প্রবাদ-প্রবচনের পেছনের গল্প

একটি ভাষার প্রবাদ-প্রবচন সে ভাষার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। এই সম্পদ হস্তান্তর করা যায় না। অর্থাৎ এগুলোকে অনুবাদ করে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তবু কিছু কিছু অনুবাদ হয়।

বাঙালি যখন বলে ‘আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবরে কাজ কী?’—তখন তার অন্তর্নিহিত অর্থ কেবল বাঙালির পক্ষেই বুঝে ওঠা সম্ভব। ভিন্ন ভাষাভাষীর নয়।

আমার প্রয়াত বন্ধু ফারুক ছিল অসম্ভব প্রাণবন্ত ও রসিক। কথায় কথায় সে ফোড়ন কাটতে ভালোবাসত। তার প্রিয় কাজ ছিল বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচন তার নিজস্ব স্টাইলে মুহূর্তের মধ্যে ইংরেজি করে ফেলা। তো, তার স্টাইলে প্রবাদটির ইংরেজি দাঁড়িয়েছিল, ‘বিয়িং আ জিনজার মার্চেন্ট, হোয়াই শুড আই গো ফর শিপ?’

প্রবাদটির ফারুকের করা ইংরেজি কেমন হয়েছে, তা নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। তবে অনুবাদ যা–ই হোক, শব্দগুলো ইংরেজদের কাছে অপরিচিত ঠেকবে না। পুরো বাক্যটি যার কাছে মনে হবে অর্থহীন, সে ভ্যাবাচ্যাকার মধ্যে পড়বে। কিন্তু প্রবাদটির মূল অর্থ যদি তাকে বুঝিয়ে বলা হয়, তখন তার আক্কেল গুড়ুম হবে।

প্রবাদবাক্যের আলাদাভাবে শব্দ ও শব্দের অর্থ জেনে তাই কোনো লাভ নেই। জানতে হবে পুরো বাক্যের মর্মার্থ। প্রবচনের বেলাতেও তাই। ‘নয়-ছয় করা’ একটি প্রবচন। নয়-ছয়কে আলাদা করে দেখলে কোনো অর্থ পাওয়া যাবে না।

প্রতিটি প্রবাদ বা প্রবচনের পেছনে রয়েছে নানা চিত্র, নানা কাহিনি বা গল্প। গল্প-কাহিনিগুলোর কোনোটা পৌরাণিক, কোনোটা ঐতিহাসিক, কোনোটা আবার আধুনিক। এরই কিছু উদাহরণ নিয়ে এই রচনা।

পুরোনো কিছু দেখলেই আমাদের মুখে এসে যায় মান্ধাতার আমলের জিনিস। একালের তরুণ-তরুণীরা পুরোনো ধাঁচের পোশাক দেখলে বলে ওঠে, মান্ধাতার কালের ডিজাইন।

মান্ধাতার আমল আসলে কোন আমল, তা আমাদের জানা নেই। জানার দরকারও পড়ে না। মান্ধাতার আমল বা কাল একাল-সেকাল পেরিয়ে আমাদের মুখের কথায় এমনিতেই চলে আসে। এই প্রবচনের পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি।

মান্ধাতার আমল বা কাল শুধু প্রাচীন নয়, অতিপ্রাচীন—যাকে বলে পৌরাণিক কাল। ভারতীয় পুরাণের বিখ্যাত এক রাজার নাম মান্ধাতা। দিগ্বিজয়ে বের হয়ে তিনি বহু দেশ জয় করেন এবং ভ্রমণ করতে করতে সুমেরু পর্বতশিখরে উপস্থিত হন। সেখানে রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে তাঁর ভীষণ যুদ্ধ হয়। কিন্তু জয়-পরাজয় স্থির না হওয়াতে উভয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন।

সমগ্র পৃথিবী জয় করে মান্ধাতা স্বর্গ জয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়নি। দেবরাজ ইন্দ্রের কৌশলে মান্ধাতা মধু নামক রাজার পুত্র লবণের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন।

ভারতীয় পুরাণের এই রাজার নাম থেকেই বাংলা প্রবচন বা বাগধারায় মান্ধাতার আমল বা কাল কথাটি এসেছে।

কোনো জিনিস কবে তৈরি হয়েছে কিংবা কোনো ঘটনা কবে, কখন ঘটেছে—তা যখন নির্দিষ্ট করা যায় না, তখনই আমরা ‘মান্ধাতার আমল’ বা কাল প্রবচনের শরণাপন্ন হই।

মান্ধাতা স্বর্গ জয় করতে গিয়ে নিহত হন। কিন্তু ভারতীয় পুরাণের আরেক রাজা ত্রিশঙ্কু স্বর্গে যেতে গিয়ে আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে আটকে থেকে যান।

রাজা ত্রিশঙ্কুর এই হাল থেকে তৈরি হয়েছে বাংলা প্রবচন ‘ত্রিশঙ্কু অবস্থা’। এ অবস্থা হলো অনিশ্চিত অবস্থা। কোন দিকে যে যাবে, তা স্থির করতে না পেরে অনেকেই ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকে। এটা ব্যক্তি মানুষের বেলাতেও ঘটে, রাজনীতির বেলাতেও ঘটে।

ভারতীয় পুরাণের এই রাজা জীবিত অবস্থায় স্বর্গে যেতে মনস্থ করেন এবং এ কাজে ঋষি বিশ্বামিত্রের শরণাপন্ন হন। বিশ্বামিত্র তপোবলে ত্রিশঙ্কুকে আকাশপথে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বাধ সাধেন স্বর্গের দেবতারা। দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে তাঁরা ত্রিশঙ্কুকে মর্ত্যপথে ঠেলে দেন।

বিশ্বামিত্র ঋষিও কম যান না। তিনিও ত্রিশঙ্কুকে পৃথিবীতে নামতে দিলেন না। দেবতাদের একহাত দেখিয়ে দেওয়ার মানসে বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গের দিকে ঠেলতে শুরু করলেন। অন্যদিকে ঊর্ধ্বলোক দেবতারা ত্রিশঙ্কুকে মর্ত্যে পাঠানোর জন্য ধাক্কাতে শুরু করলেন। আকাশে সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। বিশ্বামিত্রের তেজও কম নয়। সুতরাং দেবতারা পড়লেন মহা সংকটে।

ভীত ও বিপন্ন দেবতাগণ তখন বিশ্বামিত্রের কাছে নিজেদের মান রক্ষার আবেদন জানালেন। এ অবস্থায় বিশ্বামিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, ত্রিশঙ্কু তাহলে আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করুক। অতঃপর বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুর থাকার জন্য নতুন এক নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করে দিলেন।

আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের নক্ষত্রলোক প্রসঙ্গে আরেকটি প্রবচনের কথা মনে পড়ে যায়। প্রবচনটি হিন্দু পুরাণ থেকে আসা নয়। প্রবচনটির জন্ম খ্রিষ্টানদের গল্প থেকে।

খ্রিষ্টানদের গল্প হলেও সে গল্প থেকে তৈরি প্রবচনটি এখন প্রায় সব ভাষার সম্পদ। বাংলায় প্রবচনটি হলো ‘বোকার স্বর্গ’।

অবাস্তব সুখকল্পনার মধ্যে থাকা কিংবা কল্পিত সুখে বিভোর থাকার অবস্থাকেই আমরা বোকার স্বর্গে বাস করা প্রবচন দিয়ে প্রকাশ করি। প্রবচনটি ইংরেজি ‘ফুলস প্যারাডাইস’ ইডিয়মের অনুবাদ।

মধ্যযুগে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ এমন এক মত প্রকাশ করেন, যা থেকে ফুলস প্যারাডাইস ইডিয়মের উৎপত্তি। তাঁরা বলেছিলেন, অপরিণত বুদ্ধির অথবা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ জীবনে যেসব ভুল করে থাকে, তার জন্য তাদের পাপ হবে না। কারণ, বুদ্ধি না থাকার জন্যই তারা ভুলগুলো করে থাকে। যেহেতু ঈশ্বর তাদের এই অবস্থায় ফেলেছেন, সে জন্য মৃত্যুর পর তাদের আত্মার বিচারও হবে না।

স্বর্গ যেহেতু কেবল পুণ্যবানদের জন্য, সেহেতু ওই সব আত্মা কোনো দিন স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার নরকেও তাদের যেতে হবে না এ কারণে যে পাপ করে থাকলে তা তারা করেছে না বুঝেই। অতঃপর তাদের স্থান হবে স্বর্গ ও নরকের বাইরে ভিন্ন এক স্থানে। আর এই স্থানেরই পরবর্তীকালে ব্যঙ্গার্থে নামকরণ হয় ফুলস প্যারাডাইস।

ঋষি বিশ্বামিত্র ও দেবতাগণের মধ্যে আকাশে ঘটা যে ধুন্ধুমার কাণ্ড, তা মাটির পৃথিবীতে হরহামেশাই ঘটে থাকে। যেকোনো কাণ্ডের তুলনায় ‘ধুন্ধুমার কাণ্ড’ অনেক বড় কাণ্ড। এটিও ভারতীয় পুরাণের ঘটনা।

ধুন্ধু নামে এক অসুর দারুণ তপস্যার বলে ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পেয়ে দেব-দানব-রাক্ষস সবারই অবধ্য হয়। কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না—এ রকম বর পেয়ে সে দেবতা, ঋষি—সবার প্রতি অত্যাচার শুরু করে।

ধুন্ধুর বাস ছিল বালুকাপূর্ণ এক সমুদ্রের তলায়। ওই সমুদ্রতীরে ছিলো মহর্ষি উতঙ্কের আশ্রম। ধুন্ধু সেই আশ্রমে সাংঘাতিক উপদ্রব শুরু করে দেয়। এতে মহর্ষির তপস্যায় বিঘ্ন ঘটে। উত্ত্যক্ত উতঙ্ক ধুন্ধুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দেবতা বিষ্ণুর আদেশে অযোধ্যার রাজা কুবলাশ্বের শরণাপন্ন হন।

কুবলাশ্ব তাঁর একুশ হাজার পুত্র ও অসংখ্য সৈন্য নিয়ে ধুন্ধু বধের জন্য যাত্রা করেন। এক সপ্তাহ ধরে সেই বালুময় সমুদ্রের তলদেশ খনন করার পর ধুন্ধুকে পাওয়া যায় ঘুমন্ত অবস্থায়। ধুন্ধু ঘুম থেকে জেগে উঠেই তার মুখনিঃসৃত অগ্নির তেজে কুবলাশ্বের আঠারো হাজার পুত্র ও সব সৈন্যকে ভস্ম করে ফেলে। কুবলাশ্ব তখন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে ধুন্ধুকে বধ করেন এবং ধুন্ধুমার নামে বিখ্যাত হন।

রাজা ধুন্ধুমারের ধুন্ধুবধের বিরাট আয়োজন ও সমাপ্তি নিয়ে ঘটা ব্যাপারটাই তুমুল কাণ্ড, বিষম গণ্ডগোল ইত্যাদি অর্থ নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড প্রবচনে পরিণত হয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়ে ‘পঞ্চম বাহিনী’ প্রবচনটি চালু হওয়ার আগে বাঙালির মুখে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ প্রবাদটি বেশ ব্যবহৃত হতো। প্রবাদটির সৃষ্টির মূলে রয়েছে মহাকাব্য ‘রামায়ণ’।

বিভীষণ রাক্ষসরাজ রাবণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। বিভীষণ কঠোর তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মার আরাধনা করেন। আরাধনায় তুষ্ট ব্রহ্মা বর প্রদানের জন্য বিভীষণের সম্মুখে উপস্থিত হলে তিনি ‘সকল অবস্থায় যেন ধর্মে মতি থাকে’—এই বর প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা পরম সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ওই বরের সঙ্গে অমরত্ব প্রদান করেন।

রাম-রাবণের যুদ্ধ উপস্থিত হলে বিভীষণ রাবণকে রামের সঙ্গে মিত্রতা করতে এবং সীতাকে প্রত্যার্পণ করতে উপদেশ দেন। রাবণ তাতে অসম্মত হয়ে তাঁকে অপমান করলে তিনি লঙ্কা ত্যাগ করে রামের আশ্রয় গ্রহণ করেন।

বিভীষণের এই কাজই বাংলা প্রবাদে নেতিবাচক রূপ লাভ করে। নিজ দেশ বা পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশকারী ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ঘরের শত্রু বিভীষণ প্রবাদটি।

পঞ্চম বাহিনী প্রবচন বাংলা সংবাদপত্রের আবিষ্কার। প্রবচনটির ব্যবহারও হয় শুধু সংবাদপত্রেই। সংবাদপত্রের আরও একটি প্রিয় প্রবচন হলো ‘শ্বেতহস্তী পোষা’। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের আলোচনায় কথাটা উঠে আসে। যখন কোনো প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানের পেছনে শুধুই অর্থব্যয় হয়, সরকার বা জনগণ কিছুই পায় না, তখনই লেখা হয়, সরকার একটা শ্বেতহস্তী পুষছে কিংবা শ্বেতহস্তীর পেছনে টাকা ঢালছে। শ্বেতহস্তী প্রবচনের পেছনের অর্থ—যার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।

শ্বেতহস্তী পোষা ইংরেজি ইডিয়ম থেকে ধার করা। থাইল্যান্ডকে আগে বলা হতো শ্যাম বা শ্যামদেশ। শ্যামদেশের পরিচিতি ছিল শ্বেতহস্তী বা সাদা হাতির দেশ হিসেবে। কেননা প্রাণীটি কেবল ওই দেশেই লভ্য।

শ্যামদেশের সব শ্বেতহস্তীর মালিক ছিলেন রাজা। শ্বেতহস্তী ছিল পবিত্রতার প্রতীক। রাজার ক্ষমতার স্মারক। জনগণের অর্থে শ্বেতহস্তী প্রতিপালিত হতো। এই হস্তীকে দিয়ে কোনো কাজ করানো হতো না।

রাজা যদি কোনো মন্ত্রী বা অমাত্যের প্রতি নারাজ হতেন, রাজার পক্ষ থেকে তখন তাকে উপহার দেওয়া হতো একটি শ্বেতহস্তী। উপহারের বার্তাটা ছিল পরিষ্কার: উপহার-প্রাপকের তখন হতো সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা। শ্বেতহস্তী পালতে গিয়ে তিনি ফতুর হতেন।

শ্যামরাজার এই অদ্ভুত উপহার থেকে ইংরেজরা তাদের ইডিয়মটি তৈরি করে। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তা ঢুকে যায়।

প্রবাদ-প্রবচনের কাজ জানা কথাকে একটু ঘুরিয়ে ভালো করে জানিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে থাকে বিদ্রূপের ছোঁয়া, কৌতুক-কটাক্ষ, রঙ্গরস। প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহারে বাক্যে আসে বৈচিত্র্য, আসে ব্যঞ্জনা। প্রবাদ, বিশেষত প্রবচন অল্প কথায় অনেক কথা বলে।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের গদ্যে এবং এমনকি সাধারণ গদ্যেও ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচনের সংখ্যা অতিশয় কম। যেটুকু হয়, তার মধ্যেও অসতর্কতা দেখা যায়। যেমন একটি পত্রিকায় দেখা গেল, ‘অসাড়ের তর্জনগর্জন সার’। গোটা প্রবাদটাই মাঠে মারা গেল। কথাটা অসাড় না অসার?

প্রবচনের অনুবাদেও হাস্যকর নিদর্শন দেখা যায়। ‘পিনপতন নীরবতা’ চালু হয়ে গেছে। চলুক। কিন্তু ‘ভূমিধস বিজয়’ কী বাংলা হলো? উদাহরণ আরও আছে। বলে কী লাভ হবে? অনূদিত শব্দটা বাংলা ভাষায় চলার যোগ্য কি না, সেটা ভেবে দেখতে হবে সবার আগে।