বইয়ে বইয়ে শ্রমজীবী নায়কেরা

>

পয়লা মে ছিল আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন যে শ্রমিক, তাঁর জীবনে নায়কোচিত উপাদান প্রচুর। যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক মার্ক মালহল্যান্ড ইংরেজি দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এ ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর দৃষ্টিতে সেরা ১০ শ্রমিক নায়কের একটি তালিকা দিয়েছেন। এখানে থাকল তার বিবরণ। গ্রন্থনা করেছেন নুসরৎ নওরিন

দ্য চাইমস
দ্য চাইমস

দ্য চাইমস
চার্লস ডিকেন্স
এটি খ্যাতনামা ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের জনপ্রিয় উপন্যাস। লেখা হয়েছিল ১৮৪৪ সালে। গল্পটি ক্রিসমাস নিয়ে। উপন্যাসের নায়ক ট্রটি। ধনী চরিত্ররা তাকে বলে তার লোকেরা অকৃতজ্ঞ, অধঃপতিত। ভগ্নমন ট্রটি আত্মহত্যার চিন্তা করে। কিন্তু অতিপ্রাকৃত ঘটনার মুখোমুখি হয়ে সে শিক্ষা পায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার। সেই সঙ্গে উপলব্ধি করে শ্রমিকশ্রেণির অহংকার আসলে কোথায়। কখনো হাল ছেড়ে না দেওয়ার শিক্ষাই এর উপজীব্য।

দ্য হার্ড ওয়ে আপ: দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব হান্নাহ মিশেল, সাফ্রাজেট অ্যান্ড রেবেল
দ্য হার্ড ওয়ে আপ: দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব হান্নাহ মিশেল, সাফ্রাজেট অ্যান্ড রেবেল

দ্য হার্ড ওয়ে আপ: দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব হান্নাহ মিশেল, সাফ্রাজেট অ্যান্ড রেবেল
হান্নাহ মিশেল
ইংরেজ লেখক হান্নাহ মিশেল কখনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। দরজি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। ইংল্যান্ডের নারী ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বিদ্রোহী ছিলেন বিবাহিত জীবনের শৃঙ্খলগুলোর প্রতিও। ২০১৫-তে প্রকাশিত এই আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, ‘এযাবৎ পাওয়া সেরা প্রশংসাগুলো (যদিও তার উদ্দেশ্য এমন ছিল না) একটি আমি পেয়েছিলাম আড়াল থেকে শোনা একজন লোকের কথায়, যে টিটকারি করে বলছিল: ‘হান্নাহ মিশেল! ওহ! সে হলো একটা সায়া পরা ডিকেন্স।’

উইলিয়াম কাফে: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব আ চার্টিস্ট লিডার
উইলিয়াম কাফে: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব আ চার্টিস্ট লিডার

উইলিয়াম কাফে: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব আ চার্টিস্ট লিডার
মার্টিন হয়লস
যুক্তরাজ্যের লেখক মার্টিন হয়লস রচিত ইতিহাসবিষয়ক বই। ব্রিটেনে উনিশ শতকের চার্টিস্ট আন্দোলনের বিস্মৃত বীর কাফে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত দাস। ১৮৪৮ সালে কাফে অন্যদের সঙ্গে লন্ডনে একটি আন্দোলন সংঘটনের পরিকল্পনা করেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হয়। তিনি তাসমানিয়ায় স্থানান্তরিত হন ২১ বছরের জন্য। সততা আর সম্মানকে যত দিন মূল্যায়ন করা হবে, তাঁর কমরেডরা লিখেছিলেন (১৮৫১), ‘তত দিন আফ্রিকার নির্যাতিত জাতির বংশধর উইলিয়াম কাফের নামও মুছে যাবে না।’ বইটি বেরিয়েছে ২০১৩ সালে।

দ্য অর্ডার অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরোইজম
দ্য অর্ডার অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরোইজম

দ্য অর্ডার অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরোইজম
ডব্লিউ এইচ ফেভিয়ার, জে ডব্লিউ উইলসন ও জে ই ক্রিব
১৯২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থী ডেইলি হেরাল্ড পত্রিকা শ্রমিকদেরকে সম্মান জানানোর জন্য একটি পুরস্কার প্রবর্তন করে। মোট ৪৪০টি পদক দেওয়া হয় সেসব শ্রমিককে, যাঁরা অন্যদের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রেখেছেন। খনি ধসে পড়া, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া, স্যুয়ারেজ বিস্ফোরণ, রাস্তা ভেঙে যাওয়াসহ প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটত সে সময়। সান পত্রিকা হেরাল্ডকে কিনে নেওয়ার পর ১৯৬৪–তে এ পুরস্কার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই বই সেই শ্রমিকের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার স্মারক হয়ে থাকছে। ২০০০–এ এটি প্রকাশিত হয়েছে।

মাইকেল ডেভিট: আফটার দ্য ল্যান্ড লিগ
মাইকেল ডেভিট: আফটার দ্য ল্যান্ড লিগ

মাইকেল ডেভিট: আফটার দ্য ল্যান্ড লিগ
কার্লা কিং
যুক্তরাষ্ট্রের লেখক কার্লা কিংয়ের বই। লেখা হয়েছে ২০১০ সালে। আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষের সময় আয়ারল্যান্ড থেকে উচ্ছেদ হয় ডেভিটের পরিবার। তিনি ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারে একজন অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন। কাজের সময় দুর্ঘটনায় কাটা পড়ে তাঁর ডান হাত। আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ফিনিয়ানদের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ষড়যন্ত্রের দায়ে জেল খাটেন সাত বছর। মুক্তি পেয়ে আয়ারল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন ল্যান্ড লিগ। এই সংগঠন আয়ারল্যান্ডে ভূস্বামী প্রথা বন্ধের জন্য লড়াই করেছিল। পার্লামেন্টের একজন সদস্য হিসেবে ডেভিট ব্রিটিশ ও আইরিশ শ্রমিক অধিকারের কঠোর সমর্থক ছিলেন। ১৯০৩ সালে, মৃত্যুর তিন বছর আগে, ৫৯ বছর বয়সী ড্যাভিট রাষ্ট্রগৃহীত ইহুদিবিরোধী কর্মসূচির স্বরূপ প্রকাশের উদ্দেশ্যে রাশিয়া ভ্রমণে যান।

দ্য শার্প নভেলস
দ্য শার্প নভেলস

দ্য শার্প নভেলস
বার্নার্ড কর্নওয়েল
ইংরেজ লেখক বার্নার্ড কর্নওয়েল রচিত এই সিরিজ উপন্যাসের নায়ক ‘শার্প’। সে একজন সৈনিক। বস্তি থেকে ক্রমে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে উত্থান পর্যন্ত তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে এই গল্প। নাক উঁচু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের টিটকারি আর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শার্প নিজেকে একজন অপরাজিত যোদ্ধা ও জাত দলনেতা হিসেবে প্রমাণ করে।

গড’স বিটস অব উড
গড’স বিটস অব উড

গড’স বিটস অব উড
উসমান সেমবেন
সেনেগালের লেখক উসমান সেমবেন রচিত উপন্যাস। ১৯৬০ সালে বেরোনো এই উপন্যাসের গল্প রেলওয়েশ্রমিকদের কর্মবিরতিকে কেন্দ্র করে। বইটি প্রকাশের বছরেই সেনেগাল ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রমিকদের সাহসী নেতা ইব্রাহিম বাকায়োকো। কিন্তু গল্প যতই এগোতে থাকে, সবচেয়ে নায়কোচিত হিসেবে সামনে আসতে থাকে নারী চরিত্রেরা। প্রথমে তারা পুরুষদের অনুসরণ করছিল। পরবর্তীকালে সব আন্দোলনকারীকে একত্র রাখার কঠিন সংগ্রামটি তারাই চালিয়ে নেয়। সবশেষে, ঊর্ধ্বতনদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধে তারা নেতৃত্ব দেয়। শ্রেণিসংগ্রাম আর উপনিবেশবাদ বিষয়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস।

