স্বাধীনতার মাসে এ আয়োজনে কবিদের কবিতায় উপজীব্য হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশের মুখ।
মোহাম্মদ রফিক সেদিন ঘাটে কী ঘটেছিল? এমন দেখিনি, আজ কেন মাছ দলেবলে মা ছানা ও বাবা বড়ই চঞ্চল, খেলে হুটোপুটি উদ্বিগ্ন অস্থির—একবার ভেসে উঠে ডুব দেয় চোখ যেন জ্বলে কী এক তাড়নায়, শোল, কৈ, পুঁটি ও মৌরলা— একই হাল ; এতকাল পুকুরের জল বারুদের গন্ধে ছিল ভারী লাশের পচন সয়ে সয়ে একেবারে মরে ছিল যেন মৎস্যকুলে কেউ কেউ হতভাগা পচা মাংস খেয়ে মরেছে অকালে, হতবাক হয়েছে সবাই দুখে-কষ্টে স্বজন হারানো বেদনায় কালক্রমে আত্মঘাতী বা উন্মাদ; কত আর গুলিবিদ্ধ বেয়নেটে এফোঁড়–ওফোঁড় পরিচিত প্রাণীদের ফুল ওঠা ভেপে ওঠা খুলে খসে পড়া সহ্য করা যায়;
মাছ মাছ লাফাচ্ছে বেদম একটি রুই বেশ মোটাসোটা ভারী— দিল লাফ দশ হাত যেন উড়ছে শূন্যের ভেতর যেন সে আকাশ ছুঁতে চায়, ছিটকে পড়ে জল চতুর্দিক, চমকে ওঠে থই-অথই জল ও বাতাস; অন্ধকার ফরসা হয়ে এল কারা যেন জয়ধ্বনি দেয় ওই দূরে কী আনন্দে তোলে ধ্বনি প্রতিধ্বনি কেউ কাছের পিঠে তবে তাই তাই তাই; ওরা টের পায়!
শিহাব সরকার একাত্তরে, হাসপাতালে শুয়ে আছি সেই কবে থেকে নিশ্চল মমি গ্যাংগ্রিন থাবা মেলে আসছে, কোলাহল শুনি কেবিনের ওপারে লবিতে সব ছাপিয়ে, ‘এবারের সংগ্রাম’, আর ‘জয়’ মানুষ আছে পাশে, তার স্পর্শ আছে চাপাকান্না আছে উদ্ভ্রান্ত প্রিয় নারীর
রাত্রিজাগা নার্স চেয়ারে ঢুলুঢুলু। বারান্দায় ভিজিটরের কানে ধরা দেবদুলাল ডাক্তার ঢুকেছেন কেবিনে নিঃশব্দে, মলিন শয্যা, ওষুধ, হরলিক্স, দৈনিক কাগজ: সব ঠিক হ্যায়, সব ইন্ডিয়াকা এজেন্ট চেনা ছবি, ঢাকা স্বাভাবিক, কেউ ফুল এনেছিল এখনো গন্ধ আছে... আমি দেখি রিপোর্টে কী আছে নতুন। যেভাবে তিনি বাজারে মাছঅলার সঙ্গে, বাসায় মেয়ের টিউটরের সঙ্গে এবং পড়শিদের সঙ্গে কথা বলেন, বললেন ডাক্তার ঠিক সেভাবে, ‘সব ঠিক আছে’ তন্দ্রা ছুটে গেছে আমার তাহলে আবার ফিরে যাব ফ্রন্টের বাংকারে ছুটে যাব মেলাঘরে, গহন অরণ্যের ক্যাম্পে? শুনে আসব পাহাড়চূড়ায় প্যাগোডার ঘণ্টা? হায়, তখনই কেন বিবরের মুখ খুলে গেছে মার্চপাস্টের ছবিগুলো মুছে যায়, রেসকোর্স প্রিয় নেতা স্বাধীনতার গান সব রূপকথা, সবই মায়াগল্প? ডুবতে থাকি আমি হিম অন্ধকারে।
ঠিক তখনই ক্র্যাক প্ল্যাটুনের গ্রেনেড ফাটে পেট্রলপাম্পে, সেন্সর বোর্ডের ছাদ ধসে পড়ে। মোড়ে মোড়ে তল্লাশি, তোম মুক্তি হ্যায়, জয় বাংলা সে আয়া? বারান্দায় গান, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়...’
টোকন ঠাকুর কয়েদখানার দেয়াল মাছ লিখেছি, নদীও লিখি গাছ লিখেছি, পাখিও লিখি লিখি আকাশ, গান
জল দেখলেই মাছ হয়ে যাই গাছের ডালে আমিও শিস— পাখির সন্তান
চারদিকে জাল, বঁটির সংসার এর মধ্যেও ইচ্ছে কেমন, বাঁচার দেশের নাম অ্যাকুরিয়াম দেশের নাম খাঁচা—
কে চায় বলো, মুক্তি পাই কে চায় বলো, হাসি? যার অধীনে বন্দী, সেও বলছে, ভালোবাসি!
ফুল হয়েও তো জন্মেছিলাম সে জীবন কি স্বাধীন? শাস্তিস্বরূপ দিলে কি তবে কবিতা লেখার দিন?
যেমন, কয়েদখানার দেয়ালজুড়ে আঁকিবুঁকি, শিশুর মুখচ্ছবি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত যে এঁকেছে কার কাছে সে কবি?
বলো, কার কাছে সে পিতা? কার কাছে মাছ, পাখি? দেয়ালে আঁকা একটি জীবন তার পাশে কি কবিতা হয়ে থাকি!
ফেরদৌস মাহমুদ স্মৃতিসৌধ ইতিহাস দেখতে বেরিয়েছি। পৃথিবী যেন মানুষের ছোঁয়ায় রূপসী স্মৃতিসৌধ, খুব সুশ্রী মায়াময় তবে ভীতিকর!
এখানে শিশুবেশে নবীনেরা আসে। পৃথিবীটাকে ভালোবাসে, নতুন করে চায় সাজাতে। অবুঝ অবস্থায় ফুর্তি করে কিন্তু বুদ্ধি বাড়লেই দুঃখ পায়। শেষে ঘুমিয়ে হারিয়ে যায় নিরুদ্দেশে!
‘জীবিকা’ শব্দের আড়ালে এখানে লোকেরা অনেক কাজ করে। আমার ভালো লাগে না একদম, এমনকি কথাসাহিত্যিক বড় ভাইয়েরও পছন্দ নয় ওই সব। তবু আমি চাকরি ছাড়তে চাইলে বড় ভাই বাধা দেয় আর বড় ভাই ছাড়তে চাইলে চাঁদের পিঠে ঘণ্টা পিটাই আমি। আমাকে ডাকে রোজ ইতিহাসের বিষাদ, ভাঙা রাজপ্রাসাদ, পোড়া মুণ্ডু আর বিলাসী নারী!
আহা, স্বাধীনতার ইতিহাস দেখতে বেরিয়েছি— রক্ত দিয়ে বাঙালি তৈরি করেছে জগৎ সেরা রূপকথা আর স্মৃতিসৌধ!
রাসেল রায়হান চিড়িয়াখানা স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে আমি আমার মাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গেলাম। তিনি চিড়িয়াখানা দেখেননি কোনো দিন। জেব্রা ক্রসিংয়ের উল্কি আঁকা জেব্রা আর হেমন্ত মাসের প্রান্তরের উল্কি আঁকা জিরাফ, মুঠোফোন কোম্পানির লোগোঅলা বাঘ, পরিকল্পিত ঘোলা জল ঠেলে উঠে আসা জলহস্তী আর হাড়জিরজিরে বোবা সিংহ দেখলাম—ঘুমিয়ে আছে। শরীরে নববধূর নথধোয়া কিছু নতুন মাছ সাঁতরে এসে শৈল্পিক ভঙ্গিতে ধাক্কা খাচ্ছে কাচের দেয়ালে। ফুলবাগানচিত্রিত ম্যাকাও, জবার রস গায়ে মাখা টিয়া আর ক্লিওপেত্রার মুকুটে খচিত একটি সাপকে দেখলাম অনেক সরীসৃপের সাথে জীবন্ত ঘুরে বেড়াতে... বের হওয়ার সময় মা ফিসফিস করে আমাকে বলেন, ‘যত দিন শখের বশে একটি মাছকে তোরা অ্যাকুরিয়ামে সাঁতরাতে বলবি, একটি পাখিকে হাততালি দিয়ে বলবি সোনার খাঁচায় উড়ে বেড়াতে, একটি তৃণভোজীকে ঘাসের বীজ ছিটিয়ে বলবি চোয়ালের ব্যবহার করতে, আর মাংসাশীকে দিবি কসাই দিয়ে কাটা টকটকে তাজা মাংস—তত দিন স্বাধীনতা দিবসের ছুটি নিস না।’
মন্তব্য ( ১ )
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে