আমার সামান্য খাওয়াদাওয়া

>কত কাণ্ডই তো ঘটে ছেলেবেলায়। সেসব ঘটনা কত না মধুর, রসেবশে টইটম্বুর। ঈদ আয়োজনে এই সংখ্যার প্রচ্ছদে বরেণ্য তিন সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, নির্মলেন্দু গণ ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন তাঁদের ছেলেবেলার মজার ঘটনা

ছেলেবেলায় আমি কেমন ছিলাম, তা বোঝাতে ছেলেবেলার একটা কবিতা থেকে দুটো লাইন তুলে ধরছি:

ঘোষেদের রবি

সে বড় লোভী।

ছেলেবেলায় আমি ছিলাম এই রবির মতো। কেবল ছেলেবেলায় নয়, বড় হওয়ার পরও। এই সেদিন পর্যন্ত খাওয়ার সময় লোভের ঘোরে চারপাশের মানুষদের চিনতে পারতাম না। আমার এক বয়সী বন্ধু প্রায়ই বলেন, ‘তুমি খাও লোভী বালকদের মতো’—কথাটা ভুল নয়। আজ এই বয়সেও সামান্য ‘ভাত’ শব্দটা জিবে পানি ছাড়া আমি উচ্চারণ করতে পারি না।

করটিয়ায় থাকতে একবার সেখানকার ডাক্তার মণিবাবুর বাসায় গিয়েছিলাম এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। তিন দফায় সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আমি বসেছিলাম প্রথম দলের সঙ্গে, কিন্তু তৃতীয় দফার লোকেরা উঠে যাওয়ার পরও আমার খাওয়া চলছে। এর মধ্যে মা বারকয়েক এসে তাগাদা দিয়ে গেছেন ওঠার জন্য, কিন্তু আমার ভাবান্তর নেই। একসময় পিঠের ওপর মার হাতের ভারী কিলগুলো তালের মতো পড়তে শুরু করল। কিন্তু আমি নির্বিকার। এমন সুস্বাদু খাবার যদি খাওয়াই যায়, তো এসব এক-আধটু কিল খেতে অসুবিধা কোথায়। আমার পুরো মনোযোগ তখন খাওয়ার দিকে। পিঠের ওপর মার কী ধুপধাপ পড়ছে, আর তা খেতে খেতেই আমি ক্ষুব্ধস্বরে বলে চলেছি, ‘আহ, খাইয়া লই।’

আমি যে কতখানি লোভী ছিলাম, ছাত্র বয়সের একটা গল্প বলে তা বোঝাই। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। মুন্সিগঞ্জে বেড়াতে যাচ্ছি আমাদের বাসায়। যাওয়ার পথে পকেটের সাকুল্য সঞ্চয় দিয়ে মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে গোটা পঞ্চাশেক লিচু কিনে নিয়েছি ছোট ভাইবোনদের জন্য। কিন্তু কিছুটা হাঁটার পরই হঠাৎ টের পেলাম, হাঁটা শুরু করার পর থেকেই আমি লিচুগুলো নিঃশব্দে খেয়ে চলেছি। কিছুদূর গিয়ে টের পেলাম, যে হারে আমি খাচ্ছি, তাতে বাসা পর্যন্ত পৌঁছানোর পর কোনো লিচুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু খাওয়া তো বন্ধ করা সম্ভব নয়। তা হলে কী করে অন্তত অল্প কিছু লিচু বাসা পর্যন্ত নিই? দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। অনেক ভেবে দেখলাম, লিচু বাঁচানোর উপায় একটাই—দৌড় দেওয়া। প্রাণপণে দৌড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে পারলে, খাওয়ার সময় না পাওয়ায়, গোটাকয় লিচু বাঁচতে পারে। দিলাম দৌড়। কিছু লিচু শেষ পর্যন্ত বাসায় পৌঁছাল।

একদিনের একটা ঘটনা মনে পড়লে আজও খারাপ লাগে। ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপিকা শায়েস্তা আপা প্যারিস থেকে অলৌকিক স্বাদের কিছু টফি এনেছেন। তাঁর বাসার লোকজনই এর মধ্যে টফির বাক্স প্রায় সাফ করে দিয়েছে; গোটা দশেক কোনোমতে আনতে পেরেছেন আমাদের জন্য। তিনি আমাকে তা থেকে গুনে গুনে চারটা টফি দিয়ে বললেন, ‘এর একটা আপনার, একটা গিন্নির, আর দুটো দুই মেয়ের।’ আমি তাঁর কথা সজ্ঞানে ও সুস্থ মস্তিষ্কে বুঝে সেগুলো গ্রহণ করলাম। টফিগুলো হাতে নিয়ে প্রথমেই নিজেরটা মুখে ছুড়ে দিলাম। অপার্থিব স্বাদ। মুখের ভেতরটা মাধুর্যে যেন ভরে উঠল। তাড়াতাড়ি রওনা হলাম বাসার দিকে; যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, যার যা হক তা তার হাতে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম কলেজের গেট পর্যন্ত যেতে না যেতেই কখন যেন নিজের অজান্তে আর একটা মুখে দিয়ে ফেলেছি। কখন যে দিলাম, আমি নিজেও জানি না। মনে হলো আমার নিয়তি যেন অলক্ষ্যে টফিটা আমার মুখে তুলে দিয়ে চলে গেছে। ধরে নিলাম গিন্নির অংশটা লোপাট হলো। খারাপ লাগল, কিন্তু স্ত্রীদের ওপর স্বামীদের একটা বৈধ দাবি আছে মনে করে সহ্য করলাম। মেয়েদের বেলায় তো এসব ফিকির খাটবে না। তাড়াতাড়ি রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। যে করেই হোক, তাড়াতাড়ি ওদেরগুলো পৌঁছাতে হবে। রিকশায় চলতে চলতে হঠাৎ টের পেলাম, আমার ডান হাতটা নিঃশব্দে আমার ডান পকেট থেকে একটা টফি খুবই আলগোছে বের করে নিল। একসময় আরও বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম, আমার বাঁ হাতটা ডান হাতের দিকে এগিয়ে এসে দুজনে মিলে ওর মোড়কটা খোলার চেষ্টা করছে। আমার চোখের সামনে একবার বড় মেয়েটার করুণ মুখ ভেসে উঠল। আমার হাত দুটোও সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। কিন্তু তারপরে ভালো করে তাকাতেই দেখি, আমার হাত দুটো কী করে টফির মোড়কটাকে এরই মধ্যে খুলে ফেলেছে। আমার সামনে মেয়েটার বিমর্ষ মুখ আবার ভেসে উঠল। আমার হাত দুটো আবার কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি, গোটা টফিটা আমার মুখের ভেতরে। আত্মধিক্কারে মনটা ভরে গেল। বাবা হয়ে এ কী করলাম আমি! কোনো বাবা কি এমন স্বার্থপর হতে পারে? কিন্তু এখনো আর একটা টফি বাকি। যেমন করেই হোক, ওটাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু ওটা আর কার জন্য নেব? নেওয়া মানেই তো কাড়াকাড়ি, অশান্তি। শুধু একজনের জন্য কী করে নেওয়া যায়? বাকিদের কী বলব? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দেখি বাকিটাও আমার মুখের ভেতরে।