তিন ভুবনের চাঁদ

>তিন প্রজন্মের ঈদ উদ্‌যাপন নিয়ে লেখা

প্রথম

মুণ্ডু আর মাথা এক ভাবনায় ছিল; যখন ছিল আমার ঈদ সেই গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। সাবান-ফেনায় স্নান থেকে বালকের ফুর্তি উড়ে-ঘুরে পোশাক ছুঁয়ে যেত। সকাল ছিল ম ম এক বাতাসের খেলা, সেখানে কুমার নদের চলা যেন আনন্দের ভেতর আরও কিছু স্রোত ঢেলে দেওয়া। বড়দের সঙ্গে, বলতে গেলে পরিবার–প্রধান হিসেবে আমার মাতামহের একটি প্রচ্ছন্ন দাপট⎯ওই দিন বুঝিবা প্রসন্ন প্রহর হয়ে ঈদগাহ পর্যন্ত পৌঁছে দিত। বলে নিই, আমার শৈশব কেটেছে প্রত্যন্ত এক গ্রামে⎯নাম রসুলপুর, জেলা শহর ফরিদপুর থেকে প্রায় ১২ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, মাতুলালয়ে। আনন্দ, উল্লাস এবং স্বাধীনতা জড়াজড়ি করে একটি নির্দিষ্ট দিনকে অনির্দিষ্ট করে তোলার নামই ছিল ঈদ। আগের রাত কেটেছে বাড়ির নারী সদস্যদের কর্মযজ্ঞে, তা ছিল হাতে কেটে চালের গুঁড়ি থেকে সেমাই তৈরি করা কিংবা মাংস-পোলাও রান্নার আয়োজন। হারিকেনের আলো এবং জোনাকির জ্বলা-নেভা প্রতিযোগিতার এক বালকের ভোরের প্রত্যাশা যেন মায়ের চোখকেও ফাঁকি দিতে পারেনি। তো, ঈদের দিন সকালের নামাজ, সালাম-কোলাকুলির ফাঁকে একটি ছোট্ট খিদে যখনই জানান দিয়েছে, তখনই ঘন দুধের ভেতর সযত্নে বানানো কুসুমদলসম সেমাইয়ের অপূর্ব বাহার তা পূর্ণ করেছে। মাতামহীর প্রশ্রয়, মায়ের স্নেহ—এবং সেই সঙ্গে মাতামহ এবং পিতার অদৃশ্য আশিস বুঝিবা ঈদের দিনটিকে কেন্দ্র করে হিজলফুল হয়ে ঝরে পড়েছে।

এক বালকের স্মৃতিময় ঈদ ১০ বছর পর শহরে এসে অন্য রূপ পেল। ফরিদপুর শহরে আমাদের পরিবারের বসবাস ছিল নতুনভাবে শেকড় পোঁতার মতো। সেখানে মাতামহ-মাতামহী নেই, কেবল মা ও বাবার প্রাধান্য। প্রতি ঈদের আগের সন্ধ্যা চাঁদ দেখার লুকোচুরিতে কাটত। তখন দেশটির পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশে দুই দিন শাওয়ালের চাঁদ উঠত। এই চাঁদের বাহানায় ঈদের জামাতেরও সরকারি-বেসরকারি ভাগ ছিল। ফলে ঈদও দুদিন হওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। কিশোরের ঈদ যখন তারুণ্যে পৌঁছুল, তখন বয়স ১৮, গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি। আব্বাকে নেতা মেনে তাঁর পেছনে জায়নামাজ-চাদর বহন করে রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে ঈদের জামাতে যাওয়া। ইমামের খুতবা শোনা, নামাজ শেষে মোনাজাত-কোলাকুলি করা। আব্বাকে সালাম করে বাসায় ফিরে মাকে সালাম করা। এবার আর হাতে কাটা সেমাই নয়, রীতিমতো কলে বানানো মিহি সেমাই। সে সেমাই বলক ওঠা দুধে পড়ে অমৃত। মুখে দেওয়ামাত্র টুক করে গিলে ফেলা। ত্বর সয় না, মুহূর্তেই সাফ হয় প্লেট! সবকিছুর পরও যেন একটি অন্য হাওয়া ঝাপটা দিয়ে যায়, অন্য কিছু ঝেঁকে দেয় আস্থা-অনাস্থার কাণ্ডটি।

যৌবনের ঈদ তো ঢাকা শহরে; জীবনের ঈদ দেশ-বিদেশের নানান স্থানে। আনন্দের দিনটির জন্য পরিবারের অপেক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকতেই হয়—তাই বুঝি নিয়ম! তবুও মুক্তিযুদ্ধকালীন, সেই একাত্তরের ঈদ তো ছিল অন্য রকম—অন্য আয়োজনে, অন্য ভঙ্গিতে! বালু-কাদামাখা দৌড়ের ওপর দিয়ে টান টান উত্তেজনা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পেল ঈদ উত্সবের এক নতুন মাত্রা। সর্বজনীনভাবে পালনের পাশাপাশি মিলনের এক চিত্রভূমি। চাঁদ দেখা সংকট ফুরোল, আমরা চাইলাম সকল ‘কু’ বিসর্জন দিয়ে ‘সু’-কে আবাহন করতে। তা কি পারলাম? প্রশ্নটির উত্তর না মিলতেই যৌবন পার করে আজ প্রান্ত-বয়সে আনন্দ-উত্সবের সন্ধান করছি। সেখানে ঈদের প্রসঙ্গ তো নতুন বিবেচনায় আসতেই পারে। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন, সুহৃদদের সান্নিধ্যে উত্সব উপভোগ,—এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অংশীভাগী তো হওয়া যেতেই পারে!

দ্বিতীয়

আমার পুত্র-কন্যাদের ঈদের আবহাওয়া তাদের শিশুকাল থেকে নানা ছন্দে, নানা মাত্রায় বদলেছে। মোচড় দিয়েছে ঢাকা শহর, পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে সেই মালিবাগ-মগবাজার-ইন্দিরা রোড-গ্রিন রোড-ধানমন্ডি হয়ে একসময় উড়ালও দিয়েছে প্রবাসে। এক যুগ হতে চলল বড় মেয়ে অর্চি কানাডায়। অর্চির ঈদ ওর কন্যা অগ্নিবর্ণাকে ঘিরে। যতদিন ঢাকায় ছিল, আমরা দিনের কোনো না কোনো সময় এক ছাদের নিচে সবাই মিলিত হতাম। উপহারসামগ্রীর আড়ালে যে উষ্ণতা ছুঁয়ে যেত⎯তা এখন দারুণভাবে অনুভব করি। এই তো বছর কয়েক আগে এক ঈদে ওদের সঙ্গে কানাডায় থাকা হলো। সকাল থেকে সাজ-সাজ পরিবেশ। স্ত্রী যোরাকে নিয়ে এক ঈদ-সম্মিলনে যোগ দেওয়া গেল; বাঙালির বাড়িতে ঈদের ভোজ। সে তো পেল্লায় কাণ্ড! এক বাড়ি বলে কথা নয়, নারী-পুরুষ একত্রে ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি বাড়ি ঘুরে লন্ডন অন্টারিওর ঘিয়ের ঘ্রাণ, কিশমিশের স্বাদের সঙ্গে গৃহবাসীর যে হার্দ্য-স্পর্শ পাওয়া গেল তা ছিল বড় নির্মল, অতি উচ্ছল। দিলখোলা এক ঈদ উদ্‌যাপন। অর্চি যে বছর ঈদে ঢাকা বেড়াতে আসে⎯তখন আহ্লাদ-আমোদের এক ঝরনা প্রবাহিত হয় আমাদের পরিবারে।

এবার ছোট মেয়ে অর্থীর কথা। ওর ঈদ দুই পুত্র ইয়ার্দিন-ইয়াভিনের সঙ্গে স্বামী সনিকে ঘিরে। আমাদের ভেতর-মহলটি নিয়ে ওর মেতে ওঠা। অর্থী ঈদের আনন্দ শুরু করে প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই। সবার জন্য উপহার কেনা, খানাখাদ্যের জন্য বিশেষ-বিশেষ উপকরণ থেকে সামাজিক কিছু দায়িত্ব পালন ও নিষ্ঠার সঙ্গে করে যায়। সারাক্ষণ ভালোর পক্ষে থাকা আমার এই মেয়েটির মুখশ্রী দেখেই বোঝা যায়⎯ঈদ আসছে। ঢাকা শহরে ধানমন্ডি থেকে অর্থীর বাসস্থান বসুন্ধরা এখন অনেক দূর। তবু দূরকে কাছে নিয়ে আসে স্নেহের টান, রক্তের দাবি। আমাদের ভালোবাসা তো নিম্নমুখী, তার অভিপ্রায় সাগরে মেশা।

তীর্থ আমার একমাত্র পুত্র। জগতের বিচিত্র বিষয়ের প্রতি আগ্রহ নিয়ে বাল্যকাল কাটিয়েছে। তার মধ্যে মাতার প্ররোচনায় একবার টেলিভিশন নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবেও অভিনয় করেছে। ছবি এঁকেছে, গান শুনেছে, কার্টুন দেখেছে...। বোধকরি সবকিছুর মধ্যে থেকেও আমার আঙুল ধরে একবার তেজগাঁও কলেজ মাঠে ঈদের জামাতে অংশ নেওয়ার জন্য গেছে। ওর ঈদের ভেতর সকালের খাবার টেবিল যেমন হাজির ছিল, তেমনি দুপুরের ঘুমও ছিল পাহারায়। অনেক দিন হয়, আনন্দের বিশেষ দিনটি চিহ্নিত করতে গেলে আমি যেমন সম্পূর্ণ সংকোচহীন হতে পারি না; তীর্থও কি তাই?

তৃতীয়

একটা বিড়ালের গল্প শুনেছি, এবং একটি কার্টুন বিড়ালকে ফেসবুকে দেখি। বিড়াল দুধ-চিনি খায় কিন্তু কাঁটা ছোঁয় না। যখন কাঁদে, তখন ঘরের জানালায় সপ্তস্বর এক হয়। সে বিড়াল ঘুমে থাকে আবার জাগরণে পায়েপায়ে ঘোরে। সে বিড়াল স্বপ্ন দেখে, আবার বিছানা-বালিশ তছনছ করে। এ বিড়ালের সঙ্গে বড় ভাব অদ্রির। অদ্রি আমাদের তীর্থ-আদবানার একমাত্র কন্যা। এক বছর বয়স না হতেই ও ঈদের আনন্দের ছোঁয়া পাবে। ওর মায়ার সঙ্গে ছায়া হয়ে পিতামহ হিসেবে আমিও কি থাকব না?

ইয়ার্দিন-ইয়াভিন দুই ভাই গলাগলি বসে-শোয়। ওদের আনন্দের মধ্যে গাড়ি যেমন আছে⎯আছে ঘোড়াও। ইস্পাতের গাড়ি এবং কাঠের ঘোড়া নিয়ে পাল্লায় কে জেতে দেখার বিষয়। ঈদ আসছে, পোশাকের বায়না তেমন নেই; তবু পোশাক হবে থরে-থরে। খাওয়ার আগ্রহ নেই⎯তবু টেবিলভর্তি চিংড়ির লেজ, মুরগির পা, আইসক্রিমের চোখ উঁকি দেবে। ঈদগাহ, মোনাজাত, কোলাকুলি এখনো টোকা না দিলেও ঈদ-সালামি কিন্তু ঢেঁড়া পিটিয়ে যায়। খনি থেকে ননী তোলার মতো তারা সেখানেও কি ঝাঁপ দেবে না?

অগ্নিবর্ণার কথা বর্ণময়, অগ্নিবর্ণার সুর স্বর্ণময়। পোশাকের স্বাতন্ত্র্যে, চলা ও বলার পরিমিতিতে সে অতুলনীয়। এবারের ঈদে বাঁশি বাজাবে কি না⎯দূরে বসে তা জানব না। চিজ কি চিকেন ঠোঁটে-দাঁতে লেগে থাকবে কি না⎯তা ঢাকা থেকে দেখতে পাব না। তবে ঢাকায় অগ্নিবর্ণার ঈদ ছিল সেই শিশুমহলের, আর এক যুগ পেরিয়ে লন্ডন–অন্টারিওর ঈদ অনেক ঝকঝকে, তকতকে। আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হবে তার আপন স্বাতন্ত্র্য।

আমার কিংবা আমাদের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় আমার সন্তানদের ঈদ-উত্সব ও ঈদ-ভাবনা ভিন্নতর। আবার আমার সন্তানদের সন্তানেরা যেভাবে এখন ঈদ-আনন্দে অবগাহন করছে⎯তাতে তাদের অভিভাবকদের প্রতিচ্ছায়া বিদ্যমান। তিন ভুবনের চাঁদের আখ্যান পেছনে-সামনে মিলিয়ে বাস্তবের এবং স্বপ্নের শর্তগুলো পূরণ করে। শাওয়ালের চাঁদ মানে ঈদ⎯আর সেই ঈদ ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেও যায়। চাঁদের ভাষার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয় আনন্দের রূপ। ধর্ম ও মর্ম অনন্তস্রোতে আমাদের অবগাহন করুক।

লেখক: কবি এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক