একটু মাথা ওঠালেই গুলি ছুটে আসে এভাবে কয়েক ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে

আবুল বার্‌ক আলভী। ছবি: কবির হোসেন
আবুল বার্‌ক আলভী। ছবি: কবির হোসেন

১. প্রিয় বই
বই পড়ার ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই

বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোর
বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোর

ছোটবেলা থেকেই পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল আমার। মাকে দেখতাম পাড়ার লাইব্রেরিগুলো থেকে (তখন ঢাকার প্রায় প্রতিটি পাড়াতেই ছোট বা বড় লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরির সদস্য হয়ে বই নিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল) বই নিয়ে পড়তেন। বই আনা-নেওয়ার কাজটা আমাকেই করতে হতো। সে কারণেই বোধ হয় ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, শেষের কবিতা এবং বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোর একসময় যেমন খুব ভালো লেগেছে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যাপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়—তাঁদের অনেক বইও ভালো লেগেছে। এ ছাড়া সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণ দেবীর অনেক বই আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ ও আনিসুল হকের কিছু বইও আমার খুবই প্রিয়।

২. প্রিয় গান
গানগুলো মনকে নাড়া দেয়

প্রিয় গানের কথা বলা খুবই দুরূহ একটা কাজ, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন চিন্তাভাবনা পাল্টায়, সেই সঙ্গে বদলায় পছন্দ-অপছন্দও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’ বা ‘আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি’ যেমন ভালো লাগে, সে রকম ভালো লাগে ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ কিংবা ‘সংকোচে বিহ্বলতায় নিজেরে অপমান’, ‘সার্থক জনম আমার’ প্রভৃতিতে। ভালো লাগে নজরুলের ‘থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়’, বা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ও। আদতে অন্তরস্পর্শী এ গানগুলো শুনলেই ভালো লাগে, মনকে নাড়া দেয় এগুলো।

৩. প্রিয় শিল্পী
তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধ্যানী শিল্পী

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছাড়াও পটুয়া কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদ ও শিল্পী রশীদ চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে বলতে হবে আমার প্রিয় শিল্পীদের নাম বলতে গেলে। যাঁদের নাম নিলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজস্ব শিল্পশৈলীর জন্য অনন্য। পিকাসো, জন মিরো, পল ক্লি, রেমব্রান্ট, মাতিস, ভ্যান গঘ—কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলব? প্রত্যেকেই তো অনন্য দৃষ্টান্ত। আমার মনে হয়, এতক্ষণ যাঁদের কথা বললাম, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ধ্যানী, শিল্পকলার সাধক। তাই তাঁদের কাজ আমার ভালো লাগে।

৪. মুক্তিযুদ্ধের প্রিয় স্মৃতি
প্রিয় নয়, এটি বিশেষ স্মৃতি

১৯৭১-এর আগস্টের শেষে ভাষাসৈনিক ও সুরকার আলতাফ মহমুদের বাসা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লাম এবং অমানুষিক নির্যাতনের পর ছাড়া পেলাম। সেপ্টেম্বরে একটু সুস্থ হলে আবার চলে গেলাম ২ নম্বর সেক্টরের মেলাঘর ক্যাম্পে। সেটা সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। এর আগে কিছুদিন বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে থেকে একসময় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আমাকে বিভিন্ন ক্যাম্পে যেতে হয়েছে এবং যুদ্ধের ছবি তুলতে হয়েছে।

অক্টোবরের মাঝামাঝিতে যেতে হয়েছিল সালদা নদীর যুদ্ধক্ষেত্রে। খালেদ মোশাররফের ব্যাটম্যান, এশিয়ান টেলিভিশনের একজন অহংকারী আলোকচিত্রীসহ আমি প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা গুলি ব্যাটম্যানের হাত এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পেছনে। কিন্তু আমরা আর এগোতে পারলাম না। সময়টা দুপুর। দেখলাম, একটু দূরে পাশেই একটা বাঙ্কার—ঝোপঝাড়ে দেখা যাচ্ছিল না—সেখান থেকে গুলি ছুটে আসছিল। একটা উঁচু আলের পাশে বসে পড়েছিলাম আমরা। একটু মাথা ওঠালেই গুলি ছুটে আসে। এভাবে কয়েক ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে। সামনে ধানখেতে সমানে গোলা পড়ছে। বিরাট গর্ত করে ওপরে উঠে যাচ্ছে মাটি, আমাদের ওপর সেই মাটি আছড়ে পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই আমাদের ওপর পড়ল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এই ঘটনা আমার প্রিয় মুহূর্ত, তা নিশ্চয় বলা যাবে না। তবে বিশেষ মুহূর্ত তো বটেই।

টু কিল আ মকিংবার্ড চলচ্চিত্রের দৃশ্য
টু কিল আ মকিংবার্ড চলচ্চিত্রের দৃশ্য

৫. প্রিয় চলচ্চিত্র
ভালো লাগে একাধিক সিনেমা

প্রিয় চলচ্চিত্র একাধিক। এককথায় বলা সম্ভব নয়। গ্রেগরি পেক ও অড্রে হেপবার্ন অভিনীত রোমান হলিডে, সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালী, মিখাইল কালাতোজভের দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং, ফ্রেড জিনেম্যানের বিহোল্ড আ পেল হর্স, এরিখ মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট—এগুলো দারুণ লাগে। এ ছাড়া রয়েছে রবার্ট মুলিগানের টু কিল আ মকিংবার্ড ছবিটি। গ্রেগরি পেক একজন আইনজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এবং এই ছবির জন্য একাডেমিক অ্যাওয়ার্ডও পান।