পাশের গাঁয়ে কবে যে যাব

ফ্রানৎস কাফকা
ফ্রানৎস কাফকা

সময় তো তারও আগে ফুরিয়ে যেতে পারে
বইমেলায় গিয়ে চোখে পড়ল ফ্রানৎস কাফকার লেখার বেশ অনেক অনুবাদ। হাতে তুলে নিয়ে পড়তে গিয়ে অস্বস্তিই হলো। ভাষান্তর সত্যি কঠিন কর্ম। একজনের অনুবাদ পড়তে গিয়ে পড়তে পারলাম না। অহেতুক দুর্বোধ্য, জটিল করে তোলা হয়েছে ভাষা, শব্দকে। কাফকার ‘নেক্সট ভিলেজ’ বা ‘পাশের গ্রাম’ একটি অত্যন্ত প্রিয় প্যারাবল আমার। সে লেখার খুব দুর্বল অনুবাদ দেখে খারাপ লাগল। দেখা যাক আমার ভাষান্তর কতখানি কাছাকাছি যেতে পারে প্রিয় কাফকার বর্ণনার:

‘আমার দাদু, মানে আমার বাবার বাবা বলতেন, জীবনটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, বলতেন তিনি, আমি যখন পেছনে তাকাই আমার মনে হয়, জীবনটা এতই অল্প সময়ের যে আমি একটুও বুঝতে পারি না একজন যুবক কী করে সাহস করে পাশের গ্রামটিতেও যাওয়ার কথা ভাবতে পারে—দুর্ঘটনার কথা একটুও যদি না ভেবে থাকে, তা হলেও স্বাভাবিক, স্বাচ্ছন্দ্যের সময়েও কি এমন একটি সফরে যাওয়ার কথা ভাবা যায়?

সময় তো তারও আগে—অনেক আগে—ফুরিয়ে যেতে পারে।’

এই যে ‘সময়’ শব্দটি, এখন তা নিয়েও বেশ অনেকটা কাল ভেবে দেখা যেতে পারে বোধহয়।

মনে এলেন কবি মণীন্দ্র গুপ্ত

বই গোছাতে গিয়ে হাতে উঠে এল প্রিয় কবি মণীন্দ্র গুপ্তর কবিতার বই। মনে পড়ল ২০১৬ সালে কলকাতায় গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম তরুণ কবি মোস্তাফিজ কারিগর ও তাঁর বন্ধু অনুপ চণ্ডালের সঙ্গী হয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত-দেবারতি মিত্র দম্পতির স্বল্পপরিসরের ফ্ল্যাটে হাজির হয়ে গিয়ে।

বলে রাখি যে দেবারতি মিত্রর কবিতাই আমার পড়া ছিল বেশি, তাই তাঁকেই বরং বেশি চেনা মনে হয়েছিল আমার। কবি-দম্পতির সঙ্গে আলাপ জমতে-না-জমতে সেখানে হাজির হয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের আর এক শক্তিশালী ও নামী কবি একরাম আলি। আড্ডা উঠল জমে।

মণীন্দ্র গুপ্তের এই কয়েকটি লাইন লিখে রাখা হয়েছিল ডায়েরিতে রাখব বলে বা নিছকই লিখে রাখার জন্য। কয়েক দিন আগে খবরে জানলাম, সেই কবি মণীন্দ্র গুপ্ত আর নেই।

‘এবার যেন কিছু আগেভাগেই

শীতের দেশ থেকে বক সারস আর হাঁসেরা এসে নামছে বিলে

আমাদের, আশি বছরের বৃদ্ধদের, প্রেম ক্ষুধা শোক ও ভ্রান্তির পাশে

পক্ষীজীবনের কয়েকটা রাত কাটাবার জন্যে।’

এবার ১৬ পৃষ্ঠার বইটি থেকে একটি পুরো কবিতা:

বেগুন দিয়ে মেথি শাক রাঁধছি—

গন্ধে মনে হচ্ছে, এই বয়স এইখানেই থেমে রইল।

এরপর শাড়ি কাচতে হবে, মাড় দিতে হবে—

শুকোতে দিতে গিয়ে রোদে যে দাঁড়িয়ে থাকে

সে কি আমি, না, আমার দেখা হলদে পরি?

কুলভর্তি কুল গাছের মাথা দোতলার ছাদ অবধি উঠে এসেছে।

দিনান্ধ বাদুড় ঝুলে আছে

সুখ কেমন

সুখ কাকে বলে

কলসির মধ্যে জল শীতল হয়ে আছে। স্থির।

দূরের মাঠে রোদ্দুরে জিরেনের রস পড়ে ফোঁটা ফোঁটা

দ্বিতীয় হলদে পরি ওইখান থেকেই উড়ে এল।

কবি মনীন্দ্র গুপ্ত
কবি মনীন্দ্র গুপ্ত

বই দেখালেন। কত কত লেখা! অনেক উৎসাহ, উদ্যম। বয়স আশি পেরিয়ে গেছে। শক্ত বিছানায় ঠায় বসে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন। কোথায় থাকি, চাটগাঁয় গেছি কি না। ঢাকা শহর কেমন, সুবিধা-অসুবিধা, আশি পেরোনো যুবকটির অদম্য কৌতূহল। মাঝখানে-মাঝখানে দেবারতি মিত্রও কথা বলছিলেন। কত নামী কবি দেবারতি মিত্রও, তাঁর কবিতা সম্ভবত বেশি পড়া হয়েছে আমার, দেশ সাধারণ ও শারদীয় সংখ্যায় বেশ অনেক, যতদূর মনে পড়ে। কিন্তু কী সাধারণ, অল্প পরিসরের ঘরে তাঁর ও মণীন্দ্র গুপ্তর বসবাস। লেখালেখি, কথাবার্তার সঙ্গে অতি স্বল্পসুবিধার জীবনযাপনকে মেলাতে পারা কঠিনই হচ্ছিল।

কবিতা না পড়তে চাওয়ার কৈফিয়ত

কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েও পড়তে যেতে না-পারার কারণ বলতে আমন্ত্রিতদের কারও কারও প্রায়ই বিব্রত হতে হয়। কিন্তু কারণ তো থাকতেই পারে নানা। প্রথম কারণটি হচ্ছে, ঢাকার কেন্দ্রস্থলটিতেই এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে যাওয়া আমন্ত্রিত কোনো কোনো লেখকের পক্ষে কঠিন হয়, বিশেষত তাঁর আবাসস্থলটি যদি বেশ খানিকটা দূরবর্তী হয় (যেমন, মিরপুরে) এবং যানবাহন দুর্লভ, তবে ফিরে যাওয়া দুর্ভাবনার কারণ হয়ে পড়ে। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি যেভাবে অত্যন্ত অল্প সময়ে শেষ করা হয়, সেখানে সহজ ছিল প্রত্যাগমন। অতএব সে অনুষ্ঠানে সহজেই কবিতা পড়া সম্ভব হয়েছে এ লেখকের। কবিতা পড়ার এমন সব আয়োজকদের কাছে অনুরোধ, অনুষ্ঠানের আয়োজন এমন সময়ে করা হোক যাতে দূরত্বজনিত সময়ক্ষেপণ থেকে, যানবাহনের অভাব ও বিশৃংখলাজনিত দুরবস্থা থেকে অভ্যাগতরা রেহাই পেতে পারেন।