বাঙ্গালীর হাসির গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বোকার বাণিজ্য

এক ছিল তাঁতি। ঘরে বসিয়া কাপড় বোনে। ব্যাপারীরা আসিয়া তাহাকে ঠকাইয়া কম দামে কাপড় কিনিয়া লইয়া যায়। তাহার বউ তাহাকে পরামর্শ দিল, ‘তুমি হাটে যাইয়া কেন কাপড় বেচো না?’

পরামর্শটি তাঁতির খুব পছন্দ হইল। সে নৌকাখানা ভালোমতো সেঁচিয়া বড় একটা লম্বা দড়ি দিয়া ঘাটে বাঁধিয়া রাখিল। রাত্র হইলে কাপড়ের বোঝা নৌকায় রাখিয়া তাঁতি নৌকার দড়ি না খুলিয়াই নৌকা বাহিতে আরম্ভ করিল। নদীতে ছিল খুব স্রোত। তাঁতি খানিক নৌকা বাহিয়া আগাইয়া যায়, আবার স্রোত তাহাকে পিছাইয়া আনে। এভাবে সারারাত্র নৌকা বাহিয়া সে একটুও আগাইতে পারিল না। তাহার কিন্তু মনে হইল, সে নৌকা বাহিয়া অনেক দূর চলিয়া আসিয়াছে।

সকালবেলা তাঁতির বউ নদীতে পানি লইতে আসিয়াছে। তাঁতি তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা লক্ষ্মী! বলিতে পারো এটা কোন ঘাট?’ তাঁতির বউ তাহাকে চিনিতে পারিয়াছে। বউকে মা বলা খুবই খারাপ। সে ঝাঁটা তুলিয়া তাঁতিকে মারিতে আসে। ‘মিনসে বলে কী!’ অল্পক্ষণে তাঁতি তাহার বউকে চিনিতে পারিল।

তাঁতি বলে, ‘আচ্ছা, আমার হইল কী? সারারাত্র নৌকা বাহিলাম, কিন্তু নিজের ঘাট থেকে এক ইঞ্চিও আগাইয়াও যাইতে পারিলাম না!’

বউ আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, ‘নৌকা যে বাহিলে, নৌকার দড়ি খুলিয়াছিলে? নৌকা তো খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে।’

তাঁতি বলিল, ‘তাই তো, বড় ভুল হইয়াছে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঠেলাঠেলির ঘর

একজনের দুই বউ। কথায় বলে, ‘ঠেলাঠেলির ঘর, খোদায় রক্ষা কর।’ দুই বউকে লইয়া স্বামী বেচারির বড়ই মুশকিল। তারা একে অপরের দোষ ধরিবার জন্য সব সময় সতর্ক হইয়া থাকে। এক বউকে কোনো কাজ দিলে সে অপর বউয়ের ঘাড়ে চাপাইতে চায়।

স্বামী গিয়াছে হাল বাহিতে মাঠে। দুই বউ ঠেলাঠেলি করিয়া রান্না করে নাই। দুপুরবেলা বাড়ি এসে স্বামী ভাত পায় না। বাড়ির ধারে বেগুনখেতে পানি দেওয়ার কথা। এ বউ বলে, তুমি পানি দাও, ও বউ বলে, তুমি পানি দাও। মাঝখান দিয়া বেগুনখেতে পানি না দেওয়াতে এক দিনের রোদেই চারাগাছগুলি শুকাইয়া যায়।

অনেক ভাবিয়া–চিন্তিয়া স্বামী বউদের যার যার কাজ ভাগ করিয়া দিল, আর এক দিন অন্তর এক-একজনকে রান্না করিতে বলিল।

আজ বড় বউয়ের রান্নার পালা। ছোট তাকে তাকে আছে। যেই বড় বউ একটু ওদিকে গিয়াছে, অমনি ছোট বউ আসিয়া তরকারির হাঁড়িতে অনেকখানি নুন ঢালিয়া দিয়া গেল। খাইবার সময় নুনের জন্য কেহই খাইতে পারিল না। বড় বউয়ের বদনাম হইল। কিন্তু সে বুঝিতে পারিল ইহা কাহার কাজ।

পরদিন ছোট বউয়ের রান্নার পালা। কাল বড় বউয়ের রান্নার বদনাম হইয়াছে। আজ ছোট বউ এমন রান্না করিবে যে বাড়ির লোক খাইয়া ধন্য ধন্য করিবে। কত সুন্দর করিয়া বাটনা বাটিয়া, এটা-ওটা মসলা দিয়া ছোট বউ অতি পরিপাটি করিয়া রান্না করিতেছে। যেই ছোট বউ একটু ওদিকে গিয়াছে, অমনি বড় বউ এসে তরকারির মধ্যে অনেকখানি মরিচের গুঁড়া ফেলিয়া দিয়া গেল। ঝালের জন্য সেদিন কেহই খাইতে পারিল না। বাড়ির সকলে ছোট বউয়ের রান্না লইয়া ছিঃ ছিঃ করিতে লাগিল।

এমনি আজ তরকারিতে ঝাল বেশি, কাল নুন বেশি, পরশু হলুদ বেশি। স্বামী বেচারা বড়ই মুশকিলে পড়িল, কিছুতেই ধরিতে পারে না কে এমন কাজ করে।

সেদিন রান্না করিয়াছিল ছোট বউ। তরকারিতে এত নুন হইয়াছে যে মুখেও দেওয়া যায় না। কিন্তু স্বামী একটু চালাকি করিল। সে খাইতে খাইতে বলিল, ‘আজ যে তরকারিতে মোটেই নুন পড়ে নাই; এমন নুন ছাড়া তরকারি কি খাওয়া যায়?’

তখন বড় বউ বলিল, ‘ও তো একেবারেই নুন দিয়াছিল না, আমি আড়ালে থাকিয়া সামান্য একটু ফেলিয়া দিয়াছিলাম। তাই খাইতে পারিলে। নইলে আজ তোমার খাওয়াই হইত না।’ তখন স্বামী বড় বউয়ের চুলের মুঠি ধরিয়া মারিল এক কিল, ‘তবে রে শয়তানী! তুই লুকাইয়া তরকারিতে নুন দিয়াছিলি?’

তারপর ছোট বউকেও ধমকাইয়া বলিল, ‘আমি সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছি। তোরা একজন অপর জনের ঘাড়ে দোষ চাপাইতে একে অপরের তারকারিতে নুন ফেলিয়া দিস, ঝাল ফেলিয়া দিস। এরপর যদি কাহারও রান্নায় নুন-ঝাল বেশি হয়, তবে দুইজনেরই চুলে মুঠি ধরিয়া এইভাবে মারিব।’

সেই দিন হইতে দুই বউ ভালোমতো রান্নাবান্না করিতে লাগল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সত্যিকার আলসে

আগেকার দিনে রাজা-বাদশাদের নানা রকমের অদ্ভুত খেয়াল থাকিত। এখনকার মতো দেশের অর্থ ব্যয় করিতে তাহাদের কাহারও কাছে কোনো জবাবদিহি করিতে হইত না। তাই খেয়ালখুশিমতো তাহারা টাকা-পয়সা খরচ করিতেন। এখনকার রাজারা কিন্তু এরূপ পারেন না।

তখন প্রত্যেক রাজবাড়িতে কতকগুলি অলস লোক থাকিত। রাজারা আলসেখানায় সেই অলস লোকগুলিকে দেখিয়া বড়ই আনন্দ পাইতেন। অলস লোকদের লইয়া রাজায় রাজায় আবার প্রতিযোগিতাও হইত। কোনো রাজার আলসেখানায় যদি সব চাইতে খুব নামকরা আলসে থাকিত, সেই রাজার খুব সুনাম হইত।

সেবার দেখা গেল, রাজার রাজ্যের যত লোক কেহ কাজ করে না। সকলে আসিয়া জুটিয়াছে রাজার আলসেখানায়। কারণ সেখানে আসিলেই যত খুশি ভাতমাছ দুধ-মাখন খাইতে পাওয়া যায়। কে আর কাজ করে! রাজা মুশকিলে পড়িলেন।

তিনি মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেখো মন্ত্রী! আমার রাজ্যে কেহই কাজ করে না। সকলেই আলসেখানায় আসিয়া জুটিয়াছে। অলসদের খাওয়াতেই রাজস্বের সব খরচ হইয়া যায়। তুমি এর কোনো উপায় বলিতে পারো?’

মন্ত্রী হাত জোড় করিয়া বলিলেন, ‘মহারাজা! কোনো চিন্তা করিবেন না। আমি ইহার প্রতিকার করতেছি।’

সেদিন দুপুরবেলা রাজার আলসেখানায় সকল অলস ব্যক্তি বিছানায় গড়াগড়ি যাইতেছে, এমন সময় মন্ত্রীর আদেশে আলসেখানার ঘরে আগুন দেওয়া হইল। আগুনের আঁচ পেয়ে একে একে সকল আলসে পালাইয়া গেল।

কিন্তু দুইজন আলসে যেমন শুইয়া ছিল, তেমনি শুইয়া রহিল। আগুন যখন তাদের মাথার ওপর আসিয়াছে, তখন একজন আলসে গা মোড়ামুড়ি দিয়া দ্বিতীয় আলসেকে বলিল, ‘কত রবি জ্বলে!’ (কেমন সূর্য জ্বলিতেছে!)

দ্বিতীয় অলস ব্যক্তি যেমন শুইয়া ছিল, তেমনিভাবে শুইয়াই উত্তর করিল, ‘কেবা আঁখি মেলে।’ (সূর্য উঠিয়াছে তাহাতে কী হইয়াছে? কে চোখ মেলিয়া চাহিয়া দেখে?)

রাজা তখন বুঝিতে পারিলেন যে এই দুজনই সত্যিকারের অলসে। রাজার লোকেরা তখন ধরাধরি করিয়া সেই দুইজন অলস ব্যক্তিকে আগুনের হাত হইতে বাঁচাইল। সেই হইতে তাহারা দুইজনই মাত্র রাজার আলসেখানায় রহিল।

পরে সব আলসে যার যার বাড়ি যাইয়া কাজকর্ম করিতে লাগিল।