খাঁটি বাঙালিত্বের প্রকাশ

জসীমউদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১ মার্চ ১৯৭৬), ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
জসীমউদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১ মার্চ ১৯৭৬), ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

একসময় গ্রাম এলাকায় একধরনের কথক থাকতেন। তাঁদের কাজ ছিল গল্প-কেচ্ছা বলে ছেলেবুড়ো সবার মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেওয়া। কখনো কখনো তাঁদের একটা নাম দেওয়া হতো। কে, কখন কেন এই নাম দিয়েছিল তা জানা যায় না। কিন্তু সবাই তাঁদের ওই নামেই ডাকত। যেমন, কবি জসীমউদ্​দীনের বাল্যকালে ছিলেন এক ‘পিসেমশাই’। আসল নাম সূর্যকুমার রায়। কে তাঁকে প্রথম ‘পিসেমশাই’ ডেকেছিল জানা যায় না। কিন্তু তিনি ছেলেবুড়ো সবার ‘পিসেমশাই’ ছিলেন। জসীমউদ্​দীন বলেছেন, ‘তাঁকে লইয়া ছোটদের সঙ্গে বড়দের কাড়াকাড়ি পড়িত। আমাদের দুঃখের সীমা থাকিত না, যখন আমাদের গল্পের আসর হইতে অভিভাবকেরা তাঁকে ডাকিয়া লইয়া যাইতেন গল্প শুনিতে। হাত-পা নাড়িয়া, নানা অভিনয় করিয়া তিনি গল্প বলিতেন না। কিন্তু তাঁর বলার মধ্যে কী যে ছিল, তাহা খুঁজিয়া পাই নাই। তাঁর দুইটি চোখই ছিল যেন সকল হাসির মূল। গল্প বলিতে এমন করিয়া চাহিতেন, আমরা হাসিয়া ফাটিয়া পড়িতাম।’ ছেলেবেলায় জসীমউদ্​দীন পেয়েছিলেন তাঁর অন্ধ দাদা দানু মোল্লাকে। এই দাদার পেট গিজগিজ করত খালি গল্প-কেচ্ছায়। সন্ধ্যা হলেই উঠানে পাটি পেতে ছেলেবুড়োদের আসর বসত দানু মোল্লার গল্প-কেচ্ছা শোনার জন্য। দানু মোল্লা যখন গল্প বলতেন, তখনকার এক বর্ণনা দিয়েছেন জসীমউদ্​দীন তাঁর জীবন কথা বইয়ে, ‘কেচ্ছা বলিবার সময় তিনি আঙুলে তুড়ি দিয়া, দুই হাত ঘুরাইয়া ফিরাইয়া, কণ্ঠস্বর কখনও বিলম্বিত লয়ে টানিয়া, কখনও দ্রুত লয়ে খাটো করিয়া, কখনও ধমকের সুরে, কখনও আবেগমিশ্রিত সুরে, কখনও জোরে জোরে দাপটের সঙ্গে, কখনও ফিসফিস করিয়া মনে মনে কথা বলার মতো করিয়া, কাহিনীর বিষয়বস্তুটিকে তিনি শ্রোতাদের মধ্যে জীবন্ত করিয়া তুলিতেন।’ জসীমউদ্​দীন আসলে নিজেও বাঙালির কথকসংস্কৃতিরই একজন ছিলেন। তিনিও শিশুদের বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে জমিয়ে গল্প বলতে পছন্দ করতেন। একবার তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্রা’ নামে যে ঘর ছিল, সেই ঘরের হলে জসীমউদ্​দীনের গল্প বলার আয়োজন করা হলো। সেই গল্প শোনার জন্য ঠাকুরবাড়ির যত ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী—সবাই এসে হাজির হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের দুই ভাই গগনেন্দ্রনাথ ও সমরেন্দ্রনাথ তো আগেই এসে আসন দখল করে বসে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সকল সুরের ভান্ডারি বলা হয় যাঁকে, সেই দিনেন্দ্রনাথও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ছিলেনই। কথকের আসনে বসে সেবার জসীমউদ্​দীন সবাইকে গল্প শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন। এই গল্প বলা তিনি শিখেছিলেন গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ দরিদ্র কথককুলের কাছ থেকে।

ওপরে কথকতার যে বিবরণ হাজির করা গেল, তা বাঙালির বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিনোদন-সংস্কৃতিরই একটা অলিখিত রূপ ছিল। এই বিনোদন-সংস্কৃতির লিখিত প্রকাশ ঘটেছে দুই খণ্ডে রচিত জসীমউদ্​দীনের বাঙ্গালীর হাসির গল্প-এ। গল্পগুলোর উৎস সম্পর্কে বলতে গিয়ে জসীমউদ্​দীন শিশুদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এই গল্পগুলি আমি কোথায় পাইলাম, তোমরা জানিতে চাহিবে। এগুলি আমাদের গ্রামদেশে এর মুখে, ওর মুখে, তার মুখে ছড়াইয়া ছিল। আমি নানা গ্রামে ঘুরিয়া, নানা লোকের সঙ্গে মিতালি করিয়া, এমনি প্রায় শ-দুই গল্প শুনিয়াছি। তার সবগুলি তোমাদের কাছে বলা যায় না। সেগুলি হইতে বাছিয়া এই বাঙ্গালীর হাসির গল্পে সাজাইয়া দিলাম।’

এসব গল্পে তিনি ধরে রেখেছেন বাঙালির চিদানন্দের স্বরূপ, হাসির ব্যাকরণ। কারণ, একটা জাতি কী নিয়ে হাসে, কী বলে রসিকতা করে, তার হাসির পাত্রপাত্রী কারা—এর মধ্য দিয়ে ওই জাতির রুচি, যাপনপদ্ধতি আর চিন্তাকাঠামোর সূত্রগুলো সহজেই আবিষ্কার করা যায়। বাঙ্গালীর হাসির গল্প-এর গুরুত্ব এখানে। জসীমউদ্​দীনের অপরাপর সাহিত্যকর্মের মতোই বাঙ্গালীর হাসির গল্প সংকলনে বাঙালির সংস্কৃতির একেবারে আঁতের রূপটি ধরা পড়েছে। ‘গোপ্যার বউ’, ‘পরের ধনে পোদ্দারি’, ‘জামায়ের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা’, ‘শ্বশুর জামাই’, ‘সত্যকার আলসে’, ‘তুমভি কাঁঠাল খায়া’, ‘আয়না’, ‘নাপিত-ডাক্তার’, ‘দিগ্বজয়ী পণ্ডিত’, ‘সেরটা কত বড়’ ইত্যাদি বাঙালির নিজস্ব হাসির গল্প। গল্পগুলোকে চিরায়ত গল্পই বলা যায়। কারণ এই গল্পগুলো এখন থেকে দুই-এক প্রজন্ম আগের অধিকাংশই বইয়ে না পড়লেও জানে। কোথাও না কোথাও শুনেছে। প্রসঙ্গত ‘আয়না’ গল্পটার উল্লেখ করা যায়। এক চাষি ধান কাটতে কাটতে খেতের মধ্যে এক আয়না পেল। যেই না আয়নায় মুখ রাখল, দেখল তার মৃত বাবার চেহারা! ‘সব ছেলেই বড় হইয়া কতকটা বাপের চেহারা পায়। তাই আয়নায় তাহার নিজের চেহারা দেখিয়াই চাষী ভাবিল, সে তাহার বাবাকে দেখিতেছে। তখন আয়নাখানাকে কপালে তুলিয়া সে সালাম করিল। মুখে লইয়া চুমো দিল। “আহা বাপজান! তুমি আসমান হইতে নামিয়া আসিয়া আমার ধান-খেতের মধ্যে লুকাইয়া আছ! বাজান বাজান! ও বাজান!”’ এরপর আয়নাটা বাড়িতে নিয়ে গেলে চাষির স্ত্রী তাতে মুখ রেখে স্বামীর উদ্দেশে বলে উঠেছে, ‘ওরে গোলাম, তোর এই কাজ? এটা কাকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছিস?’ চাষি বলল, ‘কর কি? কর কি? ও যে আমার বাজান!’ খোঁজ নেওয়া যাক ‘বোকার বাণিজ্য’ নামক আরও একটি গল্পের ভেতরবাড়ির। ‘সকালবেলা তাঁতির বউ নদীতে পানি লইতে আসিয়াছে। তাঁতি তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, “মা লক্ষ্মী! বলিতে পার এটা কোন ঘাট?” তাঁতির বউ তাকে চিনিতে পারিয়াছে। বউকে মা বলা খুবই খারাপ। সে ঝাঁটা তুলিয়া তাঁতিকে মারিতে আসে। “মিনসে বলে কি।” অল্পক্ষণে তাঁতি তার বউকে চিনিতে পারিল। তাঁতি বলে, “আচ্ছা আমার হইল কি? সারারাত্র নৌকা বাহিলাম, কিন্তু নিজের ঘাট হইতে এক ইঞ্চিও আগাইয়াও যাইতে পারিলাম না!” বউ আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, “নৌকা যে বাহিলে, নৌকার দড়ি খুলিয়াছিলে? নৌকা ত খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে।” তাঁতি বলিল, “তাই ত, বড় ভুল হইয়াছে।”এই তো খাঁটি বাঙালির রসিকতার, বিনোদন-সংস্কৃতির একটা নমুনা। এই নমুনায় এবং বাঙ্গালীর হাসির গল্প-এর একটা বড় অংশে গল্পের চরিত্রদের শ্রেণিগত বিষয়টা লক্ষ করার মতো। চরিত্রগুলোর অধিকাংশই গল্পগুলোর কথকদের মতোই চাষি, তাঁতি, জেলে, মাঝি, নাপিত, দরিদ্র ব্রাহ্মণ।

বাংলাদেশের একাডেমি সম্পর্কে যাঁরা ধারণা রাখেন, তাঁরা জানেন, জসীমউদ্​দীনের বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ সৃজনকর্মের তালিকা থেকে খাঁটি বাঙালিত্বের প্রতিনিধিত্বকারী এইসব সৃজনকর্মকে আমরা প্রায় ঝেড়ে-মুছে ফেলেছি। কারণ, আমাদের ও আমাদের শিশুদের ‘আধুনিক’ রুচি এই কিসিমের বাঙালিত্ব উপভোগের জন্য প্রস্তুত নয়। অনেক পরিবর্তিত হয়েছি আমরা। এই সব চাষি, তাঁতি, জেলে, মাঝি, নাপিতের গল্প পাতে ওঠানো যায় না। এজন্যই কি জসীমউদ্​দীনকে আমরা শুধু কবি হিসেবে বড় করতে চাই! তা-ও কোনসব কবিতার কবি; যেসব কবিতা আমাদের ‘আধুনিক’ রুচির সঙ্গে মোটামুটি মিলমিশ খায়!

ইউরোপীয় আধুনিকতা আর কিছু না হোক বাঙালিকে তার নিজেকে আড়াল ও ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। তা না হলে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির আকাঁড়া মর্মশাঁস প্রকাশিত হওয়া দুই খণ্ডে রচিত বাঙ্গালীর হাসির গল্প গেল কোথায়! আমাদের শিশুরা কি পড়ছে একেবারে খাঁটি বাঙালিত্বের স্বাদ-গন্ধযুক্ত কৃষক-তাঁতি-জেলে-নাপিতে ভরা এসব গল্প! তারা কি জানছে তাদের পূর্ব পুরুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস? জসীমউদ্​দীন বাঙালি সংস্কৃতির কত কাছের দরদি মানুষ ছিলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম কি তা জানে? তবে বাঙালি কি আসলেই আত্মঘাতী!