শিল্পীযুগলের শিল্পকর্ম

‘একটু একটু করে জীবনের গল্পগুলো গাঁথা হয়। কিছু গল্প মুছে যায়। কিছু গল্প কখনোই লেখা হয় না।’ কথাটি লেখা আছে খালিদ মাহমুদ মিঠুর একটি চিত্রকলায়। অকালপ্রয়াত এই শিল্পীর জীবন ও কর্মের অনেক গল্পই দাগ কেটে আছে আমাদের মনে এবং তাঁর জীবনসঙ্গী কনকচাঁপা চাকমার মনমন্দিরে। বলছি, অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে চলমান মিঠু-কনক শিল্পীযুগলের ‘তুমি রবে নীরবে’ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী প্রসঙ্গে।

কনকের কালো কালির ছাঁটাই ছবিগুলো প্রাসঙ্গিক ভাবনায় যেন গ্যালারির দেয়ালজুড়ে তৈরি করেছে শোকের আবহ। আর মিঠুর কাজ রং-বৈভবে বর্ণিল। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক, বালুর আস্তরণ, পেপার কোলাজের নানান নিরীক্ষা রয়েছে তাঁর কাজে। যে বালু তিনি আঠা দিয়ে ক্যানভাসে লাগিয়েছেন, সেই বালুই সাগরতীরে ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙাগড়ার
দোলাচলে মিলতে থাকে। ‘স্ক্রিপচার ইন লাইফ’ বা ‘জীবনের ধর্মগ্রন্থ’ চিত্রে আছে নদী–নৌকা–স্রোত—এর মাধ্যমে সুখ–দুঃখ, আনন্দ এবং শব্দ, রং, ছন্দের আভাস দিয়েছেন তিনি বর্ণ ও বর্ণলিপিতে।

আর ‘ইনার বার্ন’ বা ‘অন্তর্দহন’ সিরিজচিত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক সংকট, অস্থিরতা, কলুষতাবিষয়ক সংবাদ লিপিবদ্ধ সংবাদপত্র কোলাজ করে শিল্পী সাজিয়েছেন ক্যানভাসে। সেখানে আছে ক্ষোভ ও বিস্ময়ে গাঁথা বেদনার্ত মুখাবয়ব।

খালিদ মাহমুদ মিঠু তাঁর বিমূর্তধর্মী ও অভিব্যক্তিপ্রধান এসব কাজে বাস্তব বস্তু-উপাদানও পেস্ট করেছেন বিষয়ের প্রতীকী হিসেবে। প্রায় প্রতিটি কাজেই পাওয়া যায় প্রতীক বা ইঙ্গিত। যেমন, ‘মিউজিক অব গার্মেন্টস’ ছবিতে দেখা যায় সুচ, বোতাম ও পরিমাপক ফিতা পেস্ট করা হয়েছে ক্যানভাসে। বস্তু–উপাদানের বিভিন্ন প্রতীক, ড্রয়িংয়ের নির্দেশনা, রঙের অভিব্যক্তি— সবকিছু মিলে এ শিল্পীর কাজগুলোতে তৈরি হয় একটা গল্প, যা আপাতদৃষ্টিতে বিমূর্ত হলেও মর্মপাঠে একটুও অসুবিধে হয় না। আদতে সফল আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে মিঠুর জীবন-জগতের গভীরতার পর্যবেক্ষণ চিত্রকলাতেও মিলেমিশে একাকার হয়েছে।

কনকচাঁপা চাকমার কাজে নৃ-গোষ্ঠী নারীর অর্ধ ও পূর্ণ দেহাবয়ব, বিভিন্ন কর্মময় অভিব্যক্তি ধরা হয়েছে ‘মিড শট’ কম্পোজিশনে, যেখানে প্রতিভাত হয়েছে পাহাড়ি প্রকৃতি এবং পাহাড়বাসীর জীবনের সংকট, আনন্দ–বেদনা ও উৎসব–সংস্কৃতি।

বরাবরই নিজের ছবিতে নৃ–গোষ্ঠী মানুষের জীবনযাত্রা তুলে ধরেন কনক। এই শৈলী হয়তো তিনি পাল্টাতে চান না। ফলে বিষয় ও উপাদানের পৌনঃপুনিকতা থাকে তাঁর ছবিতে। তবে নদী-নৌকা, ঝরনা, মন্দির, সন্ন্যাসী, ভিক্ষু, উৎসব, বন্ধুত্ব প্রভৃতি বর্ণনাত্মক নৃ-গোষ্ঠী কাব্যের বাইরে তাঁর কোনো কোনো কাজ সমাজ, রাজনীতি ও দুরাচারীর বিপক্ষে বক্তব্যও সৃষ্টি করেছে। ‘ব্ল্যাক মুন’ এমন কাজের চমৎকার উদাহরণ।

খালিদ মাহমুদ মিঠুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজিত এ প্রদর্শনীর ছবিগুলো দর্শককে ভাবাবে বলেই মনে হয়।

৩০ মার্চ শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত।