বাজি থেকে বাজিমাত

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে ১৯০৮–৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬)।  প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে ১৯০৮–৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬)। প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী
>

লিখতে শুরু করেছিলেন বাজি ধরে, সাকল্যে বেঁচেছিলেন ৪৮ বছর, তবে এই স্বল্পজীবনেই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী কথাকার হয়ে উঠেছিলেন তিনি—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯ মে কালজয়ী এই লেখকের জন্মদিন। এ সংখ্যার প্রচ্ছদ তাঁকে নিয়ে

বাজি ধরে সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন তিনি। তবে নিজেকে বলতেন ‘কলম-পেষা মজুর'। কালজয়ী কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর জীবনের তুঙ্গস্পর্শী নানা ঘটনার দিকে ফিরে দেখা।

১৯২৮ সাল। মানিক বন্দ্যোপাধায়ের (১৯০৮-১৯৫৬) বয়স তখন ২০। পড়েন বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজে। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই। ফলে সাহিত্য-পড়ুয়া একটা বন্ধুমহল গড়ে উঠেছিল। একদিন এক সাহিত্য-আড্ডায় ক্ষুব্ধ হয়ে বন্ধুরা বলছিল, ‘মাসিকপত্রের সম্পাদকেরা নামকরা লেখক ছাড়া কারও লেখা ছাপে না। দলের লেখক হলে ছাপায়। ব্যস। অন্য কেউ পাত্তা পায় না।’ মানিক বললেন, ‘কেন বাজে কথা বকছ? ভালো লেখা কি এত সস্তা যে হাতে পেয়েও সম্পাদকেরা ফিরিয়ে দেবেন? সম্পাদকেরা কি পাগল যে ভালো গল্প ফিরিয়ে দিয়ে বাজে গল্প ছাপবেন?’ বন্ধুরা তো মানিকের ওপর রেগেমেগে আগুন! বুদ্ধিহীন, উদাসীন সম্পাদকদের পক্ষে শুধু শুধুই সাফাই গাইছে তিনি! তারা হাতেনাতে প্রমাণ দিল। তাদেরই একজনের তিনটি লেখা মাসিকপত্রের অফিস থেকে সবেমাত্র ফেরত এসেছে। মানিক কিছুটা দমে গেলেন। কিন্তু হার মানলেন না। অনেক কথা–কাটাকাটির পর বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর বাজি হলো। মানিক বললেন, ‘আমি একটি গল্প লিখে তিন মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ, প্রবাসী বা বিচিত্রায় ছাপিয়ে দেব। যদি না পারি...।’ বন্ধুরা বলল, ‘ঠিক আছে, দেখাও কেমন পারো।’

এবার মানিক পড়লেন সমস্যায়। আগে তো কখনো লেখেননি। কিন্তু সমস্যা সেটা না। গল্প তাঁর কম পড়া নেই। পড়তে পড়তে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে লিখতে তিনি পারবেন—এ বিষয়ে নিশ্চিত। শুধু কী নিয়ে গল্প লিখবেন, এই ভাবনা তাঁকে অস্থির করে তুলল। প্রেমের গল্প?

ঠিক করলেন প্রেমের গল্পই লিখবেন। লিখলেন এক গল্প। নাম ‘অতসী মামী’। যথারীতি গল্পটা ছাপা হলো বিচিত্রা পত্রিকায়। শুধু গল্প ছাপা নয়, এক সকালে মানিকদের বাড়িতে এসে হাজির হলেন স্বয়ং পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। খালি হাতে নয়, একেবারে গল্পের পারিশ্রমিকসহ। এবং বললেন, ‘আর একটি গল্প চাই।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক আত্মজৈবনিক লেখায় বলেছেন, ‘তারপর সব ওলটপালট হয়ে গেল। সব ছেড়ে দিয়ে আরম্ভ করলাম লেখা।’ এরপর ৯ বছরের মধ্যে তিনি লিখে ফেললেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো: জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬) উপন্যাস এবং অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫) আর প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭) গল্পগ্রন্থ। মানিক যদি আর কোনো কিছু না লিখে শুধু এই বইগুলো লিখতেন, তা–ও বাংলা সাহিত্যে তিনি অমরতা লাভ করতেন। এই সবই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে। অথচ তিনি ভেবেছিলেন, ত্রিশ বছর বয়সের আগে লিখবেনই না। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, ‘ত্রিশ বছর বয়সের আগে কারও লেখা উচিত নয়।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকজীবন শুরুর এবং এত দ্রুত প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এই গল্প শুনলে যে কারও মনে হতে পারে, তিনি হঠাৎ লেখক হয়েছেন। এ যেন-বা তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের নিতাই চরিত্রের মতোই। নিতাই যেমন হঠাৎ একদিন কবিয়াল হয়ে উঠেছিল। এ এক প্রায় আজব ব্যাপারই বটে! কিন্তু মানিকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। বরং বলা যায়, তাঁর মতো প্রস্তুতি নিয়ে, বুঝেশুনে, বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকই লেখা শুরু করেছিলেন। তিনি নিজে বলেছেন, ‘হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে।লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’ চারপাশের বাস্তব জীবনকে গভীরভাবে জানা এবং ব্যাপকভিত্তিক সাহিত্যপাঠই হলো সেই প্রস্তুতি—এ কথা মানিকই তাঁর লেখকের কথা নামের বইয়ে বলেছেন। কেমন ছিল মানিকের প্রস্তুতি?

মানিকের বাবার কর্মসূত্রে একসময় তাঁরা থাকতেন বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। চারপাশের জীবন সম্পর্কে ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। জীবনের বিচিত্র রূপ দেখতে তিনি মাকে কাঁদিয়ে নদীর ধারে নোঙর করা নৌকায় মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে দু–চার দিন থেকে আসতেন। কখনো কখনো মা–বাবার শাসন উপেক্ষা করে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে রাত কাটিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আবার যখন মেদিনীপুর ছিলেন, তখন শহরের নোংরা, পুরোনো লোকালয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করে কাটাতেন দিন। বেপরোয়া মানিক যখন শৈশবের সীমা পার হয়ে কৈশোরে পড়েছেন, তখনই মাত্র ষোলো বছর বয়সে মাতৃহারা হন তিনি। এরপর আরও বেপরোয়া বল্গাবিহীন উদ্দাম জীবনচর্চায় অভ্যস্ত হতে থাকলেন। মানিকের মুখে শোনা যাক তাঁর বাল্যকালের কথা: ‘ছোটবেলা থেকেই গিয়েছিলাম পেকে। অল্প বয়সে “কেন” রোগের আক্রমণ খুব জোরালো হলে এটা ঘটবেই। ভদ্র জীবনের সীমা পেরিয়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মাচ্ছিল নিচের স্তরের দরিদ্র-জীবনের সঙ্গে। উভয় স্তরের জীবনের অসামঞ্জস্য, উভয় স্তরের জীবন সম্পর্কে নানা জিজ্ঞাসাকে স্পষ্ট ও জোরালো করে তুলত। ভদ্র জীবনে অনেক বাস্তবতা কৃত্রিমতার আড়ালে ঢাকা থাকে, গরীব অশিক্ষিত খাটুয়ে মানুষের সংস্পর্শে এসে ওই বাস্তবতা উলঙ্গরূপে দেখতে পেতাম, কৃত্রিমতার আবরণটা আমার কাছে ধরা পড়ে যেত। মধ্যবিত্ত সুখী পরিবারের শত শত আশা-আকাঙ্ক্ষা অতৃপ্ত থাকার, শত শত প্রয়োজন না মেটার রূপ দেখতে পেতাম নিচের তলার মানুষের দারিদ্র্য-পীড়িত জীবনে।’ এই গেল জীবন-জগৎ-চারপাশের সঙ্গে আবাল্য বোঝাপড়ার প্রস্তুতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যাপকভিত্তিক পড়াশোনা।

