নুরুন্নাহার শিরীন শিখাময় কৃতাঞ্জলি তথাপি তাহার বেদনার অধিক জলের ভার; কে কবে তাহার বেঁধেছিল এপার–ওপার, কে কবে হঠাৎ পাশে বসেছিল বলে ত্রিভুবনের বিভাজনের সুতো গেঁথেছিল জলে। হয়তো গাঁথুনি তত মজবুত নয় যত হলে জীবনের সাত খুন মাফ হয়; জীবন বহতা নদী ভাঙন থেকেও বহমানতায়— শুকনো ধারায় তিরতির বয়ে যায়। চেনাজানার বাইরে কিছু যায় ভেসে— অপ্রতিরোধ্য জলের ভাষায়। হৃতমৃত ঘাটলায় পড়ে রয় জলাঞ্জলির অন্তর্জলি অঙুলিতে রেখাময়। তখন আজন্মের সাধ্যাতীত সাধনা চুপ হয়, তখন স্বপ্নাদ্যের সাধগুলো নতনীল চুপ হয়।
লুনা রুশদী নেথানের উঠানে নেথানের ছেলেটা উঠানে খেলে। ওদের বেশ সাজানো সংসার। ছুটির দিনে জানালায় রোদ দেখা গেলে গোসল শেষে পরিপাটি নেথান, রোদে দেয়, ভিনিগারে ডোবানো জলপাইয়ের বয়াম। আমার জানালা থেকে দেখি ওদের জানালায় নেথানের ভেজা ভেজা আঁচড়ানো চুল, সাদাকালো সিনেমার ইংরেজ নায়কের মতন ঠান্ডা সুন্দর... বয়ামের দুই পাশে দুই হাতের পাতা যত্নে বিছায়ে থাকে যেন কেউ এখনই বলবে, ‘অ্যাকশন’, আর সাথে সাথে ঈষৎ ভারি কাচের বয়াম তুলবে সে, বয়ামের ভারটুকুও দেখা যাবে ধরার ভঙ্গিতে, আমিও দেখব জানালা থেকে। ওর উঠানে দুইটা শালিক ঘাস খায়। উঠানেই ঘুরেফিরে, বেড়ার ওপরে বসে, গাছের ডালে বসে ডানা ঝাপটায়। কাছাকাছিই থাকে কোথাও, পাতার আড়ালে, আকাশেও ওড়ে ঠিকই, পাখিরা উড়বে—এমনই নিয়ম যখন।
ভাবতেছি পাখিরাও কই আর এত বন্ধনহীন জন্মস্বাধীন? তাদেরও ঘর থাকে, থাকে পরিচিত ঘাসের উঠান ‘যে জীবন দোয়েলের ফড়িংয়ের...’ আলাদা কেমন আর? ভাসমান দেখায় যেমন ডানারা কী তেমনই নির্ভার? যেদিন বাতাস নাই, অথবা ঝড়ে সব নড়বড় করে উড়ান অসম্ভব সেই সব দিনে ঝাপটানো ডানাদের অবিরাম অবিরাম ভার, কীভাবে বহন করে দোয়েল ফড়িং কে যায় তাদের নিয়ে লাশকাটা ঘরে?
শেলী নাজ পুরুষহীন ঘর কদাকার পুরুষের ছায়া নেই, শূন্যতার সরঞ্জামে ভরা ঘর বিছানার যে পাশেই ফিরি, দেখি হুক খুলে ক্রুশকন্যার পানসি ভেসে চলে সীমানাহীন নিজের জরায়ু, মস্তিষ্ক থেকে আঙুল-ডগায়, অতঃপর নক্ষত্রের দিকে তুলে দেয় পাল উচ্ছন্ন মাংসকুচির মধ্যে নিত্য জন্মায় জীবন, জলমহাল
ছোট ছোট লণ্ঠনের শিখা, প্রহরাহীন, একা আহা রাত্রি কী কালো, এদিকে জমকালো সাজে উষ্ণ হচ্ছে ঘর, সকল শূন্যতা ফুঁড়ে জাগছে গম্বুজ আত্মপতাকায় সেজে, ইচ্ছেঢোলকে বাজছে কামনা, কঙ্কণ গভীর ঝরোকা মন, দরজা পেরিয়ে ঢোকে গোধূলিরেখা সেজে ওঠে শূন্যতার বীথিকায় পাতার ঘাগরা পরে আণবিক এক আসঙ্গলিপ্সার জ্বর সেরে ওঠে মরচেপড়া জড়োয়ায় দেখি মরে যেতে থাকা সূর্যের শেষাভা যখন গোধূলি তোমার নরম আলোর ফোয়ারা জানালায় ঝরে
আমার সকল শূন্যতা পরেছে ঘন আঙরাখা জৈব পৃথিবীর কান্না ও ক্ষত থেকে উড়ে যেতে পুরুষহীন যে ঘর, তার সবসময় থাকে দুইখানি পাখা!
সালেহীন শিপ্রা রৌদ্রগাঢ় প্রতীক্ষাহিম এখানে প্রেম রৌদ্রগাঢ়, প্রতীক্ষাহিম, হাওয়া-শিষে তুলকালাম এক প্রগলভতায় তোমার নাম বনমাধবীর নিজস্বতা, হসন্তময় একটু থামার ডুব-বসন্ত।
বাস স্টপেজে কম খরচের বকুল ঝরে— জেব্রা ক্রসিং পার হয়ে যায়, নোংরাজমা ফুটপাত ধরে মন খারাপ একটি মেয়ে একা হেঁটে যায়।
কতটা প্রেম তুলকালাম সে চোখ জানে কি? কতটা কাম, প্রসঙ্গত ঘুমের ঝিঁঝিট? মাঝবসন্তে শ্রাবণ-টানে হু হু হাওয়া বলছি শোনো— রূঢ় বাতাস তুমি গোলাপ মথিত করো না।
অলকা নন্দিতা আমি কোথাও নেই আমার দেড় যুগের কর্মজীবনে এক যুগই কাটিয়েছি দৌড়ের ওপর। বাকিটা রাস্তার জ্যাম আর বাকিটা মিছিল–মিটিংয়ে। সেন্ট মার্টিন থেকে পঞ্চগড়, রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহ পরিভ্রমণ করে অভিজ্ঞতার যে নুড়ি কুড়িয়ে এনেছিলাম, নিজের অজান্তেই তা বিলিয়ে দিয়েছি এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলের গেটে। অভিভাবকেরা আমাকে বিশেষজ্ঞ ভেবে নিত্য কদর করে, মান্য করে আমার আন্তরিকতায়।
আমার দেড় যুগের কথা জানে মোহাম্মদপুর ও ফার্মগেটের যাত্রীবোঝাই বাস। পুরোনো প্রতিবেশী। কখনো-সখনো তাদের সঙ্গেও করেছি অভিজ্ঞতা বিনিময়। আত্মীয় বানিয়ে দিয়েছি কোনো না কোনো স্মারক। নিজের সর্বস্ব দিয়ে পরকে করেছি আপন। দুর্দিনে দিয়েছি ভরসা।
দীর্ঘ অর্ধযুগ ধরে কোথাও যাওয়া হয়নি। না পাহাড়, না সমুদ্র, না মিছিল-মিটিং। কেবল স্কুল, অফিস, বাসা ছাড়া আমার যাওয়ার জায়গা নেই আর। শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়েছে আজ শব্দ আর বাক্যের প্রবহমান নদী। চর জেগেছে মনের সীমারেখায়। স্কুলপর্বও শেষ। অখণ্ড অবসরে ফিরে দেখি, আমি কোথাও নেই, পড়ে আছি সহস্রাধিক ইটের চাপায়।
শাফিনূর শাফিন নিয়তি পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর হারায়ে যায় এই তার নিয়তি। নইলে কবে কার গ্রিবার তিল দেখে দমবন্ধ কাতর হয়ে পড়ার কথা মনে পড়ে, হায়, এই অবেলায়! মানুষীরা বাজিয়ে চলে থেমে থেমে প্রেম–কাম আর ভেঙে পড়ার চুরমার হুইসেল। সেসব মন ভাঙার শব্দে তোমার কি মনে পড়ে যায় সংক্রান্তির তীব্র দাবদাহে পুড়ে ছাই হবার আগে শীতফেরত নীলকণ্ঠ পাখিদের আকাশে ডানার পায়ের ছাপ ফেলে রেখে যাওয়া দ্বিধা...
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে