চলে যায় বসন্তের দিন

নির্মলেন্দু গুণ

কালো কোকিলের গল্প

কালো বোরকা পরা মেয়েদের কালো চোখ
তবু আমাদের চোখে পড়ে
আবুধাবির শপিং মলে আমি চোখের পাশাপাশি
তাদের সুন্দর নাসিকাও দেখেছি।
অথচ এই বৃক্ষমাতৃক বঙ্গদেশে
হে আমার সুরেলা সুকণ্ঠী কোকিল,
আমি কখনো দেখতে পাইনি তোমাকে।
কী করেই–বা তোমাকে দেখব বলো,
তুমি তো জন্মই নিয়েছ
কালো বোরকার চেয়ে কালো পালকে
তোমার ছোট্ট দেহটিকে আবৃত করে।
তোমার চোখ আমাদের চোখেই পড়ে না।
তদুপরি পাতার আড়ালে থাকতে ভালোবাসো তুমি।
বলো তো, তুমি নিজেকে লুকিয়ে রাখো কেন?
কালো বলে?
এটা কোনো কথা হলো?
কালো বলে আফ্রিকার মেয়েরা লুকিয়ে থাকে নাকি?
প্যারিস ও নিউইয়র্কের পথে পথে আমি তো দেখেছি
কালো মেয়েরা বুক ফুলিয়ে, কোমর দুলিয়ে হাঁটছে।
গর্বে তাদের পা পড়ে না মাটিতে।
বসন্তের সঙ্গে তোমার গোপন সম্পর্কের বিষয়টা
আমাকে বলবে? আমি কাউকে বলব না।
জানি, সব মানুষেরই একটা গোপন গল্প থাকে।
তোমারও একটা আছে নিশ্চয়।
তুমিও কি আমার মতো ব্যর্থ হয়েছ কারও প্রেমে?
আমি আমার বুকে হাত রেখে বলছি—
প্রতিটি বসন্ত সমাগমে তোমার কুহুধ্বনি শুনে
আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বারবার।
তা তুমি যতই কালো হও, প্রিয়তমা আমার,
যতই তুমি কালো পালকের বোরকা পরে রও—
একদিন নিশ্চয়ই আমি তোমার দেখা পাব।

পিয়াস মজিদ

বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য

‘বসন্ত এসে গেছে’

এই পাইকারি প্রচারণায়

ভরে উঠেছে

খুচরো খরিদ্দারের দুনিয়া।

প্রেমের পাসওয়ার্ড

বারবার ভুলে গিয়ে

ফাল্গুনফুল

হয়ে আসে ফিকে।

বুকের ব্যাকুল বাগান

আজ তাই

বিকিকিনির বাজার বিশাল।

এরপরও

হে মরার কোকিল,

তোমাকে গাইতে হবে গান;

বেঁচে থাকার।

ইমরান মাঝি

ফাল্গুনী রাত

এই ফাল্গুনে। আয়োডিন ছাড়া নুনে, খেয়ে যায় ভাত। ফাল্গুনী রাত। বেয়াকুব চাঁদ এক উঠে আছে সাদা। শয়তান গাধা, কুকুরটা বলে যায় ঘেউ ঘেউ করে। রাত্রিদুপুরে। ডাহুকটা ডেকে যায় কড় কড় কড়। পাতিলার চর। শিয়ালেরা ডেকে উঠে কয় বজ্জাত। এই হলো কৃষকের ফাল্গুনী রাত।

মুহম্মদ নূরুল হুদা

তোমার তরঙ্গে উড়ে

খুব ভোরে

উড়ে গেছি

ভেষজশালায়,

বাতাসের বুক থেকে

কুড়িয়েছি আরোগ্য নিদান;

তুমিও

এসেছ উড়ে

প্রজাপতি

রঙিন ডানায়,

মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে

অপরূপ অমরার ঘ্রাণ;

গিলগামেশের

দেহ নেই কারও

আমাদের,

মৃত্যুপুরী পার হয়ে

অমরায় আমরা আসিনি;

তোমার তরঙ্গে উড়ে

তবু আমি

পেয়ে যাই টের,

অনিদ্রানাশক আমি,

তুমিও তো অনিদ্রানাশিনী;

এভাবেই সত্যাগ্রহ

পরস্পর মিলন–বিরহ,

মরলোকে অহরহ,

আমরা রচনা করি

আমাদের আরোগ্যেকাহিনি।

ওমর কায়সার

লুণ্ঠিত বসন্তে

ফুরিয়ে যাওয়ার আগে প্রকৃতির কাছ থেকে

এক টুকরো বসন্ত লুটে নেব।

একদিন হিমালয় থেকে নেমে

বরফের দেবী মিনতি জানাবে।

হীরামন পাখির পালক দেবীর মুকুটে

শিমুলের পাপড়িরা কণ্ঠহারে দ্যুতি দেবে

মৃত সব সুরমূর্ছনায়।

দেবী-মাধুকরী প্রার্থনায় নত

ভিক্ষা নেবে চৈত্রের কিছুটা সুবাস।

লুণ্ঠিত বসন্তে আমি পার করে দেব

শতাব্দীকালের চেয়ে দীর্ঘ বিবর্ণ হিমযুগ।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

বসন্ত

ছেলে মাছ : অচেনা আমার স্থল, শ্বাসহীন জটে

যদি কিছু অসম্ভব ঘটে

জলে ডোবা বসন্তের ঘ্রাণ

দীর্ঘ এক সমাধান

মেয়ে তুমি রাখো কি প্রমাণ?

মেয়ে মাছ : আমি খাদ্য, খাদকের পরিণত কাল

ধীবরের স্বপ্নকল্প জাল

ফাল্গুনে যখন নামে

বেঘোর-বিপ্লব হই নগ্ন চৈত্রকামে

তারপরও রয়ে যাই অদৃশ্য সুনামে!

পুকুর : যে জল, চোখের ভাষা তা তো চন্দ্ররূপ

যে মাটি লেজের নিচে তা তো সূর্যধূপ

মেঘপাখি ডুবছবি—স্নেহময় পানা

বসন্তচুম্বনে তোড়, নয় তা বেগানা

ঘামে-ডিমে ঘাই মারা যৌবনের ডানা!

মহীবুল আজিজ

কোথাও বসন্ত আসবে

কোথাও বসন্ত আসবে বুঝি তাই কাঁপছে চতুর্দিক,

বাগান নেই তো কী হয়েছে বলো ক্যালেন্ডারে ফোটা

ফুলের গন্ধেই মাতোয়ারা সব হাসছে দিগ্​বিদিক—

চেয়ে দেখো ওই রাখা আছে পাশে ঘোষণা যন্ত্রটা।

কোকিল আসেনি বলে কি বসন্ত এখানে নামবে না!

ধূম্র নগরীর বাসিন্দা আমরা নিজেরা বানাই

নিজেদের রীতি—সকলের সাথে কখনো মিলবে না,

এক বিসমিল্লায় কি বাজায় বিশ্বের সমস্ত সানাই!

আসুক কোকিল ধোঁয়াধূলি ঠেলে দিন কয়েক পরে,

হেভিডেসিবেল যন্ত্র আছে তৈরি অতন্দ্র দিনমান।

সুমশ্রিণ গলা না হয় শোনাবে খানিকটা ঘর্ঘরে,

এসেছে বসন্ত ঊর্ধ্বে-অধে দেখো জেগেছে উত্থান।

আলফ্রেড খোকন

একটি সন্ধ্যার অভিপ্রায়

গত বৃহস্পতিবার বাঁশপাতার মতো ধারালো সন্ধ্যায়

নিউ ইস্কাটন সড়কের কিনারে

আলো-আঁধার কারখানার সামনে রিকশা থেকে নামতেই

হঠাৎ এক এক সুদর্শনা

এতটা পাশ দিয়ে নিজেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল যেই

পেছনে বন্ধুর ডাক সামনে রিকশাওয়ালার ভাড়া দিতে গিয়া

হারিয়ে ফেলি নিজেকেই;

তখন রাস্তার ওপারের বন্ধুও যায়, চলে যায় আকর্ষণীয়া।

দেহের অথই বাঁকে মৃদু মৃদু আঁধার

আর বাতাসের চাঞ্চল্যে সন্ধ্যার এই মনোলীনা

চলে গেলে তাকে আর কোনো দিনই ধরতে পারি না;

চিরকাল এই হয়, মনে রাখতে যেয়ে তাকে

মনে রাখতে হচ্ছে তারও চলে যাওয়াকে;

মুঠোভর্তি সম্পর্ক নিয়া

আমরা যদিও কেউই কারও কিছু না-ই হই

একটি মুহূর্তের কাছে কেন যে হঠাৎ দাঁড়িয়ে রই!

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

পথ

দুনিয়ার সব থেকে দক্ষিণে

তোমার চুলের ঘ্রাণ ঝরানো গন্ধরাজের বন

আমি আজীবন উত্তরের মানুষ

এখানে বাগান জোড়া গন্ধহীন ফুল

বাতাসে নীল আগুন ভেসে থাকে

দুনিয়ার সবচেয়ে অন্ধকারে

তোমার চোখের দীপ জ্বালানো জোনাক-রঙিন ঘর

আমার আমরণ সূর্যমুখী মন

এখানে সারা দুপুর সাদা রোদের ঘুম

আকাশে লাল শিমুল ফুটে থাকে

তোমার রক্তের সুরে

সহস্র ঘোর আর্তনাদ

দূর দক্ষিণ থেকে উত্তরে

দিক হারিয়ে দিগন্তরে

আমাকে কেবল শূন্য হাতে

খুন করে

খুন করে

খুন করে

মাসুদ খান

ভাবাধিনায়ক

তোমার উৎফুল্ল হরতনের রাগরক্তিম ব্যঞ্জনা এসে লাগে

আমার সাজানো তাসে। কী ভাব জাগালে ওহে ভাবাধিনায়ক,

আকাশে বাতাসে আর আমাদের প্রথাসিদ্ধ তাসের সংসারে!

ফুটে ওঠে লজ্জারং, জেগে ওঠে রংধনুরূপ, ব্যাকুল তাসের সেটে।

হে ভাবের কমান্ডার, বোঝা ভার এ হরতনি লীলাটি তোমার।

রক্তপ্রভা ফুটে ওঠা স্পন্দমান তাসকেই করেছ হে তুরুপের তাস—

অব্যর্থ, মোক্ষম।

পুনরায় টেক্কা মেরে দিয়েছ ঘায়েল করে সব উপশম, একদম।

নাজমীন মর্তুজা

তুমি সর্বনাম

ব্যাকরণে পেলাম তোমায়—

যদিও তুমি আমার

শব্দ

বাক্য

পদ

বর্ণ

অক্ষর...

বর্ণমালা, স্বর-ব্যঞ্জন ঘুরে

হ্রস্বস্বর দীর্ঘস্বর

মূলস্বর গুণস্বর

বৃদ্ধিস্বর—

তারপর ঘাত থেকে ঘাতে বর্ণের উচ্চস্বর!

যতই করি দ্বিত্ব, তুমি সন্ধিতে সাম্য;

আমি বিদেশি শব্দ—বেশ তো!

তুমি সংখ্যা বচন কারণ ও পদে

কেন করো ক্রিয়ার বর্তমান আমায়!

তুমি-আমি সম্বন্ধ পদ,

আমাদের কর্তৃ কর্ম

করণ সম্প্রদান

অপাদান অধিকরণ—

সবই তো পাক খায় সমাপিকা-অসমাপিকায়!

তবু কি এড়িয়ে যাব ক্রিয়ার প্রয়োগ?

যদি সারাটা সময়

তুমি-আমি মজে থাকি

নিষেধার্থক ক্রিয়ায়,

তবে অসমাপিকার প্রয়োগ কেবল থেমে যাবে

দ্বন্দ্বে, নিত্য সমাসে।

আমার উপমিতে উপমানে অব্যয়ীভাবে

অলুকে থেকো—

মধ্যপদলোপীতে পিছলে কী লাভ বলো?

কী লাভ সরল, যৌগিক ও জটিল বাক্যে হৃদয় খনন করে!