'যা কিছু আমাকে আকৃষ্ট করেছে, তা নিয়েই লিখেছি'

উত্তরায় নিজের বাড়িতে বসে রিজিয়া রহমান বললেন, বয়স মানুষকে বারবার বদলে দেয়। ছবি: খালেদ সরকার
উত্তরায় নিজের বাড়িতে বসে রিজিয়া রহমান বললেন, বয়স মানুষকে বারবার বদলে দেয়। ছবি: খালেদ সরকার

সম্প্রতি একুশে পদক পেয়েছেন বাংলাদেশের অগ্রজ কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। এখন তিনি বেশ অসুস্থ, লিখতে পারেন না তেমনভাবে। তিনি কথা বলেছেন তাঁর লেখালেখি ও সাম্প্রতিক দিনযাপন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসউদ আহমাদ।

মাসউদ আহমাদ: কথাসাহিত্যিক হিসেবে সম্প্রতি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন আপনি। আপনার অনুভূতি জানতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে কথা শুরু হতে পারে।

রিজিয়া রহমান: কোনো পুরস্কার পাওয়া বা না–পাওয়া আমার কাছে এখন সমান কথা। পুরস্কার পেলে সফল, না পেলে ব্যর্থ—আমি বিষয়টিকে সেভাবে দেখি না। সত্যি বলতে, পুরস্কারের জন্য সেভাবে আমার আকুলতা ছিল না। তবে এটা রাষ্ট্রীয় বড় পুরস্কার, সে হিসেবে ভালো। কিন্তু এখন পেয়ে কী আর হবে। আরও আগে পেলে হয়তো ভালো হতো। কী জানি, ভালো না–ও হতে পারত। আর যেটি দেখে খুব দুঃখ পেয়েছি, একুশে পদক দিয়েছে, আমার জীবনবৃত্তান্তে দেখলাম ভুলে ভরা তথ্য। এসব দেখে ভালো লাগেনি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ এমন উদাসীনভাবে হতে পারে, এটা মানা যায় না।

মাসউদ: আপনার রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি পতিতাপল্লির পটভূমিতে সেখানকার মেয়েদের দিনযাপনের আলো-অন্ধকার নিয়ে লেখা। এটি লেখার প্রেরণা কীভাবে পেয়েছিলেন?

রিজিয়া: সাধারণত একজন লেখকের প্রেরণা যেভাবে ভেতর থেকে আসে, তেমন করেই এসেছিল। আমার ক্ষেত্রে যেটি মূল কারণ বলে মনে হয়েছে, তা হলো, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মানবতার অবমাননায় ব্যথিত হওয়া এবং প্রতিবাদ করা। হয়তো সে কারণেই উপন্যাসটি লিখতে পেরেছিলাম।

মাসউদ: এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সেখানে, মানে পতিতাপল্লিতে যেতে পারেননি। তবুও এমন সুনিপুণ কাহিনি ও জীবনধারা উপন্যাসের ক্যানভাসে কীভাবে তুলে আনলেন?

রিজিয়া: সেটা আমার পক্ষে বলা খুব কঠিন। ভাবলে এখন অবাকই হই। আর সুনিপুণ কাহিনি বা অন্যকিছু হয়েছে—এটা আমার কখনোই ধারণায় ছিল না। পরে যখন মানুষের অনুভূতি ও প্রতক্রিয়া জানতে পেরেছি, মনে হয়েছে, লেখাটি হয়তো ভালো হয়েছে। আমি যেটা করেছি বা আমার লেখার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যখন যে কাজটি করেছি, সেই কাজের মধ্যে একাকার হয়ে যাওয়া। সে কারণে হয়তো লেখাটি মানুষের অন্তর স্পর্শ করতে পেরেছে। আমি কেমন বা কোন সমাজের মানুষ, লেখার সময় সেটা মনে রাখতে চাই না, উপন্যাসের ঘটনা ও চরিত্রই আমার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে এবং তারাই তখন আমাকে ডমিনেট করে।

মাসউদ: এই উপন্যাসের ইয়াসমিন এত প্রতিকূলতার ভেতরেও যে মানসিক শক্তি ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, অন্যদের কাছে আশ্রয়ের জায়গা হয়ে ওঠে, লেখকের জীবনবোধ ও ব্যক্তিত্ব তাতে প্রতিফলিত হয়েছে—এমনটি ভাবা যায় কী?

রিজিয়া: এটা তো আমি বলতে পারি না, যাঁরা পাঠক-সমালোচক, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, একজন লেখকের নিজস্ব কিছু বক্তব্য থাকে, যা সে তার ব্যক্তিগত জীবনে বলতে পারে না। লেখকের যে মূল্যবোধ, যা সে বলতে চায়, বলা হয়ে ওঠে না; লেখার মধ্য দিয়ে সে হয়তো সেসব বলতে চায়। আমার ধারণা, ইয়াসমিন চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমি সেই কথাগুলো বলতে চেষ্টা করেছি।

মাসউদ: আপনার উপন্যাসগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, উপন্যাসগুলো স্বতন্ত্র বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। যেমন ঘর ভাঙা ঘর, রক্তের অক্ষর কিংবা বং থেকে বাংলা। সাহিত্য রচনায় এই যে নির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচন, এটা কেন করেছেন?

রিজিয়া: একজন লেখক যখন যে বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, তিনি সেটি নিয়েই লেখেন। আমি যখন যে বিষয়ে আকৃষ্ট হয়েছি, সেটি নিয়েই লিখেছি। বিষয় নির্ধারণ করে আমি সাধারণত লিখি না। কখনো লিখি না। ঘর ভাঙা ঘর যখন লিখি, তখন ১৯৬৭ সালের দিকে আমরা পাকিস্তানের অধীনে ছিলাম। আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশক চলছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা তখন যথেষ্ট খারাপ। সবুজ সুন্দর উর্বর একটি দেশ, কিন্তু খাবার নেই। পূর্ব বাংলার মানুষের কোনো উন্নতি নেই। স্বভাবতই মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে শুরু করেছে কাজের খোঁজে। তখনই কিন্তু এ দেশে বস্তির বিস্তার শুরু হয়। তখন আমরা শান্তিবাগে যেখানে থাকতাম, সেখানে মানুষের জীবনযাপন দেখতাম খুব কাছে থেকে। ওখানে সবাই বলত, শহরে থেকে কিছু টাকা জমিয়ে আমরা গ্রামে ফিরে যাব। ওরা ভাবত, ওরা ফিরে যাবে, কিন্তু ফিরে আর ওরা যেতে পারত না। কাজ নেই। চারদিকে শোষণ। এ পটভূমিতেই ঘর ভাঙা ঘর লিখেছি।

মাসউদ: বং থেকে বাংলা আপনার আরেকটি বিশিষ্ট উপন্যাস। বাঙালি জাতীয়তাবোধ, ভাষার বিবর্তন এবং মুক্তিযুদ্ধ এই উপন্যাসের মূল বিষয়। ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে গিয়ে তথ্য ব্যবহার এবং চরিত্রের মুখে সংলাপ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন ঔপন্যাসিকের সামনে কী ধরনের ঝুঁকি থাকে বলে আপনি মনে করেন?

রিজিয়া: বং থেকে বাংলা আমার খুব কম বয়সের লেখা। এটা ঠিক ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, একটি জাতি গঠনের কাহিনি এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে স্তরগুলো তাদের পার করে আসতে হয়েছে, সেসব ধাপ অতিক্রমের গল্পই এখানে লিখতে চেষ্টা করেছি। তবে উপন্যাসটি ইতিহাসনির্ভর, ইতিহাস ছাড়া তো এত ঘটনা আসে না। যে জাতিটি গঠন হয়েছে এত মানুষের আত্মত্যাগ, জীবনযাপন, সমাজ এবং চিন্তাভাবনা নিয়ে; সেসবই বলতে চেয়েছি। ঝুঁকিটা আমি আলাদাভাবে বোধ করিনি। ইতিহাস নিয়ে লিখতে হলে তো ইতিহাস জানতে হবে; তখনকার ভাষা, তাদের জীবনবোধ এবং আনুসঙ্গিক বিষয়গুলো তুলে আনতে পারলে ভালো হয়। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, নিজের ভাবনা ও প্রস্তুতিটা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি কি না, সেটাই চ্যালেঞ্জ ছিল।

মাসউদ: আমাদের সমাজে সাফল্য পেয়ে গেলে নারী বা পুরুষকে আলাদাভাবে আর দেখা হয় না। কিন্তু মেয়েরা তো নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হয়, প্রেরণার জায়গায় পিছিয়ে থাকে। এখন হয়তো দৃশ্যপটের কিছুটা বদল ঘটেছে। এ নিয়ে কী বলবেন?

রিজিয়া: এটা কেবল নারী বা বাংলাদেশেই নয়, এই মানসিকতা সারা পৃথিবীতে ছিল, এখনো হয়তো আছে। অর্থনৈতিক কারণেই মূলত এসব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। এখন শিক্ষা এই দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলে দিয়েছে। তবে আমার ধারণা, নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, অবহেলা বা অবদমন—এটা মানুষের অবচেতন মনের প্রকাশ। অনেকেই এটা অতিক্রম করতে পারে না। এখন সমাজ অনেক বদলেছে। মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা বদলায়নি।

মাসউদ: একজন নারীকে তো ঘরকন্যা, সন্তান পালন বা কর্মক্ষেত্রে সময় দেওয়ার পর নিজের সৃজনশীল বা অন্য কোনো কাজে অংশ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

