চৈত্রঘেরা এই বসন্ত

প্রমথ চৌধুরী একবার রসিকতা করে বলেছিলেন যে ‘বাংলার বসন্ত প্রকৃতিতে নেই’। আছে ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায়। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালে কটা দিনই–বা আমরা পাব, যা বসন্তের সত্যকার অনুভূতিতে ভরা। তাঁর কথা হয়তো কিছুটা সত্যি। আমাদের বসন্ত যেন আসার আগেই হারিয়ে যায়। এ বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী। ফলে পরিপূর্ণ বসন্তের স্বাদ আমাদের জীবনে খুব একটা নেই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আমার ধারণা যে মানুষ স্পর্শকাতর, যাদের অনুভূতি তীক্ষ্ণ বা শাণিত, তারা কেবল বসন্তের নয়, সব ঋতুর আগমনেই কম-বেশি সাড়া দিতে পারে। পরের ঋতুতে আগের ঋতুর গড়িয়ে চলার নিঃশব্দ গতির আলাদা ছন্দকে নিজের অগোচরে টের পায়। এমন মানুষ পৃথিবীতে অনেক।

সব দেশে ঋতুর সংখ্যা সমান নয়। পৃথিবীর মরুভূমিগুলোর কোনো কোনো অঞ্চলে বা উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দেশগুলোতে হয়তো সারা বছরে ঋতু মাত্র একটি। কোনো কোনো অঞ্চলে ঋতু দুটি বা তিনটি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ঋতু চারটি। এসব দেশের প্রতিটি বছর যেন ভিন্ন চারটি উজ্জ্বল রঙের পাপড়িওয়ালা একেকটি বর্ণাঢ্য ফুল। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বছরে ঋতু ছয়টি। এসব এলাকায় ঋতুগুলো একে অন্যের সঙ্গে এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে, যেন প্রকৃতির বুকে একগুচ্ছ ফুলের পাপড়ি। ফলে আমাদের ঋতুগুলো প্রকৃতির ভেতর কেবলই নিঃশব্দে বদলে চলে। ঋতুর বৈচিত্র্যের এ যেন এক নিরন্তর শোভাযাত্রা। এ বদল এমনই মৃদু ও অগোচর যে তীব্র সংবেদনশীল মানুষের পক্ষেও বুঝে ওঠা কঠিন। যেন আমাদের ঋতুচেতনা টের পাবার আগেই বদলে যায় আমাদের ঋতুর নাম। তাই আমাদের হৃদয়জগৎ টের পাবার আগেই আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা পেয়ে যাই এই পালাবদলের খবর। প্রতিটি ঋতু বদলের শুরুতে তাই প্রায়ই মানুষকে বলতে শুনি, ‘শরীরটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতা প্রায় অনিবার্যভাবে বলে উঠবেন, ‘ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে তো! তাই...।’

প্রায় জোয়ার-ভাটার মতো আমাদের দেশের ঋতুগুলো কেবলই পাল্টে যাচ্ছে। একটা ঢেউ উঠতে না উঠতেই মিলিয়ে যাচ্ছে পরের ঢেউয়ের ভেতর। আমাদের মধ্যে যাঁরা কবি–শিল্পী—তীক্ষ্ণ ঋতুচেতনার কারণে এই ঢেউগুলোর প্রতিটির শব্দ তাঁদের কানে আলাদা করে ধরা পড়ে। এই উপমহাদেশের ধ্রুপদি সংগীতে আমাদের প্রতিটি ঋতুর বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য উপস্থাপন লক্ষ করি আমরা। গানের সুরে প্রতিটি ঋতুর অন্তর্গত আর্তস্বর যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। কবিতার ভাষা সংগীতের তুলনায় অনেক প্রত্যক্ষ বলে আমাদের কবিতায় এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট। গান, কবিতা, চিত্রকলা ও নৃত্যে সমানভাবে এই সব ঋতুর আবহ ছড়িয়ে আছে। তাই ঋতুর জীবন্ত চেহারা চারপাশের প্রকৃতিতে সব সময় না পেলেও শিল্পীদের সৃষ্টির ভেতর প্রতিটি ঋতুর অনুভূতি আমরা টের পাই।

শীতপ্রধান দেশের বসন্ত আর আমাদের বসন্ত এক নয়। সেখানে বসন্ত আসে নির্মম তীব্র শীতের পর। তাই শীত কমলেও শীতের মিষ্টি আমেজ তখন প্রকৃতিজগতে থেকে যায়। তাই ওসব দেশের বসন্ত আমাদের তুলনায় অনেক স্নিগ্ধ আর কমনীয়। বসন্ত নিয়ে লেখা একটা ইংরেজি কবিতা উদ্ধৃত করে ব্যাপারটা তুলে ধরি:

‘স্প্রিং, দ্য সুইট স্প্রিং
দ্য ইয়াস জেজেন্ট কিং
দেন বুজুমস ইচ থিং
অ্যান্ড মেডস ডান্স ইন আ রিং
কোল্ড ডাজনট স্টিং
দ্য প্রিটি বার্ডস ডু সিং।’
(টি. নাস)

পাশ্চাত্যে শীতের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার যে আনন্দ, সেটাই ওদের বসন্তের মূল সুর। কিন্তু আমাদের দেশে বসন্ত তেমন নয়। আমাদের দেশে শীতের ভেতর থেকে আগুনের জ্বলন্ত খরস্পর্শ নিয়ে এর আবির্ভাব। তাই আমাদের বসন্ত স্নিগ্ধ বা কমনীয় নয়। ওমর খৈয়াম লিখেছেন:

‘ইন দ্য ফায়ার অব স্প্রিং

লেট দ্য উইন্টারি গারমেন্ট

অব রিপেনটেনস ফ্লিং।’

আগুনের সঙ্গে এর সম্পর্ক সরাসরি। আমাদের দেশেও ফাল্গুন-চৈত্রের উষ্ণ-তপ্ত আগুনে বসন্তের অভিষেক:

‘শীত উড়ে চলে যাচ্ছে চারধার থেকে

ধূসর কার্নিশ ছেড়ে,

চিলেকোঠা ছেড়ে

গাছের মিনার থেকে চলে যাচ্ছে

বসন্ত আগুনে।’

আমাদের সত্যিকার বসন্তকে আমরা পাই ফাল্গুনে—যখন শীতের আমেজ প্রকৃতি থেকে বিদায় নেয়নি, কিন্তু গ্রীষ্ম অগোচরে তার রক্তাক্ত বল্লম নিয়ে প্রকৃতির অঙ্গনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ফাল্গুনে বিশুদ্ধ বসন্তের আমেজ থাকলেও চৈত্রে বসন্তের পরিপূর্ণ স্বাদ নেই। চৈত্রের অনেকাংশই যেন রুক্ষ–রুদ্র বৈশাখের দখলে। তার শেষ ভাগ যেন আধা গ্রীষ্ম, আধা বসন্ত। এই সময়কার চৈতি হাওয়াই বলে দেয় মধুর বসন্তের দিন প্রায় শেষ। এর খরতপ্ত রুদ্র দাহই প্রকৃতির বুকের ওপর জাগিয়ে তোলে এই চৈতি হাওয়ার মরশুম, যা বৈশাখের দিকে বেড়ে বেড়ে একসময় কালবৈশাখীতে রূপ নেয়। সারা প্রকৃতিকে তোলপাড় আর লন্ডভন্ড করে, আর তারও পরে শেষ হয় বর্ষার অঝোর ধারার মধ্য দিয়ে।

আগেই বলেছি, আমাদের বসন্ত উষ্ণতার স্পর্শে জ্বলন্ত, এ শুধু মধুময় নয়। এর মধ্যে রয়েছে আগুনের দাহ—যা আমাদের হৃদয়কে, প্রাণকে, আমাদের রক্তপ্রবাহকে জাগিয়ে তুলে জানায় তার আগমনবার্তা। বসন্তের দূত কোকিলের মতো এর কণ্ঠও শুধু মধুর নয়, যন্ত্রণাজ্বলিতও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘বইল প্রাণে দখিন হাওয়া আগুন-জ্বালা।’ দখিন হাওয়ার মধ্যে যে অগ্নিস্পর্শ আছে সে ব্যাপারে প্রকৃতিপ্রবণ রবীন্দ্রনাথের ভুল হবার কথা নয়। তাই বসন্ত শুধু প্রকৃতিজগৎ বা পরিপার্শ্বকে নয়, আমাদের শরীরকে, মনকে, আমাদের গোটা অস্তিত্বের গভীরতাকে তার উষ্ণতার তপ্ত স্পর্শে শিউরে তোলে। এ কারণে অধিকাংশ ভাষার সাহিত্যেই বসন্তকে বলা হয়েছে ঋতুরাজ।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বসন্তের রক্তিম উপস্থিতি ততটা প্রত্যক্ষ না হলেও তাঁর কবিতার সামগ্রিক অবয়ব বসন্ত-উচ্চকিত। রীবন্দ্রনাথের পরে বসন্তের বলিষ্ঠ উচ্চারণ পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। তাঁর বসন্ত উষ্ণ, শারীরিকভাবে জীবন্ত। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:

‘বল কেমনে নিবাই সখি বুকের আগুন!

এল খুন-মাখা তৃণ নিয়ে খুনেরা ফাগুন!

সে যেন হানে হুল্​খুনসুড়ি,

ফেটে পড়ে ফুলকুঁড়ি

আইবুড়ো আইবুড়ো

বুকে ধরে ঘুণ!

যত বিরহিণী নিম্​খুন-কাটা ঘায়ে নুন!

আজ লাল-পানি পিয়ে দেখি সবকিছু চুর!

সবে আতর বিলায় বায়ু বাতাবি নেবুর!

হলো মাদার আশোক ঘাল,

রঙন তো নাজেহাল!

লালে লাল ডালে-ডাল

পলাশ–শিমুল!

সখি তাহাদের মধু ক্ষরে-মোরে বেঁধে হুল্​!’

নজরুলের চেতনায় ফাগুন রক্তপিপাসু, খুনি। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় বসন্ত আবার অমোঘ, নাছোড়বান্দা: ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত।’

তবে এই বসন্তের আরও বেশি হত্যাকারী, বর্ণনা পাওয়া যায় সমর সেনের কবিতায়:

‘এখানে শিগগিরই বসন্ত নামবে

সবুজ উদ্দাম বসন্ত!

কিন্তু সাইকেলে-ফেরা কেরানির ক্লান্তিতে

দিনের পর দিন

ঘড়ির কাঁটায় মন্থর মুহূর্তগুলি মরে;

ডাস্টবিনের সামনে

মরা কুকুরের মুখের যন্ত্রণায়

সময় এখানে কাটে;

এখানে কি কোনোদিন বসন্ত নামবে

সবুজ উদ্দাম বসন্ত!

আর কোনোদিন কি মুছে যাবে

স্যাকারিনের মতো মিষ্টি একটি মেয়ের প্রেম!

উজ্জ্বল, ক্ষুধিত জাগুয়ার যেন

এপ্রিলের বসন্ত আজ।

বসন্তের এই অদ্ভুত মদিরতা রয়েছে জীবনানন্দ দাশের লেখাতেও। তিনি শীতের কবি, হেমন্তের কবি, বসন্তের নন। তবু বসন্তের ঘাতক পদচারণা তাঁকেও যেন অজান্তে রক্তাক্ত করে:

‘ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে—

বসন্তের রাতে

বিছানায় শুয়ে আছি;

—এখন সে কত রাত!

ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,

স্কাইলাইট মাথার উপর।’

জীবনানন্দ যেন সমুদ্রের স্বর আর বসন্তের হাহাকারের মধ্যে ঐক্য অনুভব করেছিলেন।

আমাদের সাহিত্যে বসন্তের অন্যতম সেরা বর্ণনা আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের লেখায়। তাঁর কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে রোহিনী যখন ঘাটের দিকে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ কোকিল ডেকে উঠল। এ কোকিল বসন্তসখা। বঙ্কিমে লিখছেন, ‘কোকিলের ডাক শুনিলে কতকগুলি বিশ্রী কথা মনে পড়ে। কী যেন হারাইয়াছি। যেন তাই হারাইয়া যাওয়াতে জীবনসর্বস্ব অসাড় হইয়া পড়িয়াছে। যেন তাহা আর পাইব না। যেন কী নাই। কেন যেন নাই। কী যেন হইল না। কী যেন পাইব না। কোথায় যেন রত হারাইয়াছি। কে যেন কাঁদিতে ডাকিতেছে। যেন এ জীবন বৃথায় গেল। সুখের মাত্রা যেন পুরিল না।’

কোকিলের বাসনা-মদির কণ্ঠ ক্রমাগত উচ্চগ্রামে উঠে একসময় সারা তল্লাটকে যেন কাঁদিয়ে চলে। কিন্তু ওই আর্তির উত্তর যেন কোকিল কোনো দিন পায় না। তার শূন্যতা পূরণ হবার নয়। বসন্ত–প্রকৃতির এই হাহাকার, শূন্যতা, একাকীত্ব—সব মিলে এক রক্তাক্ত আবেদন জাগিয়ে তোলে এই ঋতুরাজ বসন্ত।

আমরা ভাগ্যবান যে বাংলা সাহিত্যের বড় লেখকদের উত্থান এমন এক যুগে হয়েছিল, যখন আমাদের ঘরের পাশে জাগ্রত প্রকৃতি ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। তা না হলে হয়তো বসন্তের এই জীবন্ত রূপটিকে আমরা এই সাহিত্যে এমন বৈভবমণ্ডিতভাবে পেতাম না।

বসন্ত নিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাটি পেয়েছি কালিদাসের মেঘদূত-এ। সেখানে বিরহী যক্ষ তার প্রিয়তমার দেশের শ্রেষ্ঠতম সম্পদটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন: সে দেশে সারা বছর ঋতু কেবল একটিই, তার নাম বসন্ত।

আধুনিককালের কবিদের ভেতর এই ঋতুর মাদকতা হারিয়ে যেতে দেখছি। এর একটা বড় কারণ মনে হয় প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের জীবনের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা। আমাদের ঊষর-রুক্ষ নগরকেন্দ্রিক জীবনে কেবল বসন্ত নয়, পুরো ঋতুচেতনাটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির নিঃশব্দ সজীব পালাবদলের গল্প তাঁদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাই এ যুগের কবিদের মধ্যে বসন্ত যেন আর নতুন উদ্দীপনা জাগাচ্ছে না। বসন্ত প্ররোচিত কবিতা তাই এ যুগের অন্যতম বিরল সমগ্রী।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানে লিখেছিলেন: ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’ দরজার ওধারে জেগে বসে আছে উদ্গ্রীব বসন্ত। কী রোমাঞ্চকর এই বসন্তের চিত্র। কী উদগ্র আর জান্তব। কী রক্তপিপাসু আর সুন্দর। আসুন আমরাও পূর্ণিমা–জোছনায় এই উজ্জ্বল ক্ষুধিত জাগুয়ারের পায়ের শব্দের জন্য কান পেতে থাকি, চৈত্রের ভালোবাসায় উৎকর্ণ হই।