একবার উত্তর করেছিল, ‘আমি কি তোমার কাছে কুনুদিন কিচ্ছু চাই?’ বলামাত্রই গালে ঠাস করে এক চড়। এমন চড় খাওয়া মর্জিনা খাতুনের অভ্যাস। চড়ের সঙ্গে অভিযোজিত হয়েই তার জীবন। বিয়ের পর থেকেই তরিকুল ইসলাম সুযোগ পেলেই ঠাসঠাস চড় মারে মর্জিনা খাতুনকে, বেশি রেগে গেলে একই সঙ্গে চলে লাথি–কিলও। আজকেও সে একটা চড় মেরে রাগ উপশমের সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। কথাটা না বললেই বরং তার রাগ আরও বাড়ত। মর্জিনা খাতুন কথাটা বলে চড় মারার সুযোগ করে দিয়ে তাকে রাগ কমানোতেই সাহায্য করে।

প্রতিবার চড় খেয়ে মর্জিনা রান্নাঘরে ঢুকে ধোয়া হাঁড়ি–পাতিল আবার ধোয়। ঘষে ঘষে চুলা পরিষ্কার করতে গায়ের সব জোরের সঙ্গে ঝেড়ে দেয় অসুখী-অপদস্থ জীবনের আক্ষেপ আর আঘাতের শারীরিক–মানসিক যাতনা। ঝাড়ু দিয়ে তেলাপোকাদের বংশ ধ্বংস করে সে মাথার ওপর ঝুল ঝাড়তে গিয়ে মাকড়সাদের পিষে মারে। নির্বোধ কীটদের অসহায় মৃত্যু তাকে একরকম শক্তি দেয়, নিজের বেঁচে থাকার টিকে থাকার শক্তি।

সেদিনও সে এই কাজটি করছিল, ঝাড়ু দিয়ে হত্যা করছিল রান্নাঘরের নেট ভাঙা মিটসেফ থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া সব তেলাপোকা। মাঝ থেকে ভাগ্যক্রমে এক ফাঁকে আমি বেঁচে দলছাড়া হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম ঘরের কোনায় মাটির ফিল্টারে ঠেস দিয়ে রাখা ছাতাটার ভেতরে। আমি তখনো দুধের মতো সাদা ফুটফুটে একটা বাচ্চা। অতঃপর বড় হই আর তাদের পরিবারের সদস্যদের পরস্পর কথাবার্তায় জানতে থাকি, তারও আগে যেদিন তরিকুল ইসলাম বাজারের ব্যাগে কয়েক প্যাকেট অফসেট কাগজ, প্রিন্টারের কালি এনে বাজারে বিক্রি করতে গিয়েছিল সেদিনও—‘এই হারামের টাকা পোলাপানরে খাওয়াইবেন’ বলে সে থাপ্পড় খেয়েছিল। জানতে থাকি, তারও আগে কনট্রাক্টর দুই নম্বরি বিল পার করিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ি বয়ে টাকা দিয়ে গেলে ‘আপনে জাইন্যা–শুইন্যা নদীর পাড়ের মানুষগুলার মরণ ডাইক্যা আনলেন’, বললে তরিকুল ইসলাম তার গলা টিপে ধরেছিল। সে মরেনি, টিকে গেছে। জানতে থাকি এই মর্জিনা খাতুন বাপের সংসার থেকে স্বামীর সংসার, স্বামীর সংসার থেকে ছেলের সংসার—সর্বত্রই সে নিত্য আমার মতোই টিকে থাকা প্রাণী। শুধুই টিকে থাকা। কোথাও কোনোদিন নিজের অস্তিত্ব ঘটা করে জানান দেওয়ার বোধই নেই তার।

যেমন আমরা মানে আমাদের প্রজাতি টিকে আছি মিলিয়ন বছর ধরে, অথচ অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তেমনি সেও টিকে আছে। স্বামীর চড়–চাট্টি খেয়ে, ছেলের গোঁয়ার ক্রোধের আস্ফালন সহ্য করে। অস্ফুট চোখ দিয়ে আমি দেখি একটি পরিবারের ভেতরে বাইরে কত বিচিত্র রূপের সঙ্গে অভিযোজিত তার টিকে থাকা। থাপ্পড় খেয়ে হজম করে আগের জীবন, ছেলের উন্মত্ত খেঁকানি খেয়ে পরের জীবন, সংসারে দাঁত কামড়েই পড়ে থাকে সে। আমার মতোই। ঝাড়ুর বাড়ি থেকে বাঁচার পর আমি যেমন কতদিন ছেলেটার পায়ে পিষ্ট হতে হতে হইনি! মেয়েটার পাপোশের ঝাড়া খেয়ে দিব্যি আধ ঘণ্টা পা উল্টে শুয়ে থেকে আবার ছাতার ভেতর লুকিয়ে গেছি! বেঁচে গেছি। ঠিক মর্জিনা খাতুনের মতো সংসারে টিকে গেছি।

>শরীরের ঘাম শুকায়নি এখনো মর্জিনা খাতুনের। জেলা অ্যাকাউন্টস অফিসে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে মাত্রই হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। আজও চেকটা হাতে আসেনি। ছেলের মুখোমুখি হতে ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করে। ছেলেটা ঢুকে অকারণেই বারান্দায় রাখা মোড়াটায় গায়ের জোরে লাথি মারে। মোড়াটা গড়িয়ে গড়িয়ে ছাতায় হুমড়ি খায়। ছাতার ভেতরে শিক ধরে ঝুলে থাকা আমি দৌড়ে পালাই। এই ছেলেটিকে আমিও খুব ভয় পাই, মর্জিনা খাতুনের মতো। ভয়ে আমি পালাতে পারি, মর্জিনা খাতুন পারে না। তার পালানোর জায়গা নেই। প্রতিদিন ছেলেটা ঘরে ঢুকেই কাপ ভাঙে, প্লেট ভাঙে, গ্লাস ভাঙে। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। সে বাড়ি ফিরলে মর্জিনা খাতুনের সঙ্গে আমারও বুকটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে।

ছেলেটার ঝাড়ি খেয়ে অর্ধদিনের ক্লান্তি মুছে মর্জিনা ঢোকে রান্নাঘরে আর আমি মেয়েটার দরজার চিপায় ঘাপটি মেরে বসে থাকি। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে এই ভরদুপুর অবধি। ঘুমাবেই–বা না কেন! সারা রাত তার কীর্তি আমি দেখি। কিসের রাত, কিসের ঘুম। সারা দুনিয়া যখন ঘুমায়, মেয়ে তখন জাগে, নানান ভঙ্গিতে জাগে, একেক দিন একেক কিসিমে জাগে। একেক দিন একেকজনের সঙ্গে জাগে।

টেবিলে ভাত আর মলা মাছের সালুন সাজাতে সাজাতে মর্জিনা খাতুন কৈফিয়ত দেয়, ‘পাঁচ হাজার টাকা নগদ দিছি, তবু আজও কাজটা হইল না। ডিএও নাই। ঢাকাত গেছে ট্রেনিং করতো।’ ছেলেটা খাঁকারি দিয়ে উঠে। ‘আর কবে অইবো সুযোগখান হাত থাইকা ফইসকা গেলে!’ মর্জিনা খাতুন চুপ। স্বামী তরিকুলের চড়–থাপ্পড় খেয়ে তবু মুখ খুলত, ছেলেমেয়ের কাছে সে মূক। বধিরও খানিকটা। উত্তর দিতে গেলে কথা বাড়বে তো বটেই, গোঁয়ার ছেলে গায়ে হাত ওঠাবে না তারই–বা নিশ্চয়তা কী? মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলায় একদিন ঘুষি মেরে নাকে–মুখে রক্ত ছুটিয়ে দিয়েছিল মেয়েটার। ঘুষিগুলো যতটা মেয়েটার নাকে–মুখে পড়ছিল, ততোধিক তীব্রতায় টলটলায়মান অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল মর্জিনা খাতুনের। মর্জিনা খাতুন টের পেয়েছিল ডাইনে বাঁয়ে কয়েক ইঞ্চি ঘুরে ঘুষি তার নাকে–মুখে পড়তে সেকেন্ড লাগবে না। অনেক বছর স্বামীর চড়–থাপ্পড়, এমনকি গলা টিপে ধরা যদিও–বা সহ্য করতে পেরেছে, ছেলের চড়–থাপ্পড় বা অন্যকিছু হজম করার মতো মানসিক জোর আছে কি না, এ সম্পর্কে সে আত্মবিশ্বাসী নয়। তাই চুপ থেকে সব সময় নিজেকে আগলে রাখে সে, সময়মতো টাকা না পাওয়া নিজেরই দোষ মানে। সত্যি তো সুযোগ ফসকে গেলে টাকাগুলো পেয়ে লাভ কি!

সুযোগ মানে নেতার চেলা–চামুণ্ডাদের দলে ভিড়ে যাওয়ার সুযোগ। একসঙ্গে টাকা ইনভেস্ট করে ব্যবসা করার সুযোগ। তাদের অসীম দয়া। তারা প্রস্তাব দিয়েছে। তারা একেকজন নেতার ডান হাত, বাঁ হাত। তাদের পার্টনার হওয়ার লোকের অভাব? উচিত হলেও মর্জিনা খাতুনের কোনো ফুসরতই নেই বলার যে টাকাগুলো ভবিষ্যতের জন্য ফিক্সড করে রাখা উচিত! মর্জিনা খাতুনের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় না ছেলের হাতে তুলে দেওয়া বাড়ি বন্ধক রাখা কয়েক লাখ টাকার কোনো হদিসই নেই।

এখন আর রাত কই? দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক, নিঝুম নিস্তব্ধতায় সুনসান চরাচর, হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে পাতাগুলো ধাক্কা খাবে একে অপরের গায়ে, পরস্পর সেই ধাক্কা খাওয়ার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে কেমন নিঝুম নিস্তব্ধ করে তুলবে। একটা পাতা টুপ করে ঝরে পড়বে নিচে, কান পাতলে সেই পাতা ঝরার শব্দটা রাতের নীরবতাকে ডেকে আনবে আরও গহিন করে। দূরে কোনো নিমগাছের ডালে ডাকবে কানাকুয়ো। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই ডাক তীব্র ভয়ানক হাহাকার জাগিয়ে দেবে ঘুমন্ত পৃথিবীর না ঘুমানো কোনো মানুষকে।

এই রাতে মর্জিনা খাতুন দেখে মেয়ের ঘরের বন্ধ দরজার নিচ দিয়ে তীব্র আলো ছিটকে বেরোচ্ছে। মৃদু মিউজিকও কি বাজছে? মর্জিনা খাতুন বুঝে না কী চলে ঘরের ভেতরে। কাছে–ধারে কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসে টকশোয়ের তুমুল বিতণ্ডা। ডাকসু নির্বাচন কী জাতীয় নির্বাচনের মতো একতরফা হবে? সরকার কী ভূমিকা নেবে! নিস্তব্ধ হতে চাওয়া রাতকে কাঁপিয়ে একটা বাচ্চা একটানা কেঁদে চলে অনতিদূরে।

আমি চুপিসারে দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ি মেয়েটার ঘরে। শরীরে কাপড়চোপড় নেই, বিবস্ত্র মেয়েটা নানা অঙ্গভঙ্গি করছে মোবাইল ক্যামেরার উল্টো পাশে এক যুবকের সঙ্গে। প্রতিদিন এই কাজ। যুবকটিরও গায়ে কোনো কাপড় নেই। অন্য অনেক রাতের মতো সাক্ষী হয়ে আমি ফিরে আসি। মর্জিনা খাতুনের গিরায় গিরায় আর্থ্রাইটিসের ব্যথা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছেলের ঘরে উঁকি দেয়। দমবন্ধ ধোঁয়া আর অচেনা নেশাদ্রব্যের গন্ধে ঘর ভুরভুর করছে। ইয়ার বন্ধুদের দল ঘণ্টাখানেক বের হয়েছে। এবড়োখেবড়ো গ্লাস–প্লেট। ছড়ানো–ছিটানো ইস্কাবনের টেক্কা। অ্যাশট্রেভর্তি সিগারেটের মাথা। মর্জিনা খাতুন লাইটের সুইচ অফ করে আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে একটা মোটামুটি নির্বিঘ্ন দিন পার করার স্বস্তিতে। আমি লম্বা শুঁড় দুটো খাড়া করে গন্ধ শুঁকে শুঁকে রান্নাঘরের দিকে যাই, খাবারের উৎসমুখে।

পরদিন সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকাল—একটানা বসে থেকে তার সঙ্গে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাকাউন্টস অফিস ঘুরে ৩০ লাখ টাকার চেক নিয়ে ঘরে ঢুকলে আমি আন্দাজ করি আজ ঘরে শান্তি ফিরবে। রাস্তা পার হতে হতে, কানে হেডফোন লাগানো লাল চুলের ছেলেটাকে পাশ কাটাতে কাটাতে, নিউ বরকত লেদার স্টোর ঝাড়ু দেওয়া ধুলো বোরকায় এসে পড়লে ঝাড়তে ঝাড়তে মর্জিনা খাতুন ভাবে, বাসায় গিয়েই চেকটা তুলে দিতে হবে ছেলের হাতে। নিত্য এই অশান্তি থেকে মুক্তি চাই। ভবিষ্যৎ যেমনে চলবে চলুক।

অবিবাহিত তিন বোন ঘরে রেখে বাপ যখন মরল, তখন সে ভেবে আকুল হয়েছে, কী হবে তাদের। বোনগুলো যার যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাওয়ার মতো পথ খোঁজে নিলে সে নিজের কী হবে, ভেবে কত রাত বালিশ ভিজিয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছে। দুই মাসের পোয়াতি অবস্থায় তরিকুল ইসলাম বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারবে না জানালে ইঁদুর মারার বিষ খেয়েছে। তখনো বেঁচে গিয়েছে। টিকে গিয়েছে।

তরিকুল ইসলাম যেদিন চাকরি হারিয়েছে, সেদিনও সে সংসার কেমনে চলবে ভেবেছে, চাকরি যখন ফিরে পেয়েছে তখনো ক্লান্ত হয়েছে আবার কী করে বসে ভেবে। অফিসের সহকর্মী আবদুল মালেক যখন জানায়, তরিকুল হার্ট অ্যাটাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা গেছে তখনো সে ভেবেছে ভবিষ্যৎ কী হবে। পাওনা টাকাকড়ি আদায়ের জন্য অফিসে অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে সে ভবিষ্যতের কথাই ভেবেছে। ছেলেটার একটা আয়–রোজগারের ব্যবস্থা, মেয়েটার বিয়ে, বন্ধক দেওয়া বাড়িটা উদ্ধার!

ঘরে আজও পাড়া মাথায় তোলা চেঁচামিচি। হইচই, ধূসর হয়ে যাওয়া ড্রেসিং টেবিলের গ্লাস ভাঙা... কুড়ি বছর পুরোনো ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকা দেয়াল ঘড়িটা খানখান। মর্জিনা খাতুন সব ভাবাভাবি দূরে ঠেলে সিদ্ধান্ত নেয়, টাকার চেকটা চোখ বন্ধ করে ছেলেটার হাতে তুলে দেবে। অনেক ভাবা হয়েছে জীবনভর। আর না। যেভাবে পারে মেয়ের বিয়ের দেবে। বাড়িটা চলে গেলে বস্তিতে গিয়ে উঠবে, খাবার না জুটলে না জুটবে। আপাতত ছেলে রে শান্ত করা দরকার। নিত্য এই বুক ধড়ফড় করা তটস্থ জীবন আর ভাল্লাগে না। বুঝি এই প্রথমবার একটুখানি নিজের মতো হওয়ার সাধ জাগে তার। ভাঙা কাচ আর থেমে যাওয়া ঘড়ির কাঁটার মাঝে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এখন অনিশ্চিতের হাতেই সঁপে দেবে সে নিজেকে, ঝড়ের রাতে মধ্যসমুদ্রে পথ হারানো নাবিকের মতো হাল ছেড়ে দেবে। তাদেরও কেউ না–কেউ টিকে থাকে। সবাই সমুদ্রের অতলে নিখোঁজ হয়ে যায় না।

কিন্তু না। ঘরে ঢুকে আঁচ করে ঘরে ছেলের উন্মাদ চেঁচানোতে আজ অন্য অশান্তি। গ্লাস–প্লেট ভাঙায় সীমাবদ্ধ উন্মাদনা আজ ড্রেসিং টেবিলের আয়না আর দেয়াল ঘড়ি পেরিয়ে মেয়ের বন্ধ দরজায় দুমদুম লাথি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। রান্নাঘরের ধারালো বঁটি নিয়ে ছেলে বসে আছে মেয়ের বন্ধ দরজার সামনে, যেন পালিয়ে বেড়ানো রাতা মোরগ বের হলেই ধরে জবাই করার অপেক্ষায়। মর্জিনা খাতুনের হতভম্ব চেহারা দেখে সে চুপি চুপি নয়, গলা ফাটিয়ে জানান দেয় ঘটনা। মেয়ের উলঙ্গ ভিডিও শহরে ছেলেদের হাতে হাতে। মর্জিনা খাতুনকে কে চিনে, ছেলে চিৎকার করে, তোর আছেই কী, আর হারাবি কী! সত্যি তো বাপ চুরির দায়ে চাকরি হারিয়ে কুখ্যাত হয়েছে। পাঁচজনের কাছে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। মর্জিনা খাতুনকে চিনে কে। শহরে ছেলে নিজে একটুখানি ইমেজ তৈরির চেষ্টা শুরু করেছে মাত্র। নেতার পেছনে স্লোগান ধরে, সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে ব্যবসা করে জাতে উঠতে চাইছে। সাঙ্গপাঙ্গরা নির্বিবাদে গভীর রাত অবধি আসর বসানোর নিরাপদ স্থান পেয়ে ছেলেটাকে আপন করে নিয়েছে।