আউট অব নাইট
আউট অব নাইট

আউট অব নাইট
জ্যান ভ্যালটিন
১৯৪১-এ প্রকাশিত বইটি জার্মান লেখক জ্যান ভ্যালটিনের আত্মজীবনী। তাঁর প্রকৃত নাম রিচার্ড ক্রেবস। হ্যামবর্গের বন্দরে শ্রমিক ছিলেন, ছিলেন দক্ষ বিপ্লবী। নাজি শাসনের প্রথম পর্যায়ে ছিলেন রেজিসট্যান্স বাহিনীর সদস্য। গেস্টাপো বাহিনী তাঁকে আটক করে নির্যাতন করে। কিন্তু কৌশলে নিজেকে রক্ষা করেন এবং ডাবল এজেন্টের ভূমিকায় ঠিকই কাজ চালিয়ে নেন। তারপরও একপর্যায়ে বিশ্বাসঘাতকার শিকার হয়ে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আদর্শবাদ, প্রেম, হৃদয়ভঙ্গ, অসম সাহস আর ট্র্যাজিক বিশ্বাসঘাতকতার এই গল্প পাঠক লুফে নিয়েছিল।

দ্য জার্নি অব মার্টিন নাডুড: আ লাইফ অ্যান্ড টার্বুলেন্ট টাইমস
দ্য জার্নি অব মার্টিন নাডুড: আ লাইফ অ্যান্ড টার্বুলেন্ট টাইমস

দ্য জার্নি অব মার্টিন নাডুড: আ লাইফ অ্যান্ড টার্বুলেন্ট টাইমস
জিলিয়ান টিনডাল
১৯৯৯-এ প্রকাশিত এবং ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও লেখক জিলিয়ান টিনডাল রচিত বই। ফ্রান্সের একজন পাথরশ্রমিক ও সমাজতন্ত্রী নাডুডের জীবন নিয়ে এটি লিখিত। ১৮৪৮ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর পালিয়ে লন্ডনে চলে আসেন নাডুড। আঠারো বছর ইংল্যান্ডে থাকার পর এই সংগ্রামী দেশে ফিরে আসেন এবং সসম্মানে তৃতীয় ফরাসি রিপাবলিকের পার্লামেন্ট সদস্য হন।

হ্যারি’স লাস্ট স্ট্যান্ড
হ্যারি’স লাস্ট স্ট্যান্ড

হ্যারি’স লাস্ট স্ট্যান্ড
হ্যারি লেসলি স্মিথ
২০১৪ সালে প্রকাশিত এ বই ইংরেজ লেখক হ্যারি লেসলি স্মিথের স্মৃতিকথা। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি তীব্র দারিদ্র্যের মুখে পড়েন। ১৯৪১ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল এয়ার ফোর্সে যোগ দেন নাজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। জার্মানির সাধারণ মানুষকে কখনো শত্রু ভাবেননি তিনি, বিয়েও করেন একজন জার্মানকে। যুদ্ধ-পরবর্তী ইংল্যান্ডের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ভূমিকা অনুভব করেছিলেন তিনি। যে রাষ্ট্র প্রথমবারের মতো শ্রমিকশ্রেণির মতামতের গুরুত্ব বুঝতে পারছিল। কিন্তু সম্প্রতি সেই কল্যাণমূলক অবস্থান থেকে ইংল্যান্ডের ক্রমে পিছিয়ে আসা তাঁকে সেই যুদ্ধপীড়িত শৈশবকে মনে করিয়ে দিয়েছে। তিনি অনুভব করেছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোর কাছে সাধারণ জ্ঞানের চেয়েও মুনাফা মুখ্য। বইটি হয়ে উঠেছে শ্রমিকশ্রেণির মর্যাদা আর বিদ্রোহের পক্ষে তাঁর ‘চূড়ান্ত অবস্থান’।