বাংলা সাহিত্যের সতী ও স্বতন্তরা

সতী ও স্বতন্তরার প্রচ্ছদ
সতী ও স্বতন্তরার প্রচ্ছদ

নারীকে কেন্দ্রে রেখে সতী ও স্বতন্তরা: বাংলা সাহিত্যে নারী নামে তিন খণ্ডে বিশাল সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার। এ সংকলনে প্রতিভাত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে নারীর বিচিত্র রূপ। এ লেখায় সতী ও স্বতন্তরার সম্পাদক লিখেছেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা।

সে এক মহাযজ্ঞ মাত্র দুই থেকে আড়াই বছরে রয়্যাল সাইজের তিন খণ্ড বই। বইয়ের নাম সতী ও স্বতন্তরা: বাংলা সাহিত্যে নারী। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭। তাতে চর্যাগীতি থেকে বিশ শতকের নির্বাচিত সাহিত্য সম্ভার কীভাবে জায়গা করে নিয়েছে, সে আজও ধাঁধা। আমার পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হয় না। সাহস হলেও এর থই পাই না। কিন্তু সে সময়কার বিস্ময় আর মুগ্ধতাবোধ এখনো যেন ঋতুচক্রের মতো ফিরে ফিরে আসে।

আমার এ বিস্ময়বোধ আর মুগ্ধতার কারণ বাংলা সাহিত্যে নারীর বিচিত্র রূপ। নিজে লেখালেখি করলেও প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য সম্পর্কে বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীর জ্ঞানগম্যি যা, সেটুকুও আমার ছিল না। এর ফলে যেমন বর্ণ চেনার মতো হাতেখড়ি নিয়ে আমাকে শুরু করতে হয়েছে, তেমনি নতুন নতুন আবিষ্কারে উচ্ছ্বসিত হয়েছি খুব। নব্য আবিষ্কারের এ উচ্ছ্বাস আমাকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করেছে।

এবার সতী ও স্বতন্তরা নামের সংকলনগ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দু-চার কথা বলি। এ বইয়ে নারী বিষয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের লেখাপত্র ঠাঁই পেয়েছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ছাড়াও আত্মজীবনী, রোজনামচা, চিঠিপত্র শুধু নারী সাহিত্যিকদের। এ বিশেষ ছাড় পুস্তকের বিষয় ‘নারী’ হওয়াতেই। বাংলা সাহিত্যে নারীর নানাবিধ রূপায়ণ খুঁজে দেখাই ছিল এ সংকলনের সার কথা। সাহিত্য সমাজকে প্রভাবিত করে, সমাজ থেকেও সাহিত্য রসদ নেয়—পারস্পরিক এ লেনদেন প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে। সমাজ ও সাহিত্য কে কার আয়না—এ–জাতীয় বিতর্ক আমল দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে সাহিত্যে নারীর ইতিহাস সন্ধান করায় যে ঝুঁকি আছে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়েছে। কেননা প্রতীক-উপমা-রহস্য-হেঁয়ালিপনার যে ছায়াচ্ছন্ন জগৎ, একে যুক্তিগ্রাহ্য ও হিসাবি ছকে ফেলা সহজ কাজ নয়। কাজটা দুরূহই বিশেষত আধুনিক সাহিত্যের বেলায়। তুলনায় মধ্যযুগের কবিদের লেখায় জটিলতা কম, নারীর ব্যাপারে চালাকি বা লুকোছাপার বালাই নেই বললেই চলে। তাঁরা নারীর রূপ বর্ণনায়, যৌন আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করায় যেমন দিলখোলা, সতীত্ব রক্ষায় তেমন খড়গহস্ত। সেকালের কাব্যের প্রাণভোমরাই যেন নারী।

আমার কাছে মধ্যযুগের সাহিত্যপাঠ অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। নানা বিষয়ে চোখ খুলে দিয়েছে। সে সময়কার লেখাপত্রে এমন নজির আছে, যা ঔপনিবেশিক শাসনামলে নারীর আলোকপ্রাপ্ত হওয়া শুরু—এ ধারণাটি খারিজ করে দেয়। যেমন নারীশিক্ষার কথাই ধরা যাক। ষোড়শ শতকের লাইলী-মজনু কাব্যে কওসের (মজনু) সঙ্গে একই পাঠশালায় শাস্ত্রপাঠ করতে দেখা যায় লাইলীকে। আলাওলের পদ্মাবতী পাঁচ বছর বয়স থেকেই গুরুর কাছে পড়তে শুরু করে। চণ্ডীমঙ্গল–এর লহনা, খুল্লনা ও লীলাবতীর পেটে চিঠি লেখা ও চিঠি পড়ার মতো বিদ্যা ছিল। এদিকে সওয়াল সাহিত্যের গোটাটাই দাঁড়িয়ে আছে নারীর সাধারণ জ্ঞানের ওপর। ময়নামতির অলৌকিক ক্ষমতার পাশাপাশি ভারতচন্দ্রের বিদ্যার রয়েছে জ্ঞানের বহু শাখায় অনায়াস বিচরণ। কত নারী যে জাদুটোনা, রসশাস্ত্র, সংগীত, প্রহেলিকাময় কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তা বলে শেষ করা যাবে না।