আর তখনই বোনের আবার এই কীর্তি। হয় আজ নিজে মরমু নয় তরারে মারমু। ছেলের উন্মাদ, বেহুঁশ, উন্মত্ততার কাছে নিজেকে অসহায় লাগে মর্জিনা খাতুনের। বঁটি নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে কতক্ষণ পরপর হুঙ্কার ছাড়ে সে, বের হ মাগি... ...।

হাই সুগার, হাই ব্লাডপ্রেসার আর আর্থ্রাইটিসের ব্যথা নিয়ে সারা রাত নির্ঘুম কাটে মর্জিনা খাতুনের। খুব কষ্ট হয় তার। কিন্তু সংসারে কে কবে বুঝতে চেয়েছে তার কষ্ট! আমিও এক প্রজাতি চুপচাপ দেখা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।

ভোরের দিকে চোখ দুটো একটু তন্দ্রামতো জড়িয়ে এলে হঠাৎ ছেলের এক চিৎকারে তন্দ্রা টুটে যায় মর্জিনা খাতুনের। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। চশমা ব্যাগ হাতড়ে বেড়ায়, যত্ন করে ব্যাগের ভেতরে ডায়েরির ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছে সে চেকটা। ছেলেকে জানানো হয়নি চেক পাওয়ার কথা, ঘরে ঢুকে বিকট পরিবেশে বলার সুযোগই পায়নি। গত কয়েক মাস এই ‘চেক-চেক’ ক্রম উৎপাতে গত রাতে ছেলের অন্য কারণের উন্মত্ততা প্রথমটায় মনেই পড়ে না তার। বোধ হয় চেকের জন্যই এই চিৎকার।

চেকটা হাতে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘর থেকে বের হতেই ছেলে হ্যাঁচকা টানে নিয়ে দাঁড় করায় মেয়ের ঘরের সামনে, মেয়েটা গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। মেয়ের মুখের দিকে ঠিকমতো তাকায় কী তাকায় না, মর্জিনা খাতুন দেখে ছেলেটার চোখ দুটো তীব্র লাল, যেন ফুঁড়ে–তেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কামানের অগ্নিগোলার মতো। জেগে থাকা ক্লান্তির সঙ্গে দুচোখে যুক্ত হয়েছে উন্মত্ত ক্রোধ। ‘বাড়িত গেছেই, এই মাগিও পথ দেখছে...’ ছেলেটা অনুচ্চস্বরে বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে। ‘তুই বাঁইচ্যা থাইক্যা আর কী করবি!’ উন্মত্ত ছেলের ধেয়ে আসা হাত দুটোর সামনে সে চেকটা তুলে ধরে, বারবার বলতে থাকে, ‘আমি নিয়ত করছিলাম বাপ, টাকাগুলো তরে দিয়া দিতাম...।’

এখন রাতের চেয়ে সকালটাই বরং বেশি নিঝুম। রাতজাগা মানুষের দিন শুরু হয় তখন, যখন প্রথম আলো লাল আবির রঙের পোশাক ছেড়ে দেয়। আগুনের হল্কার মতো কড়া হলুদের গাঢ়তা ছড়াতে শুরু করে তাপের তীব্রতার সঙ্গো পাল্লা দিয়ে। কোথাও ভোর হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে কুক্কুরুকু সুরে মোরগ ডেকে ওঠে না, তবে রাস্তায় রিকশা গাড়ির তেমন হুল্লোড় থাকে না। কাকগুলোর তারজাল-খড়কুটোর বাসাবাড়ি নেই কাছে–পিঠে, মোবাইল টাওয়ারের রশ্মি সব গিলে খেয়েছে। সমস্বরের কাকা আওয়াজ আর রাত পোহানোর বার্তা জানান দেয় না। আমি বুকে দুরুদুরু ছাতার শিকে ঝুলে থাকি মর্জিনা খাতুনের অপেক্ষায়। আমার মতোই তীব্র বাঁচার ক্ষমতা নিয়ে যদি জেগে উঠে আরেকটা সকাল দেখে!