গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র

স্বনামধন্য উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খানের বই আমার সমাজতন্ত্র: সমাজতন্ত্রের উত্থান, পতন ও ভবিষ্যৎ সম্প্রতি বের হয়েছে। খুবই উঁচু মানের বিশ্লেষণধর্মী এ বইটি খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু বেশ কিছু জটিল বিষয়ের নিবিড় আলোচনা এখানে জায়গা পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মার্ক্সের অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রবিষয়ক তত্ত্ব, বাস্তবে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের ধরন (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, পূর্ব ইউরোপ), এই ধাঁচের সমাজতন্ত্রের পতন, সমকালীন উন্নত পুঁজিবাদের সংকট এবং শেষ অধ্যায়ে আছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য লেখকের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃশ্যকল্প ও রূপরেখা। আমার মতে, এই শেষ অধ্যায়ই লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পের কেন্দ্রস্থল। জায়গাস্বল্পতার কারণে এই আলোচনায় আমি বইয়ের শেষ অধ্যায়ের ওপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

এই বই মূলত লেখকের সমাজতন্ত্রের একটি দৃশ্যকল্প। এ দৃশ্যকল্পে স্থান পেয়েছে সমতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং উদার বহুত্ববাদী গণতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়া হয়েছে বিদ্যমান স্ক্যান্ডেনেভীয় সামাজিক গণতন্ত্র (বিশেষত নরওয়ে ও সুইডেন) এবং পূর্ব এশিয়ার কর্তৃত্ববাদী অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অভিজ্ঞতা থেকে। সামাজিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য থেকে লেখক নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গ্রহণ করেছেন: অর্থনীতি/পুঁজিবাদী কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্প-কারখানার মধ্যে সামাজিক চুক্তি, যার ফলাফল হলো সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রিত বাজার যা আবার সম্পূর্ণ জাতীয়করণের বিপরীত, সম্পদ/আয়ের পুনর্বণ্টন এবং মিশ্র মালিকানা (বেসরকারি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়)। পূর্ব এশীয় উন্নয়নমূলক পুঁজিবাদী মডেল থেকে তিনি গ্রহণ করেছেন বৈষম্য কমিয়ে একই সঙ্গে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও শ্রমবান্ধব কর্মসংস্থানের কৌশল। তাঁর সমাজতান্ত্রিক দৃশ্যকল্পের উপসংহারে বলা হয়েছে এমন এক শক্তিশালী ও সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা নীতির কথা, যেখানে সুরক্ষা হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিদ্যমান নীতিতে যা আছে তার চেয়ে আরও বেশি।

কিন্তু সমস্যা হলো, লেখক যাকে বলছেন সমাজতন্ত্র, তা আসলে সামাজিক গণতন্ত্র। আমার মতে, সামাজিক গণতন্ত্র আসলে পুঁজিবাদের একটি সংস্কার প্রকল্প। এখানে আয়ের পুনর্বণ্টন ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এর ফলে জন্ম নেয় একটি শক্তিশালী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। আর এর সবকিছু মিলে সৃষ্টি করে সমমাত্রিক ও গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের পূর্বশর্ত।

তাহলে সামাজিক গণতন্ত্রের চেয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ভিন্ন কিসে? আমার কাছে অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে শ্রমকে একটি পণ্য হিসেবে বিক্রি করা একটা পর্যায়ে গিয়ে বন্ধ হয় অথবা অন্তর্বর্তী সময়ে অন্তত তা প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বিবেচনায় বিদ্যমান সামাজিক গণতন্ত্রকে সমাজতন্ত্র বলা যাবে না। যেমন লেখকের পছন্দের মডেল নরওয়েতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ২ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিকের কাজের বন্দোবস্ত রয়েছে। এই সংখ্যা সে দেশের মোট কর্মীর মাত্র ১০ শতাংশ। সব মিলিয়ে বললে, নরওয়ের সরকারি খাতে শ্রমশক্তির প্রায় ৩০ শতাংশের
কাজের সুযোগ আছে। এখন প্রশ্ন হলো, এমন একটি দেশকে আমরা সমাজতান্ত্রিক বা সমাজতন্ত্রের পথে আছে, বলতে পারি কি না, যার মোট কর্মীর বড় অংশই পুঁজিবাদীদের কাছে তাদের শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়? এই বইবিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে লেখক বলেছেন যে বিদ্যমান সামাজিক গণতান্ত্রিক দেশগুলো শেষ পর্যায়ে সমাজতন্ত্রের দিকেই ধাবিত হবে। নরওয়ের বাস্তবতা দেখলে আমাদের তা মনে হয় না, যদিও এই দেশটি সামাজিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও শক্তিশালী।

আমার মতে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র হলো এমন একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যার উত্পাদনের উপকরণগুলো ব্যাপকভাবে সামাজিক মালিকানার অন্তর্গত হবে, রাষ্ট্রের অন্তর্গত নয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হবে সামাজিক ক্ষমতার অধীনে বিকেন্দ্রীকৃত এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে, অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধীনে নয়। যেমনটা হয়ে থাকে পুঁজিবাদে পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে, যেমনটা দেখা যায় সাবেক ও বর্তমানে বাস্তবে বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দলীয় নেতা ও আমলাদের মাধ্যমে, সেভাবেও নয়। রুশ বিপ্লবের পর যে সোভিয়েত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটাই ছিল সামাজিক ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। পরে অবশ্য তা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় লেখক বাজারের শাসন বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। আমি এই ব্যাপারে একমত। কিন্তু তাঁর মতে, এই বাজারের শাসনপ্রক্রিয়া রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে বাজারের এই প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে স্বচ্ছ মানদণ্ডের সাংবিধানিক ও আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে। কারণ, এর ফলে রাষ্ট্রীয় কর্তারা এ প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করতে পারবেন না। তার অর্থ দাঁড়ায় রাষ্ট্র একটি উদার বহুত্ববাদী সাংবিধানিক গণতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আমার মনে হয়েছে, তাঁর এই মডেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অধস্তন করার জন্য সামাজিক ক্ষমতার প্রয়োজন নেই বলে তিনি মনে করেন।

সামাজিক ক্ষমতাচর্চার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের অর্থ হলো অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ। এটা মার্ক্সের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, যা আবার একুশ শতকের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণায়নের একেবারে কেন্দ্রবিন্দু। এ বিবেচনায় সমাজতন্ত্রকে বলা যায় অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের গভীরতম রূপ। জানি না লেখকের সমাজতন্ত্রের ধারণায়নে এ বিষয়টি আদৌও কোনো গুরুত্ব বহন করে কি না।

লক্ষ করুন, আমি সামাজিক ক্ষমতা শব্দটির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এই বিবেচনায় সমাজতন্ত্র শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমমাত্রিক সংগঠন নির্মাণেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই সংগঠন সমাজেও নির্মাণ করতে হবে। অতএব, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র শুধু অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলেই বিশ্লেষণ করলে চলবে না। বরং তা বৃহত্তর সিভিল সমাজে ক্রিয়াশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক বৃহৎ পরিমাপকগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বইটিতে এই দুটো পরিমাপকের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়েছে। বইটি বাম বুদ্ধিজীবী ও কর্মীদের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটাবে বলে আশা করছি।


আমার সমাজতন্ত্র : সমাজতন্ত্রের উত্থান, পতন ও ভবিষ্যৎ

আজিজুর রহমান খান

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৯, ১৫৯ পৃষ্ঠা, দাম: ৩২০ টাকা।