তাঁদের লেখায় গরম

>

বাংলার কালজয়ী সাহিত্যিকদের রচনায় বিচিত্র মাত্রায় এসেছে গ্রীষ্মের আবহ। বিভিন্ন সময়ের এই সাহিত্যিকেরা তাঁদের নিজেদের লেখার খাতায় কীভাবে চিত্রিত করেছেন বাংলার গরমকে, তারই কয়েকটি নমুনা গ্রন্থনা করেছেন সোহানুজ্জামান

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–৯৪)
‘আনন্দমঠ’ থেকে

‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে এক দিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব।’
(উপন্যাস আনন্দমঠ, প্রকাশকাল: ১৮৪৪)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১)
‘ছিন্নপত্রাবলী’ থেকে

‘এ দিকে গরমটাও বেশ পড়ছে। কিন্তু রৌদ্রের উত্তাপটাকে আমি বড়ো একটা গ্রাহ্য করি নে, সে বোধ হয় তুই জানিস। তপ্ত বাতাস ধুলোবালি খড়কুটো উড়িয়ে নিয়ে হুহু শব্দ করে ছুটেছে—প্রায়ই হঠাৎ এক-এক জায়গায় একটা আজগবি ঘূর্ণি বাতাস দাঁড়িয়ে উঠে শুকনো পাতা এবং ধুলোর ওড়না ঘুরিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে নেচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে—সেটা দেখতে বেশ লাগে।’
(পত্রসংকলন ছিন্নপত্রাবলী, প্রকাশকাল: ১৮৮৯)

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)
‘মহেশ’ থেকে

‘বৈশাখ শেষ হইয়া আসে, কিন্তু মেঘের ছায়াটুকু কোথাও নাই, অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে যেন আগুন ঝরিয়া পড়িতেছে। সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার মত তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা ঝিমঝিম করে—যেন নেশা লাগে।’
(ছোটগল্প ‘মহেশ’, হরিলক্ষ্মী গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত, প্রকাশকাল: ১৯২৬)

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪–১৯৫০)
‘আরণ্যক’ থেকে

‘সূর্যের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ড—ক্যাল্​সিয়াম পুড়িতেছে, হাইড্রোজেন পুড়িতেছে, লোহা পুড়িতেছে, নিকেল পুড়িতেছে, কোবাল্ট পুড়িতেছে—জানা অজানা শত শত রকমের গ্যাস ও ধাতু কোটি যোজন ব্যাসমুক্ত দীপ্ত ফার্নেসে একসঙ্গে পুড়িতেছে—তারই ধূ-ধূ আগুনের ঢেউ অসীম শূন্যের ঈথারের স্তর ভেদ করিয়া ফুলকিয়া বইহার ও লোধাইটোলার তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ অরণ্যে আসিয়া লাগিয়া প্রতি তৃণপত্রের শিরা উপশিরার সব রসটুকু শুকাইয়া ঝামা করিয়া, দিগ্​দিগন্ত ঝল্​সাইয়া পুড়াইয়া শুরু করিয়াছে ধ্বংসের এক তাণ্ডব–লীলা। চাহিয়া দেখিলাম দূরে দূরে প্রান্তরের সর্ব্বত্র কম্পমান তাপ-তরঙ্গে ও তাহার ওধারে তাপজনিত একটি অস্পষ্ট কুয়াশা।’
(উপন্যাস আরণ্যক, প্রকাশকাল: ১৯৩৯)

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২–৭১)
‘লালসালু’ থেকে

‘এদিকে সূর্য ক্রমশ দূরপথ ভ্রমণে বেরোয়, ঝিমিয়ে আসে তাপ, মেঘশূন্য আকাশের জমাট, ঢালা নীলিমার মধ্যে শুকিয়ে ওঠে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। তখন শুরু হয় আরেক দফা হাড়-বের-করা শ্রম। রাত নেই দিন নেই হাল দেয়। তারপর ছড়ায় চারা—ছড়াবার সময় না-তাকায় দিগন্তের পানে, না-স্মরণ করে খোদাকে। এবং খোদাকে স্মরণ করে না বলেই হয়তো চারা ছড়ানো জমি শুকিয়ে কঠিন হতে থাকে। রোদ চড়া হয়ে আসে, শূন্য আকাশ বিশাল নগ্নতায় নীল হয়ে জ্বলেপুড়ে মরে। নধর নধর হয়ে ওঠা কচি কচি ধানের ডগার পানে চেয়ে বুক কেঁপে ওঠে তাদের। তারা দল বেঁধে আবার ছোটে। তারপর রাত নেই দিন নেই বিল থেকে কোঁদে কোঁদে পানি তোলে। সামান্য ছুতোয় প্রতিবেশীর মাথায় দা বসাতে যাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না, তাদেরই বুক বিমর্ষ আকাশের তলে কচি-নধর ধান দেখে শঙ্কিত হয়ে ওঠে, মাটির তৃষ্ণায় তাদেরও অন্তর খাঁ খাঁ করে।’
(উপন্যাস লালসালু, প্রকাশকাল: ১৯৪৮)

শওকত ওসমান
শওকত ওসমান

শওকত ওসমান (১৯১৭–৯৮)
‘জননী’ থেকে

‘চৈত্র্যের বৈকাল। আকাশে খণ্ড মেঘেরা মন্ত্রণারত। সমগ্র প্রান্তর আবার কর্মকলরবে জাগিয়া উঠিতেছে। ঝড় না উঠিলে সন্ধ্যা পর্যন্ত রবি-ফসলের ক্ষেতে কাজের কামাই নাই। শুক্লা সপ্তমী। চাঁদের আলোয় খরা-ভীত কিষাণেরা বহুক্ষণ মাঠ গুলজার করিয়া রাখিবে আজ।’
(উপন্যাস জননী, প্রকাশকাল: ১৯৫৮)