দোসর যেজন তারে কে জানে

মজু চৌধুরীর ঘাট
মজু চৌধুরীর ঘাট

টান দেয় ডাল-ভাত, টান দেয় চৈত্র-বৈশাখ, টান দেয় নারী ও পুরুষ—আর সেই টানের প্রান্তে-প্রান্তে বিছানো জীবন-ধর্ম। জন্মের সময় আগলিয়ে যে মৃত্যু ক্রমেই নিকটবর্তী হয়, তা প্রিয়তম অংশগুলো এবং বাঁচার ক্রমগুলোকে ঘনীভূত করে। জীবনের অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া অন্যজীবন এক মহাজীবনে ধাবিত হয়। সংগ্রাম ও সাধনার যে রূপ প্রতিনিয়ত অতিক্রান্ত হয় তা ইহজাগতিক। প্রাণিকুলের দেখার, জানার ও স্পর্শের অন্তরালে বিবর্তনের খেলায় একটি শূন্য কেন্দ্রকে চিহ্নিত করায় সর্বদা ব্যস্ত থাকলেও তাকে নতুন মাত্রায় পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই স্বপ্ন, একজীবনে বিন্দু থেকে বৃত্ত পূরণ করাই হয়তো স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আহ্লাদ আসে মগ্ন অভিসারে এবং সার্থকতা ধরা দেয় মধুর রঙে। তবে দুঃস্বপ্নের সম্ভাবনাও এড়িয়ে যাওয়ার নয়!

চতুরতাগুলো অন্নজল নিয়ে একধরনের প্রহসনে মত্ত থেকে জট পাকাতে ভালোবাসে। এর মধ্যে নিহিত হয় ক্রোধ এবং উপরিতলের বোধ। সম্মুখ কিংবা পেছন তখন উন্মুক্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী ডান ও বামের গহ্বরে প্রবেশ করে। ব্যতিক্রমী সে দৃশ্যপটে তখন জানান দেয় পরলোক। উজানে বহে গ্রহ-উপগ্রহের লীলা, অন্তরে বহে অনন্তের প্রতীক-প্রমীলা!

দোসর যেজন তারে কে জানে...

ঘন সুপারির বাগান, কমতি নেই নারকেলবীথির। রয়েছে হরেক রকম ফলবৃক্ষ—এবং তারই বুক ঘেঁষে বসতবাটি, ফসলের মাঠ। একটু ভিন্ন সবুজের শহরটি পরিচ্ছন্ন ও সচ্ছল। অন্তত প্রথম দর্শনে তাই মনে হলো। বন্দরের পরিকল্পনা চলছে মজু চৌধুরীর ঘাটে। মেঘনার একটি ক্ষীণ ধারা তৈরি করেছে পোতাশ্রয়, দূরে মেঘনা ভারী চর বুকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেও নৌ চলাচলের খামতি নেই। লক্ষ্মীপুর-ভোলা পথে ফেরি-মোটরলঞ্চ-স্পিডবোট যেমন যখন-তখন ভোঁ-করছে, তেমনি তীরে দাঁড়ানো বাস-মাইক্রোবাস পাড়ি দিচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা কিংবা অন্য কোনো গন্তব্যে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাবল্য হঠাৎই চমকিত করে দেয়। তবে শিক্ষার বিষয় নিয়ে মনে হয় স্থানীয়দের ইহকালের চেয়ে পরকালের দিকে ঝোঁক বেশি। ছেলে ও মেয়েতে টইটম্বুর রাস্তাঘাট তাই ঈষৎ অন্য রকম।

ফসল, বাণিজ্য, চাকরি—সব মিলিয়ে বেশ একটা লক্ষ্মীভাব লক্ষ্মীপুরে। তবে সরস্বতী যদি যথাযথ উন্মুক্ত আহ্বান পান তবে দুই বোনে সংসার পরিপূর্ণ হয়।

লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সুন্দর আয়োজন সন্ধ্যার ঝড়-বাদলে ধ্বস্ত হলেও আয়োজকদের উৎসাহে কোনো মালিন্য ছিল না। বড় কথা হয়, ভারী বক্তৃতা শোরগোল করে; উন্নতির নানান ফর্দ ঘোষিত হয় সম্মেলন কর্মপ্রণালিতে! তবে শিল্পসখা এ শহরের তথা এ জেলার সুনাম তো ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদের আড়ালেই থাকা সমীচীন!

মা আমার সাধ না মিটিল...

যে চৈত্রের গন্ধ চেনে, সে বারো মাস বোঝে। দিনপঞ্জি দেখে আজ চৈত্রের শেষ দিন—চৈত্রসংক্রান্তি। হাওয়া-গন্ধে চিল উড়ছে, খাঁ খাঁ তাপে সূর্যও যেন টগবগ করে মাথার ওপর থেকে কদম বাড়াচ্ছে পশ্চিমে। পাতা ওলটানোর পর যে ভোরটি হবে তাকে নিয়ে আজকের উচ্ছ্বাস আগামীকাল পর্যন্ত প্রসারিত হবে। বিরহ থেকে ভালোবাসা জন্ম নেবে, জীর্ণ-পুরাতন ঠেলে নতুন এসে বলবে:

 ‘কালো কোকিল, তুই বড় বেহায়া রে—’

চৈত্র-স্মৃতি আড়ংয়ের; কাঠের ঘোড়া, বাঁশের বাঁশি, আর কাঁচা-আম কাটা ছুরির। দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা মেলানো জমজমাট আয়োজনে চিনি-কদমা, হাওয়াই মিঠাই, পাটি-বাতাসা খলবল করে ওঠে। নড়ে ওঠে তাজমহল থেকে লালবাগের কেল্লা—ওপেনটি বায়োস্কোপ। পকেটে সিকি-আধুলি বাজাতে বাজাতে বালকের চোখ ঘোরে কুমোরপাড়ার টুকটুকে বালিকার লাল টিপে। কাসুন্দি ঝাঁঝের মধ্যে হেঁকে যাচ্ছে পেয়াদা-পাইক: ‘এই সরো সরো, বাবুমশাই কাচারি যাবেন।’ ঘাটে বাঁধা নৌকা আলস্য ভেঙে ডোবা আলোর রং দেখে, কুমারের তীরে—তীরে হাঁক দেয় শোলার মহাজন: ‘টোপর কি এ বছর লাগবে তোমার, কুমার?’ রাত বাড়ে, মিলন ও কলহ রেখে চড়কের ঢেউ ওঠে পুবের চাতালে।

এ চৈত্রে হাতপাখা নেই যে দু–দণ্ড হাওয়া ঘুরিয়ে জিরিয়ে নিই! নেই ঘড়া-ভরা রস, ঝিনুকে-শামুকে জমা স্মৃতি ও বিশ্বাস—যে রাতটিকে পার করি বৈশাখের দুয়ারে! তবুও এগোতে হয়, ফিরে যেতে হয় আরেক চৈত্রে।

সুগন্ধ ময়ূর লো, চল ফিরে যাই

রাতে কেউ ছোঁবে না লজ্জা, ভাঙাচোরা পথ ও পিপাসা

যতই গভীর হোক, কণ্ঠ ভারী হোক

আগামী চৈত্রে এসে ছবি তুলে নেব।

বৈশাখ কি নেড়েচেড়ে দেবে বৃক্ষশাখা আর হাতের কাঁকন?

বৈশাখ কি নেড়েচেড়ে দেবে বৃক্ষশাখা আর হাতের কাঁকন? ও পুষ্প, তুমি অধীর হয়ো না। তোমার সৌরভের পাশেই তো গুঞ্জনরত পতঙ্গের মেলা। ও সুরঞ্জনা, তুমি উন্মুখ হয়ো না। তোমার মায়ার সঙ্গেই তো নবীন চাতকসকল।

দলে-দলে, আবার কখনো একা—হাওয়া চলে, গান দোলে, মাতে ও মাতায়—বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ! ছায়ানটের গানে-গানে সূর্যোদয়ের যে শুভ বার্তা, তা রঙিন হয়ে ওঠে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। শাহবাগের ঢল যেন বাঙালি প্রাণের এক অবিচ্ছেদ্য চল। শহরের ঢোলে যে গ্রামের বোল তা নিয়েই তো সন্তানের আগামীর বল। মঙ্গলের অভিযাত্রায়, আত্মপ্রত্যয়ের অভিযানে—বাঙালির উৎসব পরিণত হয় মানুষের উৎসবে।

বৈশাখ এগোয় তার নতুন পায়ে, অমেয় ছন্দে। বৃক্ষ ও লতা, নারী ও পুরুষ মিলে সম্মুখে দেখে তার প্রসন্ন-প্রহর!

স্বপ্নঝড় নববর্ষের সন্ধ্যায় জাদুকরকে তুলে নিয়ে গেল!