পুত্র বুলবুল মারা যাওয়ার আগে

পরিবারসহ কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: উইকি কমনস
পরিবারসহ কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: উইকি কমনস

নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী জিগ্যেস করলেন, ‘কাল কী হয়েছিল, বাবা?’

মঈনুদ্দীন বললেন, ‘কী আর হবে, মাসিমা? বুলবুল হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিল। তাই কবি তাকে ধমক দিয়েছিলেন।’

‘না, না’, মাথা নাড়লেন গিরিবালা, ‘নুরুর দোষ ঢাকার জন্য তুমি আমার কাছে গোপন করছ। নুরু নিজেই বলেছে। সে নাকি বুলবুলকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিল?’

‘এতে গোপনের কী আছে, মাসিমা? পিতা রেগে গিয়ে যদি ওকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেন, তাতে দোষের কী আছে?’

মাসিমার মুখে কালো ছায়া নামল। বললেন, ‘তুমি বুঝতে পারবে না বাছা, বুঝতে পারবে না।’

একটা অমঙ্গল আশঙ্কার ইঙ্গিত ছিল গিরিবালা দেবীর গলায়। এটা বুঝতে পেরে মঈনুদ্দীন খুব ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু কী ঘটেছিল আগের দিন?

কাজী নজরুল ইসলাম তখন থাকেন কলকাতার মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে। ছোট একটি তিনতলা বাড়ি। কিন্তু নবীন কবি-লেখকদের কাছে এটা ছিল তীর্থস্থান। হাজারো কাজের ফাঁকে প্রতিদিনই এখানে আসতেন অনেকে। আসতেন খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনও। কোন মঈনুদ্দীন চিনতে পারছেন? ছোটদের ছড়া ‘ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ...’ যিনি লিখেছেন।

আগের দিন বেলা তিনটা কি চারটা। মঈনুদ্দীন গিয়ে হাজির কবির বাড়িতে। দেখলেন, দোতলার একটা কামরায় বসে নিবিষ্ট মনে কবি কী যেন লিখছেন। তাঁকে দেখেই কবি একটু হেসে ইঙ্গিতে বসতে বললেন। অনেকটা দূরে মঈনুদ্দীন চুপ করে বসে আছেন। এমন সময় বুলবুল তার ছোট ছোট পা ফেলে ওপরতলা থেকে কাছে এসে দাঁড়াল। আর ‘কাকা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকে।

অরিন্দম খালেদের বয়স তখন চার বছরের মতো। সবাই তাকে বুলবুল নামে ডাকে। বাবার মতোই তার চোখেমুখে প্রতিভার দীপ্তি। বাবার মতোই চঞ্চল, অশান্ত। হারমোনিয়াম নিয়ে নজরুল বসলে, সে–ও বসে যায় পাশে। পুরোনো গান হলে সুর মেলায় বাবার সঙ্গে। নতুন গান হলে একবার শুনেই বলতে পারে। সবাই বলে, ‘গানে বাবাকে হার মানাবে বুলবুল!’

বুলবুল কাছে আসার পর মঈনুদ্দীন ওর সঙ্গে ফিশফিশ করে কথা বলতে লাগলেন। আর খেলনা নিয়ে ওর সঙ্গে খেলতে লাগলেন। মঈনের খুব সতর্ক দৃষ্টি ছিল, যাতে কবির লেখায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। কিন্তু ছোট অবুঝ ছেলে বুলবুল। সে কি আর এত কিছু বোঝে? খেলতে খেলতে উচ্ছ্বাসে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকার শুনে নজরুল খানিকক্ষণ মঈনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধমক দিলেন বুলবুলকে। বললেন, ‘দুষ্টু ছেলে, যাও এখান থেকে, বের হও!’

ছোট শিশু নিজের ভুল বুঝল। পিতার রাগ বুঝল। মুখ কাঁচুমাচু করে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মঈনুদ্দীন একরকম হতভম্ব হয়ে গেলেন। সংকুচিত হলেন লজ্জায়, দুঃখে। তার জন্যই বুঝি বুলবুলকে এমন করে বকা খেতে হলো।

খানিক বাদে লেখা শেষ করে কবি উঠলেন। প্রশান্ত মনে বললেন, ‘কী রে, কেমন আছিস?’

মঈনুদ্দীন এ প্রশ্নে কান দিলেন না। বললেন, ‘আপনি রাগ করতে পারেন বুলবুলের ওপর? কেন এমন হঠাৎ রেগে গেলেন? এমন রাগ তো আপনার দেখিনি কখনো।’

নজরুল বোধ হয় মঈনের দুঃখ বুঝলেন। মুখে মৃদু হাসি টেনে বললেন, ‘তুই একটু বোস, আমি আসছি।’

একটু পরেই তিনি বুলবুলকে কোলে নিয়ে ফিরে এলেন। বললেন, ‘ছেলেমানুষ, একটু রাগে ওদের কী হয়? এসব কথা ওদের কি মনে থাকে?’

বুলবুলকে কোলে নিয়ে মঈনুদ্দীন আদর করতে লাগলেন। কিন্তু সে বড় অভিমানী ছেলে। তখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন এ ঘটনার স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন, ‘অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ওর সঙ্গে আর আলাপ জমাতে পারলাম না। এরপর অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি চলে এলাম।’

পরদিন আবার কবির বাড়িতে গেলেন মঈনুদ্দীন। শুনলেন, ওপরের কামরায় বুলবুলকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার ভীষণ জ্বর। মঈনুদ্দীন লিখেছেন, ‘মনের ভিতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কেন, জ্বর তো অনেকেরই হয়। এ জন্য আমার মন এমন করছে কেন?’ একটু পর নজরুলের শাশুড়ি এসে আগের দিনের ঘটনা জানতে চাইলেন। শুনে অমঙ্গল আশঙ্কায় বারবার মাথা নাড়তে লাগলেন।

এ ঘটনার দু-এক দিন পর জানা গেল, বুলবুলের বসন্ত হয়েছে। বসন্তের গুটি সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি চোখেও গুটি দেখা দিয়েছে। বুলবুলের শারীরিক অবস্থায় নজরুল মুষড়ে পড়লেন। তাঁর সাধ্যমতো চিকিৎসার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু দিন দিন বুলবুল নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগল। রোগযন্ত্রণায় ককাত শুধু। ওই সময়েও সে পিতাকে একটুও কাছছাড়া হতে দেয়নি। নজরুল তার শিয়রের কাছে বসে অনুবাদ করতে লাগলেন হাফিজের কবিতা। লিখলেন—

কী লাভ, যখন দুষ্ট ভাগ্য
হাসল নাকো মুখ ফিরিয়ে,
পেল না দিল্ সুখের সোয়াদ,
দিন কাটাল ব্যথাই নিয়ে!
যে ছিল মোর চোখের জ্যোতি,
পুত্লা আঁখির, গেছে চলে!
নয়ন-মণিই গেল যদি,
কী হবে এ নয়ন দিয়ে॥

বসন্তের গুটি বের হওয়ার এক হপ্তা পরের ঘটনা। তখন বিকেল চারটা। মঈনুদ্দীনকে দেখে ওপর থেকে ছুটে এলেন নজরুল। বললেন, ‘দেখ্, দমদমে নাকি একজন সাধু থাকেন। তিনি সর্বরোগের ধন্বন্তরী। একবার তাকে ডেকে আনতে পারিস?’

দোতলার কামরায় মঈন তখন একাই বসেছিলেন। ছোঁয়াচ লাগার আশঙ্কায় বাইরের কাউকে রোগীর কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। মঈনুদ্দীন বললেন, ‘কেন পারব না? এখনই যেতে হবে? না, কাল সকালে গেলে চলবে?’

কিন্তু কাল সকালে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না বুলবুলের। নজরুল আকুল হয়ে বললেন, ‘না, না, তোকে আজই, এখনই যেতে হবে।’

দমদম ওখান থেকে কাছের পথ নয়। ফিরতে রাত হয়ে যাবে। মঈন তাই বললেন, ‘যাচ্ছি। কিন্তু আর কাউকে কি পাওয়া যাবে না? অচেনা-অজানা জায়গা, একজন সঙ্গী হলে ভালো হতো।’
কবি এ কথার কোনো জবাব দিলেন না। আর দাঁড়ালেন না তিনি। দাঁড়ানোর মতো মনের অবস্থাও ছিল না তাঁর। তিনি ওপরে চলে গেলেন।

মঈনুদ্দীন একজন সঙ্গী নিয়ে তখনই রওনা হয়ে গেলেন সাধুজির উদ্দেশ্যে। কিন্তু কপাল খারাপ, তার দেখা পাওয়া গেল না। বিফল মঈনুদ্দীন অনেক রাতে ফিরলেন কলকাতায়। কবির বাড়িতে ঢুকতেই নজরুল ওপর থেকে ছুটে নেমে এলেন নিচে। মঈনকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আচ্ছা, বলতে পারিস, সাধু মরা দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না? বল্–বল্, তিনি কি মরা দেহে প্রাণ দিতে পারেন?’

ঘরে গিজগিজ করছে লোক। মঈনের আর বুঝতে বাকি রইল না, বুলবুল উড়ে গেছে। ছেলে ‘ভোঁ-গাড়ি’ চড়তে চাইত। নজরুল তাই বুলবুলকে গোরস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন মোটরগাড়িতে করে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।