বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে বিদেশিদের বই

>বাংলাদেশের লোকসাহিত্য, লোকশিল্প ও সংস্কৃতির নানা বিষয়–আশয় নিয়ে বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা লিখেছেন বিস্তর বইপত্র। সেই সব বইয়ে তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে তাঁদের উপলব্ধি। বিদেশিদের এই বইগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত পাঁচটি বই সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন নুসরৎ নওরিন।

হেনরি গ্লাসি
আর্ট অ্যান্ড লাইফ ইন বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটনের অধ্যাপক হেনরি গ্লাসি রচিত বইটি ১৯৯৭ সালে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে বাংলাদেশের কুমারদের শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এখানকার মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন লেখক। উপরন্তু মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লেখক আধ্যাত্মিকতার জগতে শিল্পের একটি সংজ্ঞাও পেয়ে যান। সেই সঙ্গে বাংলার মৃৎশিল্পীদের থেকে পাওয়া শিল্পের সংজ্ঞাটি তিনি প্রয়োগ করেছেন এখনাকার বুনন, জাহাজনির্মাণ, পিতল, চিত্রকলাসহ অন্যান্য শিল্পকে বুঝতে। হেনরি গ্লাসির মতে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য উপকরণ দিয়ে যাঁরা দেব-দেবীর প্রতিমা গড়েন, তাঁরা যেন কবি, দার্শনিক অথবা ঐতিহাসিকের ভূমিকার প্রতিফলন ঘটান। তাঁর এই গ্রন্থ জীবন ও কর্ম এবং সেই সঙ্গে শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান হয়ে উঠেছে।

ক্লিন্টন বি সিলি ও লিওনার্দ নাথান
গ্রেস অ্যান্ড মার্সি ইন হার ওয়াইল্ড হেয়ার: সিলেক্টেড পোয়েমস টু দ্য মাদার গডেস

অষ্টাদশ শতকের প্রখ্যাত বাঙালি গীতিকার, বাংলা শ্যামাসংগীতের পথিকৃৎ রামপ্রসাদ সেন রচিত পদাবলির নির্বাচিত অংশের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্লিন্টন বি সিলি ও লিওনার্দ নাথান। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। রাধাকৃষ্ণের লীলা যে যুগে কীর্তনে বহুল ব্যবহৃত, সেই যুগে কালী দেবীর মাতৃরূপের শক্তি সাধনা করেছেন রামপ্রসাদ, জগজ্জননী রূপে জন্ম–মৃত্যু অভিভাবিকা দেবীর প্রণতিতে তিনি এনেছিলেন নতুনত্ব। ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না/ এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’—তাঁর এমনই একটি গান। দেবীর শরণবঞ্চিত ভক্তের বেদনা, আবার তাঁর আশ্রয়ে অমিত আনন্দ লাভ এবং তাঁর ধ্যানে মগ্ন পরম ধ্যানাবস্থা বিবৃত হয়েছে রামপ্রসাদের রচনায়। এই বইয়ে সিলি ও নাথান রামপ্রসাদের ‘শাক্তপদাবলি’ অনুবাদ করেছেন। রামপ্রসাদ সম্পর্কে অনুবাদকদ্বয়ের অনুধাবনও এখানে পাওয়া যায়।

হান্স হার্ডার
সুফিজম অ্যান্ড সেইন্ট ভেনারেশন ইন কনটেম্পরারি বাংলাদেশ: দ্য মাইজভান্ডারীজ অব চিটাগং

জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হান্স হার্ডার রচিত বইটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। বাংলার সুফি ধর্মতত্ত্ব, সুফিদের জীবন ও আধ্যাত্মিক ধারার বাংলা গান হিসেবে মাইজভান্ডারী মরমি সংগীতকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক এখানে বাংলায় ইসলামের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন।

