গণশত্রুর স্ত্রী, গণশত্রুর মা

>

আন্না আখ্মাতোভা। রুশ কবিতার অন্যন্য এক কণ্ঠস্বর। এই নারী কবিকে নিয়ে আজও রয়েছে বিস্তর রহস্য।

শিল্পীর তুলিতে আন্না আখ্মাতোভা। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পীর তুলিতে আন্না আখ্মাতোভা। ছবি: সংগৃহীত

ভয় নেই পৃথিবীর কিছুতেই
কঠিন দীর্ঘশ্বাসে বিবর্ণ হৃদয়
শুধু রাত ভয়ংকর এ কারণেই হয়
স্বপ্নে তোমার চোখ, তাই পাই ভয়।

কবিতার পঙ্​ক্তিগুলো আন্না আখ্​মাতোভার। রুশ সাহিত্যের রুপালি যুগের সেরা কবিদের একজন তিনি। রুশ সাহিত্য ইতিহাসে পুশকিন থেকে দস্তয়েভস্কির সময়টাকে বলা হয় সোনালি যুগ। এরপরই আসে এই রুপালি যুগ। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে আবার একদল কবি, সাহিত্যিকের জন্ম হয়, যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন রুশ সাহিত্য।

আন্না আখ্মাতোভার জন্ম ১৮৮৯ সালে তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের ওদেসায়। ৬ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। খুব কম বয়স থেকেই তিনি কবিতা লিখতেন। বাবা তা পছন্দ করতেন না। তাই আন্না তাঁর পদবি বদলে নানুর মায়ের পদবি ‘আখ্মাতোভা’ নিলেন। মূলত তাঁর পদবি ছিল গোরেঙ্কো।

নিজেই নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি ছিলাম বন্য এক কিশোরী। খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম, যেকোনো আবহাওয়ায় নেমে যেতাম সাগরে, কাটতাম সাঁতার।’

পড়াশোনা করেছেন কিয়েভে আর পিটারবুর্গে।
২০ বছর বয়সে আন্না গিয়েছিলেন ইতালি আর ফ্রান্সে। সেখানে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আমেদিও মোদিলিয়ানির সঙ্গে দেখা হয়। মোদিলিয়ানি আন্নার একটি ছবি আঁকেন।

পড়াশোনা শেষে আন্না বিয়ে করেন নিকোলাই গুমিলিওভকে, কিন্তু বিয়েটা ভেঙে যায়। ১৯২১ সালে গুমিলিওভকে ‘তাগান ষড়যন্ত্র’–এর একজন বলে চিহ্নিত করা হয় এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁদের একমাত্র ছেলে লিয়েভ গুমিলিওভও অনেক বছর কারাবাসে ছিলেন। লিয়েভ খুব গুণী মানুষ ছিলেন। তিনি লেখক, অনুবাদক ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রশংসিত হন।
গুমিলিওভ আর লিয়েভকে গণশত্রু আখ্যায়িত করা হয়েছিল। একজন গণশত্রুর বউ বা একজন গণশত্রুর মা হিসেবে আন্নার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। বিশ শতকের বিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁর লেখা ছাপা বন্ধ করে দেয় সরকার। আন্না আখ্​মাতোভার অনেক লেখাই ছাপা হয় তাঁর মৃত্যুর পর। তাঁর অনেক কবিতাই বাড়ি বদলের সময় কিংবা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছে।

আখ্মাতোভার কবিতায় মজেছিল রাশিয়া ও রাশিয়ার বাইরের কবিতাপ্রিয় মানুষ। ১৯৩৯ সালে তাঁকে সোভিয়েত লেখক ইউনিয়নের সদস্য করে নেওয়া হয়। ১৯৪৬ সালে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়, পাঁচ বছর পর আবার তাঁর সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধের শুরুতে লেনিনগ্রাদ থেকে কবিকে সরিয়ে নেওয়া হয় মস্কোতে। এরপর কাজান আর তাসখন্দে। বিজয়ের পর তিনি ফিরে আসেন লেনিনগ্রাদে।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আবার কবির কবিতা ছাপানোর অনুমতি মেলে। মৃত্যুর আগের বছর ১৯৬৫ সালে আন্না আখ্মাতোভা ইংল্যান্ডে যান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়।

তিনবার বিয়ে করেছিলেন তিনি। প্রথম স্বামী নিকোলাই গুমিলিওভ (১৯১০—১৯১৮), ভ্লাদিমির শিলেইকো (১৯১৮—১৯২৬), নিকোলাই পুনিন (১৯২২—১৯৩৫)।
আন্না আখ্​মাতোভা মারা যান ১৯৬৬ সালের ৫ মার্চ।