মীনাক্ষীর বিচ্ছিন্ন কথামালা

বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮—১৮ মার্চ ১৯৭৪)
বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর ১৯০৮—১৮ মার্চ ১৯৭৪)

১৮ মার্চ কবি–সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুবার্ষিকী। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে প্রথম আলো অফিসে এসেছিলেন বুদ্ধদেব–কন্যা মীনাক্ষী দত্ত। এ লেখায় ধরা আছে মেয়ের কথায় বাবার স্মৃতিচারণা। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে আরও অনেকের কথা।

যেদিন জ্যোতির্ময় দত্ত আর মীনাক্ষী দত্ত এসেছিলেন প্রথম আলোয়, সেদিন উপস্থিত সবাই মীনাক্ষীর কাছে জানতে চাইছিলেন তাঁর কিছু কথা, কিছু স্মৃতিচারণ, বিশেষত বাবা কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু আর মা লেখক প্রতিভা বসুর কথা। প্রথম আলো অফিসে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকা শহরের সাহিত্যিক–কবিরা। তাঁদেরই আহ্বানে মীনাক্ষী দত্ত কথা শুরু করেছিলেন তাঁদের ঢাকার বাড়ি নিয়ে। বনগ্রামের কথা উঠে এল তাঁর কথায়। ঢাকার এই বাড়িতে ১৯৮৮ সালে যখন এসেছিলেন অনেক দিন পর, তিনি চমকে গিয়েছিলেন। ঠিক তেমনটিই রয়ে গেছে বাড়ি, যেমন দেখে গিয়েছিলেন ছোটবেলায়।

মীনাক্ষীর ছোটবেলায় প্রতিবছরই গ্রীষ্মের ছুটিতে মা–বাবা ঢাকায় আসতেন। সে কথা বলার সময় উপস্থিত অতিথিদের কেউ মনে করিয়ে দিলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে না ট্রেনে একবার দেখা হয়েছিল আপনার মা–বাবার?’

মীনাক্ষী দত্ত হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, ট্রেনে দেখা হয়েছিল। তাঁকে দেখেই বাবা বলেছিলেন, “রানু, দেখো, তোমার কবিদা।”’ প্রতিভার ডাক নাম রানু। নজরুলকে তিনি কবিদা বলে ডাকতেন।

নজরুলের কথা বলতে বলতেই মীনাক্ষী বললেন বাবা বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে মা প্রতিভা বসুর প্রথম দেখা হওয়ার কথা। তাঁদের দেখা হয়েছিল ঢাকায় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাড়িতে। সকাল আটটায় গিয়েছিলেন তিনি। এই বাড়িতেই দিলীপ রায়ের কাছে গান শিখতেন প্রতিভা। তিনি যখন ঢুকছেন, তখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন বুদ্ধদেব। সত্যেন বোস বলেছিলেন, ‘ছোকরার বেশ কবি কবি চেহারা!’

কথায় কথায় আবার এল নজরুলের প্রসঙ্গ। মীনাক্ষী এ সময় বললেন আরও একটি কথা, যা তাঁর মায়ের কাছ থেকে শোনা। যেদিন নজরুল প্রথম প্রতিভা বসুদের বাড়িতে আসেন, সেদিন পরিচারিকা ছাড়া আর কেউ বাড়ি ছিলেন না। বাড়ি ফিরতেই পরিচারিকা নজরুলের পরিচয় দিয়েছিলেন এভাবে, ‘কেষ্টঠাকুর এসেছিল গো, কেষ্টঠাকুর।’

নজরুল প্রসঙ্গ শেষে আসরের কেউ একজন প্রশ্ন করলেন তাঁকে, ‘আপনার বাবা কি এলিট ছিলেন?’

‘একেবারেই না। তবে মায়ের পরিবার ছিল এলিট।’

আবার এল বুদ্ধদেব বসু প্রসঙ্গ। মীনাক্ষী পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের কোনো কবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না—শামসুর রাহমান ছাড়া। শান্তিনিকেতনে একবার সাহিত্য আসর বসেছিল। তার আয়োজক ছিলেন নিমাই চট্টোপাধ্যায় আর গৌরী আইয়ুব। আসলে সেটা ছিল বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে করা অনুষ্ঠান। কিন্তু আয়োজকেরা সে কথা কাউকে বলেননি। এমনকি সভার সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায়কেও না। কারণ, তাতে সভা পণ্ড হয়ে যেতে পারত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভিসা পেয়েছিলেন শামসুর রাহমান, কায়সুল হক এবং আরেকজন। মীনাক্ষী নামটা মনে করতে পারলেন না। সেবারই পূর্ব বাংলার কোনো কবির সঙ্গে প্রথম দেখা হলো তাঁর।

বুদ্ধদেব কন্যা মীনাক্ষী দত্ত (বাঁ েথকে পঞ্চম) ও জামাতা জ্যোতির্ময় দত্তের (বাঁ েথকে দ্বিতীয়) সঙ্গে বাংলাদেশের েলখকেরা
বুদ্ধদেব কন্যা মীনাক্ষী দত্ত (বাঁ েথকে পঞ্চম) ও জামাতা জ্যোতির্ময় দত্তের (বাঁ েথকে দ্বিতীয়) সঙ্গে বাংলাদেশের েলখকেরা

মীনাক্ষী স্মরণ করলেন, বুদ্ধদেব বসুর কাছে কবিতা আসত ঢাকা থেকে। হলুদ খাম, সবুজাভ ডাকটিকিট। কোনো কোনো চিঠি খুলতেন মীনাক্ষী। তার মধ্যে শামসুর রাহমানের কবিতা থাকত। তিনি স্পষ্ট মনে করতে পারলেন সৈয়দ শামসুল হকের একটি কবিতার কথা—‘ইজদানি মারা গেছে বিমান পতনে’। এই কবিতাটির খাম তিনি নিজ হাতে খুলেছিলেন।

মীনাক্ষী বললেন শহীদ কাদরীর কথাও। ১৪ বছর বয়সে শহীদ কাদরী যে কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুকে, সেই কবিতাই কাদরীকে কবি বানাল। বাড়িতে চলত উর্দু, মা বলতেন বাংলা। সেই বাড়ির একটি ছেলে বাংলা ভাষার একজন নামকরা কবি হয়ে উঠলেন।

মীনাক্ষী বলেন, ‘শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। বোস্টনেই তাঁর ৬০ বছর বয়সে কথা হয়েছিল। খুব আড্ডাবাজ তিনি। অসুস্থ, কিন্তু কী প্রাণশক্তি তাঁর! লিখেছেন কম, কিন্তু পরিমাণ বা সংখ্যা দিয়ে তো আর কবিতা হয় না। শহীদ কাদরী কম লিখেছেন, কিন্তু ভালো লিখেছেন।’