ভ্রমণ ও স্মৃতিচর্যা

ব্রাত্য বসু নির্দেশিত মীরজাফর নাটকের দৃশ্য। ছবি: দেশ পত্রিকার সৌজন্যে
ব্রাত্য বসু নির্দেশিত মীরজাফর নাটকের দৃশ্য। ছবি: দেশ পত্রিকার সৌজন্যে

বিনায়ক এখন বড় লেখক, ব্যস্ত লেখক, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। পত্রিকায় কলামও লেখে নিয়মিত। একটি কাগজে ওর লেখা দেখে ও পড়ে তা-ই মনে হলো। আগে, কয়েক বছর ধরে কলকাতা গেলেই প্রথমে ফোন করা হতো বিনায়ককে, তারপর রঙ্গীতকে, রঙ্গীত মিত্রকে। আমাদের অস্থায়ী নিবাসের কাছেই ছিল তার বসবাস। অবকাশও ছিল তার প্রচুর। শেষ খবর অনুসারে, রঙ্গীতের বসবাস কলকাতা থেকে বেশ অনেক দূরে। বিনায়ক কলকাতায় থাকলেও কোথায়, কত নম্বরে, জানি না তা। ব্যস্ত লেখক হলেও তার সঙ্গে আড্ডা হতোই বলে মনে হয় তো। বেশ অনেক দিন আগে কবিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন রণজিৎ দাশ। তাঁর কবিতা আমার পছন্দের। আমার কবিতাও তিনি চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর ও সাজ্জাদ শরিফের সম্পাদিত কবিতা-সংকলনের জন্য। যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। তারপর অনেক দিন আর যোগাযোগ নেই। অনেক দিনের বন্ধু কবি একরাম আলি, তাঁর বসবাস দূরে, সেই সল্টলেকে। অনেক দিন ধরে। তবু দেখা হয় সহজেই। তাঁর কলকাতার সদর স্ট্রিটের হোটেল এলাকায় আগমন যেমন সহজে হয়, তাঁর দূরবর্তী সল্টলেকের বাড়িতে যাওয়াও কঠিন মনে হয় না। তবে এবার আমাদের শান্তিনিকেতনে যাওয়ার বাসনা ছিল খুব, দিন দুই সেখানে কাটানোর। শেষ যাওয়া হয়েছে বেশ অনেককাল আগে। না, এবারও যাওয়া হলো না। নির্দিষ্ট দিনের ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেল না বলেই। আর বাসনা ছিল ছবি ও নাটক দেখার, যেমনটা প্রত্যেকবার থাকে। এমনভাবে বলা হলো যেন ঘনঘনই আমরা কলকাতা যাই। না, ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় না তা, নানা কারণেই। ছবি দেখা হলো দুদিনে দুটি, একটির নাম গলি বয়, পরিচালনা করেছেন জোয়া আখতার (কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতারের মেয়ে)। মনকে সারাক্ষণ টেনে ধরে রাখল এই ছবি। অভিনয় করেছেন রণবীর সিং ও আলিয়া ভাট। এমন গতিময় ছবি অনেক দিন দেখা হয়নি। র​্যাপ মিউজিকের পারফরমারের ভূমিকায় মাতিয়ে রেখেছিলেন রণবীর সিং। অন্যটির নাম, নগরকীর্তন। এ ছবিও ভিন্ন ধারার। টানল খুব। এ ছবির পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি। নাটকও দেখা হলো। মীরজাফর। ইতিহাসের খলচরিত্র মীরজাফর। তার যাবতীয় নৈতিক স্খলন, লোভলালসাসহ তাকে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র করে তুলতে যথেষ্ট সাহস ও মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন নাট্যকার ব্রাত্য বসু। মঞ্চে মীরজাফররূপে গৌতম হালদার, ক্লাইভ চরিত্রে ব্রাত্য বসু এবং মীরণরূপে কাঞ্চন মল্লিকের অভিনয় ছিল অনবদ্য।

কলকাতায় আমার সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গাটি হচ্ছে কলেজ স্ট্রিট, যেখানে গেলে পছন্দের বই ও নানা সাহিত্যপত্র দেখা ও বেছে নিয়ে কেনা সম্ভব হয়। দিন দশেক ছিলাম আমরা কলকাতায়, তার মধ্যে অন্তত চার দিন কলেজ স্ট্রিটে যেতে হয়েছে আমার, বইপত্র কিনতে ও দেখতে। ভ্রমণার্থী সবাই জানেন, কত সহজ, কতই না সহজ কলকাতায় এখানে-ওখানে যাওয়া। মেট্রো ট্রেনের কারণে বিশেষত।

এ পর্যন্ত লিখে মনে হলো, না, আমার অনেক আকর্ষণের আরও একটি জায়গা আছে কলকাতায়, যেখানে যাই, না যাই, রবীন্দ্রনাথের কথা মনে আনতেই হবে।

যতবার গিয়েছি কলকাতায়, জোড়াসাঁকোয় যেতে হয়েছেই অন্তত একটিবার। এবারও তা-ই হলো। একটি দুপুর ও বিকেল রাখতেই হলো রবীন্দ্রনাথকে মনে আনতে। মেট্রোতে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জোড়াসাঁকোর কাছাকাছি স্টেশনটিতে। কী এক ঘোরের মধ্যে ঘণ্টা তিনেক কেটে গেল রবীন্দ্রস্মৃতিজড়িত বাড়িটিতে।

শহীদুল জহির মনে এলেন ফের

প্রিয় বন্ধু, প্রিয় লেখক শহীদুল জহিরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অনেককাল আগে, আনুমানিক উনিশ শ ছিয়াশি-সাতাশি সালের দিকে, যখন বেইলি রোডের সরকারি ফ্ল্যাটে আমরা ছিলাম, তিনিও সেখানকার আমাদের ওপরতলার একটি ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পেয়ে থাকতে এলেন। মনে পড়ে, পরিচয় হওয়ার কিছুদিন পরেই তিনি তাঁর প্রথম বই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নামের গল্পের বইটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আরও মনে পড়ে, বইটির নাম দেখে আমি প্রথমটায় তেমন আকর্ষণ বোধ করলাম না, শেলফের কোথাও যত্ন করে রেখে দিলাম। তবে ওপরতলায় তিনি ছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে নিয়মিতই দেখা হতে লাগল এবং ঘনিষ্ঠ হতে তেমন সময় লাগল না। তাঁর গল্প পড়তে আগ্রহ জন্মাল এবং পড়ে মুগ্ধ হলাম। এরপর থেকে আমাদের যখনই দেখা হতো, কথাবার্তা, আড্ডা হতো, তখন তাঁকে একটু দূরের এবং নিঃসঙ্গও মনে হতো। একটু-বা লাজুক (আমিও যে যথেষ্ট সপ্রতিভ, তা বলতে পারব না) শহীদুল জহিরকে নিয়ে আগেও কোথাও লিখে থাকব, তবে যত দিন যায়, ততই তাঁর কথা ভাবনায় ফিরে ফিরে আসে। এই সেদিন কবি ও লেখক পিয়াস মজিদের ফেসবুকে দেওয়া একটি লেখা থেকে জানলাম, শহীদুল জহির আমার দুটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। শহীদুল জহির একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন আমাকে আমার কবিতা অনুবাদের কথা, কিন্তু কোন কবিতা, কোথায় ছাপতে দিয়েছিলেন—সে কথা বলেননি। পিয়াসের কাছ থেকে পেলাম কবিতা দুটি। দুটি কবিতার একটির মূল ও অনুবাদের নমুনা এখানে দিচ্ছি। প্রথমে বাংলা কবিতা এবং পরে ইংরেজিতে অনূদিত কবিতাটি পড়া যাক:

এমন ভঙ্গিতে বলো

আজ অনেক ঘটনা ঘটেছে

কালও অনেক ঘটবে যে বোঝাই যায়

পরশুও

কিন্তু আর এক বছর পরই এগুলো

হয়ে উঠবে রটনা

বরং বাওবাব গাছের কথা ফিরে বলো আবার

দশ বছর আগে বলেছিলে

এমন ভঙ্গিতে বলো

এমন ভাষায়

মনে হবে

এখন থেকেও দশ বছর পরের

কোনও লাইটহাউজে বসে তুমি বলছ

এবার শহীদুল জহিরের ইংরেিজ অনুবাদে আমার কবিতার নাম ও কয়েকটি পঙ্​ক্তি:

Say In Such Manner

Many things happened today

And it could be understood that

Many things will also

happen tomorrow

And day after tomorrow

but just after a year all these

will become rumour

Better say about acacia tree again.

শহীদুল জহিরের মতো প্রতিভাবান বড় লেখকের কাছ থেকে এমন মনোযোগ পাওয়াকে আমি সৌভাগ্য মনে করি।