উনিশ শতকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডারী গ্রামের সৈয়দ আহমদউল্লাহ প্রবর্তিত মাইজভান্ডারী ধারার অনুসারীরা মারিফত ধারায় জিকির, ধ্যান ও আধ্যাত্মিক গান করতেন। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে ভক্তরা আল্লাহ, নবী ও পিরদের প্রতি প্রশস্তিমূলক এই ধারার গানে আত্মাশুদ্ধি করেন। শতাধিক কবি এ ধারায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। বহুলনন্দিত ‘গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী স্কুল খুইলাছে’ তেমনই একটি গান। চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারী মরমি সংগীতের মধ্য দিয়ে এ দেশে ইসলামের বিকাশ ও সুফিবাদকে বুঝতে হার্ডার সাংস্কৃতিক নৃ–তত্ত্ব, ইসলাম শিক্ষা, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন।

ম্যারি ফ্রান্সেস ডারহাম
জারিগান: মুসলিম এপিক সংস অব বাংলাদেশ

ম্যারি ফ্রান্সেস ডারহাম রচিত জারিগান: মুসলিম এপিক সংস অব বাংলাদেশ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। জারি শব্দের ফারসি অর্থ ক্রন্দন, বিলাপ বা প্রচার করা। এই আখ্যানমূলক গান কারবালার হৃদয়বিদারক বিয়োগান্তক ঘটনাকে কেন্দ্র করে হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্মরণে গাওয়া হয় মহররম মাসে। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন ম্যারি ফ্রান্সেস ডারহাম। কবি জসীমউদ্​দীনের সংস্পর্শে আসার পর মূলত তাঁরই উৎসাহে জারিগানের ইংরেজি স্বরলিপি রচনা করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে জসীম উদ্​দীনের ধারণকৃত জারিগানের রেকর্ড বারবার শুনে সেগুলোর স্বরলিপি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। ১৯৯৩ সালে লেখক আবার বাংলাদেশে আসেন জারিগান বিষয়ে তাঁর অসমাপ্ত গবেষণা শেষ করতে এবং আগের সূত্র ধরে জারিগানের সেই শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বইটিতে লেখক সমসাময়িক জারি গায়কদের বর্ণনা দিয়েছেন। মুসলমানদের মহররম উৎসব থেকেই এই ধারার অনেক গানের সৃষ্টি, তবে এর বিষয়বস্তু কেবল মহররমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই বইয়ে জারি গানের শিল্পী, তাঁদের পরিবেশনা, বাদ্যযন্ত্র, মহররম অনুষ্ঠান ইত্যাদির ছবিসহ ম্যারি ফ্রান্সেস ডারহামের রেকর্ডকৃত জারিগানের একটি অডিও ক্যাসেটও রয়েছে।

ফ্রান্স ল্যাসনিয়ের
রিকশা আর্ট ইন বাংলাদেশ

ফ্রান্স ল্যাসনিয়ের রচিত বইটি ২০০২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের প্রতিপাদ্য—বাংলাদেশের রিকশা ও বেবিট্যাক্সি চিত্রকলা। শুধু প্রাথমিক রংসমূহ ব্যবহার করে বাংলাদেশের লোকশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসেবে রিকশা ও অটোরিকশাতে ট্রাফিক চিত্রকলার বিকাশ হয়েছে। এখানে একটি রিকশার প্রতি বর্গ ইঞ্চিকে অলংকৃত করা হয়। একটি বাহন হিসেবে শহরের এই চলমান ক্যানভাসে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা, লেকের পাড়ে কোনো গাছের ডালে বসা পাখি, দালান-কোঠা, প্রার্থনারত মানুষের ছবি ইত্যাদি ঘুরে-ফিরে আসে। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আয়োজিত এক কর্মশালা থেকে তোলা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে এই বইয়ে। রিকশা চিত্রকলায় বাংলাদেশের মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বড় অংশের জীবন, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা যে প্রতিফলিত হয়, লেখক সে কথাই তুলে ধরেছেন তাঁর বইয়ে।

সূত্র: আমাজন, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ও দ্য ট্রাভেলিং আর্কাইভডটওআরজি।