সতী ও স্বতন্তরায় বিষয় ধরে অধ্যায়-বিভাজন করা হয়েছে। প্রতিটা অধ্যায়ে রয়েছে প্রাচীনকালের কবি থেকে নব্যযুগের নারী-পুরুষ সাহিত্যিকের রচনা। তাঁদের ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে একেকটি অধ্যায়ের নির্দিষ্ট বিষয়ে। এ থেকে তুলনামূলক পাঠ অবশ্যই সম্ভব, যা আমি পাঠকের ওপর ছেড়ে দিতে চেয়েছি।

এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই, অধ্যায়ের নামকরণে প্রাক-আধুনিক সাহিত্যের প্রতি আমার পক্ষপাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন বৈধব্য, সতীত্ব, প্রণয়িনী, নারীর রূপযৌবন, অন্দরমহল, সখীবার্তা ইত্যাদি। প্রতিটা অধ্যায়েই আমাদের অতীত ছিল পশ্চাদপদ, বর্তমানকাল উন্নত পাঠকের এমন ভাবনার সুযোগ নেই। যেমন প্রণয়িনী পর্বে ষোড়শ শতকের ইউসুফ-জুলেখা কাব্যের জুলেখা। বয়সে ইউসুফ জুলেখার পুত্রসম, বহুমূল্যে কেনা গোলাম। যার প্রেমে বিবি জুলেখা উন্মাদিনী, দেশান্তরি। শেষ পর্যন্ত নায়িকার প্রতি রহম হয়েছিল কবির। পাপ দিয়ে প্রেম ঢাকার চেষ্টা হয়নি। জুলেখার মানসম্মান বহাল থাকে। কামোদ্দীপক সপ্ত টঙ্গীর ফাঁদ যে নির্বিকারে পেরিয়ে যায়, যার গায়ের জামা খামচে ধরেও পলায়ন রোখা সম্ভব হয় না, সেই সোনার হরিণের সঙ্গে মিলন ঘটে, যখন জুলেখা যৌবনহারা এক বৃদ্ধ নারী, মিসর দেশের রাজরানী থেকে পথের ভিখারিণী। সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীর জনপ্রিয় কাহিনি ইউসুফ-জুলেখা কাব্যের উৎস হলেও শাহ মুহম্মদ সগীরের এ এক অনন্য অবদান। বিবি জুলেখার ভাগ্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কম নারীই জন্মেছেন।

আজকালকার সাহিত্যের প্রণয়িনীরা প্রেমের দুস্তর বাধা পেরিয়ে এখন পর্বতপ্রমাণ সংশয়ের মুখোমুখি। তবু কান পাতলে প্রেমের জোয়ার আসার ঢাক গুড়গুড় শোনা যায়।
বাংলা সাহিত্যের বড় একটা অংশ জুড়ে যেমন সতীত্ব রক্ষার ধনুভাঙা পণ আছে, তা নস্যাৎ করার আপ্রাণ চেষ্টাও চলেছে। আর পাড়া-প্রতিবেশীর চোখে ধুলা দিয়ে দুর্যোগের রাতে অভিসারে বেরিয়ে পড়ার অ্যাডভেঞ্চার তো সেই আদ্যিকালের। তবু সতীত্ব নিয়ে নীতিকথার খামতি নেই। ইহকাল ও পরকালের কঠোর সাজার বয়ান বিধৃত হয়েছে যুগে যুগে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের ছোঁয়া মেলে মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের প্রণয়কাহিনিতে। দেহ-স্পর্শমাত্র নারীর সতীত্ব নষ্ট হওয়ার ‘রামায়ণী সংকীর্ণতা’ প্রেমের প্রবল জোয়ারে খড়-কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল। আর বৈষ্ণব কাব্যের রাধা তো এ ব্যাপারে একাই এক শ।

সতী-অসতীর কুয়াশাচ্ছন্ন চরাচরের শেষ প্রান্তে প্রান্তিক নারী দেহোপজীবিনীর বাস। এ বাবদে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন এসেছে ঔপনিবেশিক শাসনামলে। উনিশ শতকের গোড়ায়, কলিকাতার বাবুরা মাত্রাতিরিক্ত বেসামাল। মদ-বেশ্যা আঁকড়ে ধরে কোনোমতে টাল সামলাতে হচ্ছিল। ওদিকে ব্যারাকবাসী ইংরেজ সেনাদেরও নারীসঙ্গ আবশ্যক। বেশ্যাপল্লি ভাঙা কলসির জলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে বটতলা থেকে খান্দান সাহিত্যের আসর গুলজার। সে সময় জারি হয় ইংরেজের তৈরি সংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক কুখ্যাত চৌদ্দ আইন। পতিতাবৃত্তিতে পাপের সঙ্গে অপরাধ যুক্ত হলো। এই শাঁখের করাতের দুধারে কাটা পড়তে পড়তে দেহোপজীবিনীর বড় অংশ এখন আবাসহীন, নতুন নাম পেয়েছে ভাসমান। গোলেবকাওলীর বেশ্যার সোনার বরণ বালাখানা বা ধর্মমঙ্গল কাব্যের সুরিক্ষার পীত নীল নিশান ওড়া সুরপুরসম প্রাসাদ থেকে আজকের চালচুলাহীন খোলা আকাশ বাংলা সাহিত্যের দেহোপজীবিনীর ঠিকানা।

আমরা বড় হয়েছি অন্দরমহলের গীবত শুনতে শুনতে। এ যে নারী নারী সম্পর্ক চর্চার বালাখানা তা ‘অন্দরমহল’ অধ্যায়ে উঠে এসেছে। বউ-শাশুড়ি, ধাত্রী-কন্যা, সখী-সখী, বোন-বোন, সহপাঠী-সহপাঠী—এরা সমাজ অনুমোদিত জুটি। স্নেহ–মমতা, প্রেম-ভালোবাসা, সহমর্মিতা, কানাকানি, শলাপরামর্শ আর ভাবের আদান-প্রদানে তা বিচিত্র। কারও কারও বেলায় সংকট মুহূর্তে বা নিজের অজান্তেই হয়তো সম্পর্ক এমন দিকে বাঁক নিয়েছে, যা সমকামিতাও হতে পারে।

সতী ও স্বতন্তরার তৃতীয় খণ্ডের নাম ‘লোকসাহিত্যে নারী’। এই সংকলনের বেলাতেও একই তরিকা মানা হয়েছে। বিপুলায়তনের এ তিন খণ্ডের সংকলন আমার একার কাজ নয়। উপদেষ্টামণ্ডলী ছিলেন। অর্থের জোগানদাতা একশন এইড বাংলাদেশের তখনকার কান্ট্রি ডিরেক্টর ও বন্ধু প্রয়াত নাসরিন হকের ভালোবাসা ও প্রেরণা এ কাজে জড়িয়ে আছে। ছিলেন সহযোগী সম্পাদকবৃন্দ। তাঁদের মধ্যে বাসবী বড়ুয়াকে আমার সঙ্গে নানা দিকে ছুটতে হয়েছে লেখাপত্র সংগ্রহের কাজে।

তখন বাংলাদেশের কয়েকটা জেলা শহরের গ্রন্থাগারে যাওয়া হয়। ওখানে ঢোকামাত্র হাঁচি-কাশি শুরু হয়ে যেত। এমন ছ্যাতলা পড়া আর ধুলাবালি আকীর্ণ! অফিস টাইমে যেয়ে ‘তালাবদ্ধ’ দেখাটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। গ্রন্থাগারের আয়না-ভাঙা বইয়ের র​্যাক বা র​্যাক প্রায় না থাকার মতো, ঘুণে খাওয়া তাক-সর্বস্ব। মেরামতহীন দালানকোঠার অবস্থাও তথৈবচ। একটা গ্রন্থাগারের বারান্দায় একবার পাতাসমেত গাছের ডাল মুখের কাছে দিয়ে ছাগল বেঁধে রাখতে দেখেছি।

দীর্ঘদিনের কাজের শেষে বইটা প্রেসে দিয়ে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম—আমি এখন ফিরতে পারি নিজের লেখালেখিতে সেই আনন্দে। আমার মধ্যে তখন সখী রঙ্গমালা লিখতে বসার তাড়না। সতী ও স্বতন্তরার কাজ করতে গিয়ে আমি ‘চৌধুরীর লড়াই’ নামে পূর্ববঙ্গ গীতিকার একটি পালাগানে আকৃষ্ট হই। অষ্টাদশ শতকের এই পালাগানই সখী রঙ্গমালা উপন্যাসের প্রেরণা, যা ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় প্রথমা ও ২০১৫-তে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে। শবনম নাদিয়ার করা বইটির ইংরেজি অনুবাদ গত বছর বিলাভেট রঙ্গমালা নামে প্রকাশ করেছে বেঙ্গল লাইটস। এ বছর সিগাল বুক ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশের কথা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যের বিশাল প্রান্তরে আমার দুই-তিন বছরের যে ঝটিকা সফর, এর আবেশ এখনো আমাকে ছেড়ে যাইনি। আমি খুশি হই, যখন বুঝি যে সেই বিহ্বলতা, মুগ্ধতা প্রতিফলিত হচ্ছে আমার লেখালেখিতে। সতী ও স্বতন্তরা: বাংলা সাহিত্যে নারী বইটি প্রথমে প্রকাশ করেছিল দিব্যপ্রকাশ। পরে ২০০৯ সালে বইটি প্রকাশিত হয় সাহিত্য প্রকাশ থেকে।