নারীদের কামনা-বাসনার শেকড়সন্ধানী পাঠ

‘ব্রত-উপবাসে আমি-গৌরি অরাধিল’—শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যে মালাধর বসু লিখেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে কত বিচিত্রভাবে ব্রতপার্বণের কথা বলা হয়েছে, শীলা বসাক প্রণীত বাংলার ব্রতপার্বণ পড়ার আগে সেটি ঠিকমতো মালুম হয়নি। বইটিকে এ বিষয়ক একটি আকরগ্রন্থই বলতে হবে। ব্রতপার্বণ নিয়ে শীলা বসাক গবেষণা করেছেন বহু বছর ধরে। সেই গবেষণার মূর্তরূপ এই পুস্তক। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। পরে ২০১৭ সালে বেরিয়েছে এর আনন্দ সংস্করণ।

বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ব্রতপার্বণ। বাংলার নারীরা যুগ-যুগ ধরে তাঁদের কামনা-বাসনা পূরণে নানা রকম ব্রত পালন করে আসছেন। লেখকের ভাষ্যে, ‘“বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ” এই বাংলা। এই বাংলায় এমন মাস খুব কমই আছে যে মাসে একটা না একটা কোনও ব্রত অনুষ্ঠান নেই। মানুষের কামনা-বাসনা পুরণের জন্য কৃত্য সম্পাদনই ব্রত অর্থাৎ কোনও কিছুর উদ্দেশ্যে নারীসমাজ আন্তরিকভাবে যে ক্রিয়াচার পালন করে তা-ই হল ব্রত।’ লেখক আরও জানাচ্ছেন, ব্রতপার্বণের উৎপত্তি সেই প্রাচীন কৃষি সভ্যতায়।

ব্রত নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। উল্লেখযোগ্য দুটি বই হচ্ছে অবনীন্দ্রনাথের বাংলার ব্রত, অন্যটি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার লোকায়ত পাল-পার্বণ। কিন্তু শীলা বসাকের আলোচ্য বইটিকে যে কারণে এ–বিষয়ক আকরগ্রন্থ বলা হচ্ছে তা হলো, এখানে তিনি ব্রতপার্বণের একটি সম্পূর্ণ রূপরেখা হাজির করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ—দুই বাংলার ব্রত এবং এ–বিষয়ক লোকগাথা নিয়ে এ গ্রন্থে বিশদ আলোচনা করেছেন তিনি। ব্রত-পরিচয়ের পাশাপাশি আছে ব্রতর মূল্যায়ন। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন রাজ্য ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ব্রতের তুলনামূলক বিশ্লেষণও, যা এ ধরনের বইয়ের ঐতিহ্যে নতুন সংযোজন বৈকি।

ঢাউস এই বইয়ে রয়েছে মোট ১৯টি অধ্যায়। আছে সহায়ক গ্রন্থপঞ্জির তালিকা ও শব্দসূচি এবং বিভিন্ন ব্রতের রেখাচিত্র। এসবই পাঠকদের বিস্তৃত পাঠের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ব্রতকথা অনুধাবনে সাহায্য করবে।

>

বাংলার ব্রতপার্বণ
শীলা বসাক
প্রচ্ছদ: ঢাকা চারুকলার পথ-সীমানার দেয়ালচিত্র ১৯৯৭, প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রথম আনন্দ সংস্করণ: আগস্ট, ২০১৭, ৫৫৪ পৃষ্ঠা, দাম: (বাংলাদেশে) ৮০০ টাকা।

প্রতিটি অধ্যায়ই ব্রতপার্বণের এক একটি অংশকে নিয়ে লেখা। যেমন প্রথম অধ্যায়টি লেখা হয়েছে ব্রতের সংজ্ঞা ও উৎস সন্ধান নিয়ে। পরে পর্যায়ক্রমে এসেছে ব্রতপার্বণের আচার ও ক্রিয়া, ব্রত পালনের কামনা ও বাসনা, ব্রতের নিয়মবিধি ও বৈশিষ্ট্য, ব্রতের শ্রেণিবিভাগ প্রভৃতি।

‘ব্রত: প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্য’ নামে একটি সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে বইটিতে। বিভিন্ন কাব্যের দোহাই দিয়ে এবং উদাহরণসহ এখানে আলোচিত হয়েছে তৎকালের ব্রতকথা নিয়ে। যেমন, এই বইয়ে মহাভারতের শান্তিপর্বে কাশীরাম দাসের বচন, ‘শুদ্ধচিত্তে ব্রত যেই করে আচরণ।/সর্ব্ব দুঃখ তরে সেই পাপ বিমোচন।।’ —এই দুই চরণ উদ্ধৃত করে শীলা জানিয়েছেন, শুদ্ধভাবে ব্রত পালন করলে যে সব দুঃখমোচন ও পাপমোচন ঘটে, সেই কথাটি।

কিন্তু কারা মূলত পালন করেন এই ব্রত? পুরুষেরা ক্ষেত্রবিশেষে কিছু পাল-পার্বণে অংশ নিলেও ব্রতকথা মূলত পালন করেন নারীরা। তবে সেখানে নারীর ভূমিকা কী? এর একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, ‘ব্রত: নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক অধ্যায়টিতে। যেমন মধ্যযুগের একটি ব্রতের ছড়ায় নারীরা বলতেন, ‘আর্শী আর্শী, আমার স্বামী পড়ুক ফার্সী।’ (পৃ.১৫৭) নারীদের মনস্কামনা ও আকাঙ্ক্ষার ভেতরে যেন সেই কালটিই ভেসে ওঠে।

এই বইয়ে বাংলার ব্রতপার্বণ সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা যেমন আছে, একইভাবে রয়েছে বিভিন্ন ব্রতর প্রেক্ষাপট ও উপকরণ নিয়েও নানা কথা। ‘ঘেঁটু ব্রত সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছে, রোগমুক্তির কামনায় এই ব্রত পালিত হয়।...এই পুজোয় লাগে ভাট বা ঘেঁটু ফুল ও দূর্বা।’

বাংলার ব্রতপার্বণের নানাবিধ আচারের তন্ত্রে তন্ত্রে যেভাবে বিভিন্ন সমাজিক সংস্কার এবং মানুষের কল্যাণ মিলেমিশে আছে, শীলা বসাকের বইটি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সবশেষে বলা যায় বইটি ব্রতপার্বণ বিষয়ে পাঠকদের সুস্পষ্ট ধারণা দেবে।