রাজশাহীর শখের হাঁড়ি

‘বৈশাখী আর গ্রমীণ মেলায়

শিশু-বুড়ি নানিরা যায়

শখের মাটির হাঁড়ি ছাড়া

নানিদের হাত কি মানায়।...

নানা হে।’

রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী নাট্য গম্ভীরার নানা-নাতির কথপোকথনে এভাবেই এসেছে এ অঞ্চলের বিখ্যাত শখের হাঁড়ির কথা। মেয়ের বিয়েতে শখের হাঁড়িভর্তি মিষ্টি উপহার হিসেবে পাঠানো হবে, একসময় এটা ছিল রাজশাহীর মানুষের বিশেষ রীতি। বিশেষত ওই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি তথা মানুষের জীবনযাপনে শখের হাঁড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত।

রুক্ষ আর বন্ধুর বরেন্দ্রভূমিতে সুদূর অতীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইতিহাসখ্যাত মৃৎশিল্পী বীতপাল ও ধীমান। তাঁদের মতো আরও অসংখ্য শিল্পী বরেন্দ্রভূমিতে হাজার বছর আগে তৈরি করেছিলেন চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের বিখ্যাত এক ঘরানা। সেই ঘরানার ক্ষয়িষ্ণু এক ধারা আজও প্রবহমান রাজশাহী জেলার বিভিন্ন গ্রামে কুমারদের ঘরে ঘরে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কুমারেরা নকশাদার হাঁড়ি তৈরি করলেও বিষয়বৈচিত্র্য এবং ব্যবহার উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রাজশাহীর চিত্রিত শখের হাঁড়িই বিখ্যাত।

রং দিয়ে নকশা আঁকা বিশেষ ধরনের হাঁড়িই হচ্ছে শখের হাঁড়ি। শৌখিন জিনিস হলেও প্রাত্যহিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। মূলত খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো চিত্রিত শখের হাঁড়ি। রান্না বা শোবার ঘরের চালে পাটের তৈরি শিকায় ঝুলিয়ে রাখা হতো এ হাঁড়ি। তাতে রাখা হতো বিভিন্ন ধরনের খাবার। এ ছাড়া নতুন আত্মীয়ের বাড়িতে মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য উপহার হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হতো এটি। প্লাস্টিক, কাচ প্রভৃতি দিয়ে তৈরি তৈজস সহজলভ্য হওয়ার কারণে বর্তমানে শখের হাঁড়ির ব্যবহার উপযোগিতা কমে গেছে অনেক। এর ফলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা বন্ধ করে দিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বসন্তপুর গ্রামের মাত্র একটি পরিবার এখন শখের হাঁড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। এই পরিবারের প্রধান সুশান্ত কুমার পাল। এই একটি পরিবারই এখন রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শিল্প শখের হাঁড়িকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

সুশান্ত পাল জানান, একসময় রাজশাহী অঞ্চলের শখের হাঁড়ির প্রধান তিনটি ঘরানা ছিল। এগুলো হলো—সিন্ধুকুশমী (বয়া)-হরগ্রাম-বসন্তপুর ঘরানা (রাজশাহী অঞ্চল); বাঙালপাড়া-মহৎপুর-ঢেঁকিপাড়া ঘরানা (নাটোর অঞ্চল) এবং বারঘরিয়া-প্রেমতলী-বালীরহাটা-বাস্তুপুর ঘরানা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল)। বর্তমানে এই তিনটি ঘরানার মধ্যে টিকে আছে শুধু সিন্ধুকুশমী-হরগ্রাম-বসন্তপুর ঘরানা। এই ঘরানার চিত্রিত হাঁড়ির জমিনের রং হলুদ ও সাদা। হাঁড়ির শরীরে লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি বা খয়েরি রঙে আঁকা থাকে পদ্ম, মাছ, ধানের ছড়া, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, সিঁদুরের কৌটা ইত্যাদি মোটিফ।

শিল্পী সুশান্ত পাল জানালেন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী নয় বিভিন্ন কারণে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাঁর অবর্তমানে শখের হাঁড়ির ঐতিহ্য মুছে যাবে চিরতরে।