রিজিয়া: এটা বলা হয়ে থাকে এবং এ ধারণা চলে আসছে। কিন্তু আমার বিবেচনা একটু অন্য রকম। ঘরকন্যা নারীরাই করেন, এটা ঐতিহ্যগত। নারীরাই পারেন সুচারুভাবে ঘরের কাজ করতে। কারণ, তাদের বড় দায়টা সন্তানের কাছে। সন্তানের দায়িত্ব পালন বা ভার নিতে মায়েরা যতটা পারেন—বাবারাও পারেন বটে—কিন্তু মায়েদের মতো পারেন না। এটা হয়তো জন্মগত বা প্রকৃতিগতভাবেই মেয়েদের স্বভাব। আর ঘরকন্যা করতে যে মেয়েরা বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই। নিজের কথা বলতে পারি, আমি লেখালেখি করেছি, তার মানে এই নয় যে আমার ছেলে না খেয়ে থেকেছে বা আমার স্বামীর প্রতি কোনো অবহেলা করেছি। আমি ঠিকই যত্ন নিয়েছি। চেয়েছি যে আমার সন্তান যত্নে থাকুক, স্বামী ভালো থাকুক। চেষ্টা করেছি, সংসারে সব সময় যেন শান্তি থাকে। আমি মনে করি, সংসারে যদি শান্তি থাকে, তাহলে যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়।

মাসউদ: নারী সাহিত্যিক হিসেবে কখনো কি আপনাকে সমাজ-সংসারে কোনো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়েছে?

রিজিয়া: আমি যখন লেখালেখি শুরু করেছি, তখন নারীবাদ বা নারী সাহিত্যিক বিষয়গুলো এত প্রকটভাবে ছিল না। আর প্রতিবন্ধকতা কেবল সাহিত্যে নয়, সব ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে এমন কোনো প্রতিবন্ধকতার ভেতরে আমি পড়িনি। লেখার মধ্যে মানুষের কথা বলতে চেষ্টা করেছি, তিনি নারী না পুরুষ, ধনী না নির্ধন—তা নিয়ে ভাবিনি। যা কিছু আমাকে আকৃষ্ট করেছে, তা নিয়েই লিখেছি। বিয়ের আগে বা পরে সহযোগিতা দুই পরিবারেই পেয়েছি।

মাসউদ: তারুণ্যে, আপনি যখন নিয়মিত লিখছেন, তখন আপনার সমসাময়িক পুরুষ লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি বা সহযোগিতা কেমন ছিল?

রিজিয়া: দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমি এ মুহূর্তে বিশদভাবে বলতে পারব না। তবে পুরুষ লেখকদের মধ্যে একটু অনুকম্পার ভাব ছিল, এটা মনে হয়। আর সহযোগিতার কথা বলতে গেলে, বাধা কেউ দেননি। যেটা ভালো লেখা, সেটা সবাই ভালো বলেছেন। যেটা ভালো হয়নি, সবাই বলেছেন, ভালো হয়নি।

মাসউদ: একটি উপন্যাস আপনি লিখতে চেয়েছিলেন পদ্মা নদীর পটভূমিতে...

রিজিয়া: সেই উপন্যাসটি অর্ধেক বা তার একটু কম লেখার পরে থামিয়ে দিতে হয়েছে। অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার চোখের দুর্ঘটনা ঘটল। প্রায় পাঁচ বছর কোনো ধরনের লেখাপড়া করতে পারিনি। ফলে লেখাটা শেষ করতে পারিনি।

মাসউদ: এখন আপনার সময় কাটে কীভাবে?

রিজিয়া: এখন এক অদ্ভুত সময় পার করছি আমি। আমার শরীরে ক্যানসার। হার্ট ঠিকমতো কাজ করছে না। আরও কিছু শারীরিক জটিলতা কাজ করছে। বয়স হয়েছে। চোখের সমস্যার কারণে লেখাপড়া ঠিকমতো করতে পারি না। সময়টা যে খুব সুখকর নয়, তা বুঝতে পারছি। তবু মেনে নিয়েছি। অন্য কোনোভাবে সমন্বয় করার চেষ্টা করি। কারণ মানুষের সব সময় তো এক রকম যায় না। আমি রান্না করতে খুব পছন্দ করি। এখন তা করতে পারি না বলে দুঃখ হয়। ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়। পারি না।

মাসউদ: কিছু লিখছেন এখন?

রিজিয়া: না। এখন তো পড়তেই পারি না। লিখতেও পারি না। চোখে খুবই কম দেখি। আগে টেলিভিশন দেখতাম, এখন ঘোলা ঘোলা লাগে। হেডলাইন শুনি। কখনো পত্রিকা দেখি হয়তো। বড় ফন্ট হলে পড়তে পারি। ভালো কোনো খবর থাকলে কাজের মেয়েটা পড়ে শোনায়। বয়স হয়েছে তো, বয়স মানুষকে বারবার বদলে দেয়।