মানিক তাঁর বিভিন্ন আত্মজীবনীমূলক লেখায় বলেছেন, স্কুলে থাকতেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র হজম করেছেন। শুধু হজম নয়, নানা প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সঙ্গে পড়েছেন তখনকার অতিসাম্প্রতিক শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার, নজরুল। এ ছাড়া হ্যামসুনের হাঙ্গার থেকে শুরু করে বার্নাড শর নাটক তো ছিলই। ওই ছাত্র বয়সেই নিবিড় পরিচয় ঘটেছিল ফ্রয়েডের রচনার সঙ্গে। এই ছিল প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ লেখার আগের মানিকের প্রস্তুতি। ফলে হঠাৎ লিখেই মানিক লেখক হয়েছেন, এ সিদ্ধান্তমূলক কথা বলাটা অসঙ্গতই বটে। যখন তিনি লিখতেন না, তখনো তিনি লিখতেন মাথার ভেতরে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা নির্জনে। উদ্দাম, অপ্রতিরোধ্য, বল্গাহীন হলেও তাঁর চরিত্রের মধ্যে একটা নির্জনতার বিষয় ছিল। তাঁর জীবনীকার ও গবেষক নিতাই বসু জানিয়েছেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বভাবের দিক থেকে নির্জন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এই নির্জনতাই তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় স্ববিরোধিতা।’

এই নির্জন সত্তাই মানিকের লেখক সত্তার প্রস্তুতির জন্য আরও বেশি সহায়ক হয়েছিল বলে মনে হয়। এই নির্জনতার মধ্যেই চলত কাগজকলম ছাড়া লেখালেখির কাজ। ‘অতসী মামী’ বাহ্যিক প্রকাশমাত্র। দিনের পর দিন হয়তো মাথার মধ্যে লেখা হয়ে চলছিল জননী, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, প্রাগৈতিহাসিক। তা না হলে এত কাছাকাছি সময়ে এতগুলো গ্রন্থ রচনা বিস্ময় জাগায় বৈকি! কিন্তু মানিকের কাছে এ ছিল স্বাভাবিক। কারণ ওই যে জীবনকে দেখা, কেন প্রশ্ন তোলা, সাহিত্য পাঠ আর নির্জনতা—এগুলোকে একরকম হাত মকশোই বলা যেতে পারে। মানিকের ভাষায়, ‘হাতেকলমে না লিখেও চিন্তার জগতে এলোমেলো ছাড়া ছাড়াভাবে যেন লেখা মকশো করার কাজটাই চলে, চিন্তাকে খানিকটা সাহিত্যের টেকনিকে সাজাবার অভ্যাস জন্মে যায়।’

দুই.

বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধায়ের আবির্ভাবই হয়েছিল প্রচলিতকে দারুণভাবে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে। তিনি যখন বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে গল্প লেখার কথা ভাবলেন, তখন তাঁর মধ্যে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিল, কী নিয়ে গল্প লিখবেন। স্থির করলেন প্রেমের গল্পই লিখবেন। তবে কি তিনি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বা সমকালীনকল্লোল কালি-কলম গোষ্ঠীর লেখকদের মতো প্রেমের গল্প লিখবেন! নিশ্চয় নয়। তিনি বললেন, ‘বাংলা মাসিকের প্রায় সব গল্পই একরকম প্রেম নিয়ে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে লেখা হয়। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, তাদের প্রেম হলো, বিয়েতে বাধা পড়ল, বাধা কেটে মিলন হলো, এই রকম একটা গল্প লিখব ফেনিয়ে–ফাঁপিয়ে। মন সায় দিল না। মন বলল, প্রেমের গল্প লিখতে চাও, লেখো, কিন্তু পচা দুর্গন্ধ ছ্যাবলামির গল্প লিখো না। বাংলার ছেলেমেয়েগুলো যে গোল্লায় গেল এরকম গল্প পড়ে পড়ে।’ ‘অতসী মামী’ যদিও ছিল ‘রোমান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনি’, তবু ‘ন্যাকামির চেয়ে ভালো’ ছিল। দেখার আলাদা চোখের ব্যাপার ছিল।

কিন্তু এরপর থেকে মানিক বুক চিতিয়ে তাঁর জাত দেখিয়ে দিলেন। প্রেম–সম্পর্কিত কল্পিত আদর্শ, ‘পচা দুর্গন্ধ ছ্যাবলামি’ ও ‘রোমান্সে ঠাসা কাহিনি’ থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, প্রেম শাশ্বত কিছু নয়। আবার তা কল্লোল ও কালি-কলম গোষ্ঠীর লেখকদের ভাবনার মতো ‘হালকা নোংরা রোমান্টিক ন্যাকামি’ও নয়। বাস্তবে প্রেম যে জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি, এর সঙ্গে যে কামনা-বাসনা, স্বার্থ-পরার্থ, সুবিধা-অসুবিধা, জয়-পরাজয়, সময়-অসময়, সাধুতা-বজ্জাতি ইত্যাদির জটিল সমীকরণ জড়িয়ে থাকে—এ কথা মানিক তাঁর গল্প-উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে দেখিয়েছেন। এমনকি প্রেমের স্থায়িত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুললেন। দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসে আনন্দ হেরম্বকে প্রশ্ন করেছে, ‘প্রেম কত দিন বাঁচে?’ হেরম্ব মানিকের হয়ে বলেছে, ‘দিন গুনে বলা যায় না। তবে বেশি দিন নয়। এক দিন, এক সপ্তাহ, বড়জোর এক মাস।’ মানিক প্রেমের এই স্বরূপকে আবিষ্কার করেছেন বাস্তব জীবন থেকে। সাহিত্যে তিনি জীবন ও প্রেমকে আদর্শায়িত করেননি। শুধু প্রেমবিষয়ক ধারণা নয়, তিনি শিক্ষিত মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক সাহিত্য নিয়ে ভিত কাঁপানো প্রশ্ন তুলেছিলেনতিনি দেখেছেন বিরোধ, ভণ্ডামি, হীনতা, স্বার্থপরতা, অবিচার, অনাচার, বিকারগ্রস্ততা, সংস্কারপ্রিয়তায় ভরা মধ্যবিত্তের জীবন। অথচ তার রচিত সাহিত্যে শুধু ভদ্র, সুন্দর আর মহৎ জীবন রূপায়িত হবে কেন! মানুষের যা খাসলত, তারই আকাঁড়া বাস্তব হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছে মানিকের লেখাজোখায়। তাই তিনি ন্যাচারালিস্ট।

১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর ২২টি উপন্যাস ও ৯টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সঙ্গত কারণেই এই পর্বের মানিকের লেখালেখিতে প্রধান হয়ে দেখা দেয় মার্কসবাদী জীবনদর্শন। শ্রেণিসংগ্রামের চেতনা অধিকাংশ রচনাতে প্রধান হয়ে ওঠার ফলে প্রথম জীবনের শিল্পী মানিককে এখানে আর পাওয়া যায় না বলে মনে করেন অনেকেই। এ কি রাজনৈতিক দর্শনের কাছে শিল্পীর পরাজয়? কিন্তু মার্কসবাদী রাজনৈতিক দর্শনে আস্থাবান সাহিত্য-সমালোচকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, মানিকের এই পরিবর্তনের বীজ তাঁর প্রথম দিককার সাহিত্যকর্মের মধ্যেই ছিল। পদ্মা নদীর মাঝি-ই তার বড় প্রমাণ। তাঁদের অভিমত, মানিকের এই পরিবর্তন জীবন–সম্পর্কিত বোধের একধরনের উত্তরণই বটে।

তবে যাঁরা বলেন, শিল্পী মানিক পরাজিত হয়েছেন, তাঁরা বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন। আর যাঁরা বলেন, এই পরিবর্তন এক ধরনের উত্তরণ, তাঁরা মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের মাপকাঠিতে বিচার করে বলেন। তাতে অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু যায়–আসে না। বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে তিনি যে মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা প্রায় শতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে আজও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ করে রেখেছে। আরও বহুকাল যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবেন, তাতেও সন্দেহ নেই। মাঝখানে এই নন্দনতাত্ত্বিক বিতর্ক, রাজনীতির ভেদবিচার মানিকের শেষ জীবনের দুঃসহ দারিদ্যকে আরও অসহ করে তুলেছিল। কারণ বুর্জোয়া চেতনার অনেক পত্রপত্রিকাই শেষ দিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছাপতে চাইত না। অথচ তিনি ছিলেন ‘কলম-পেষা মজুর’ অর্থাৎ লেখালেখি করেই অন্নসংস্থান করতেন!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে ১৯০৮–৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬)। ছবি: সংগৃহীত
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে ১৯০৮–৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬)। ছবি: সংগৃহীত


পুনর্পাঠ
কেন লিখি
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যে সব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি। অন্য লেখকেরা যাই বলুন এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই যে, তাঁরা কেন লেখেন সে প্রশ্নের জবাবও এই।

চিন্তার আশ্রয় মানসিক অভিজ্ঞতা। ছেলেবেলা থেকেই আমার অভিজ্ঞতা অনেকের চেয়ে বেশি। প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণের কথাটা বাজে। আত্মজ্ঞানের অভাব আর রহস্যাবরণের লোভ ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিভাবানেরা কথাটা মেনে নেন। মানসিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ইচ্ছা ও উৎসাহ অথবা নেশা এবং প্রক্রিয়াটির চাপ ও তীব্রতা সহ্য করবার শক্তি অনেকগুলি বিশ্লেষণযোগ্য বোধগম্য কারণে সৃষ্টি হয়, বাড়ে অথবা কমে। আড়াই বছর বয়স থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস আমি মোটামুটি জেনেছি।

লেখার ঝোঁকও অন্য দশটা ঝোঁকের মতোই। অঙ্ক শেখা, যন্ত্র বানানো, শেষ মানে খোঁজা, খেলতে শেখা, গান গাওয়া, টাকা করা ইত্যাদির দলেই লিখতে চাওয়া। লিখতে পারা ওই লিখতে চাওয়ার উগ্রতা আর লিখতে শেখার একাগ্রতার ওপর নির্ভর করে। বক্তব্যের সঞ্চয় থাকা যে দরকার সেটা অবশ্য বলাই বাহুল্য,—দাতব্য উপলব্ধির চাপ ছাড়া লিখতে চাওয়ার উগ্রতা কিসে আনবে!

জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সঙ্গে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সমভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।

দান করি বলা ঠিক নয়, পাইয়ে দিই। তাকে উপলব্ধি করাই। আমার লেখাকে আশ্রয় করে সে কতকগুলি মানসিক অভিজ্ঞতা লাভ করে—আমি লিখে পাইয়ে না দিলে বেচারি যা কোনোদিন পেত না। কিন্তু এই কারণে লেখকের অভিমান হওয়া আমার কাছে হাস্যকর ঠেকে। পাওয়ার জন্য অন্যে যত না ব্যাকুল, পাইয়ে দেওয়ার জন্য লেখকের ব্যাকুলতা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। পাইয়ে দিতে পারলে পাঠকের চেয়ে লেখকের সার্থকতাই বেশি। লেখক নিছক কলম-পেষা মজুর। কলম-পেষা যদি তার কাজে না লাগে তবে রাস্তার ধারে বসে যে মজুর খোয়া ভাঙে তার চেয়েও জীবন তার ব্যর্থ, বেঁচে থাকা নিরর্থক।

কলম-পেষার পেশা বেছে নিয়ে প্রশংসায় আনন্দ পাই বলে দুঃখ নেই, এখনো মাঝে মাঝে অন্যমনস্কতার দুর্বল মুহূর্তে অহংকার বোধ করি বলে আফসোস জাগে যে, খাঁটি লেখক কবে হব।

সূত্র: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকের কথা, ১৯৫৭। তবে লেখাটি লেখা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে।