জিন্দা পার্কে একদিন

জিন্দা পার্কে এভাবেই আনন্দে মেতে ওঠেন দর্শনার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার
জিন্দা পার্কে এভাবেই আনন্দে মেতে ওঠেন দর্শনার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার

বেশ কিছুকাল ধরে আমরা এ দেশটির নানা জায়গায় যে বেড়াতে যাই তার বেশির ভাগই সম্ভব হয় লেখক-অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস-পারভীন ইলিয়াস দম্পতির উৎসাহে। এই এপ্রিলে ইলিয়াস, পারভীন ও তাঁদের কন্যা কেতকীর সঙ্গে আমি ও আমার স্ত্রী রাকা তাঁদের গাড়িতে যাই জিন্দা পার্ক বলে একটি চমৎকার জায়গায়। সেদিন আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন অধ্যাপক ফয়েজ মোহাম্মদ সিরাজুল হক, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের পুত্র। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ৩০০ ফুটের রাস্তা ধরে এই পার্কটিতে যেতে হয়। পূর্বাচলের দিকে গিয়ে হাইওয়েতে উঠতে হয়। জানা গেল, গাঁয়ের নামটি জিন্দা গ্রাম, জিন্দা গ্রামেই পার্কটি গড়ে উঠেছে যৌথ উদ্যোগে। শুনলাম এই জায়গাটা নারায়ণগঞ্জের শেষ প্রান্ত। ঢাকা শহর দিনে দিনে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে বলে বাইরে ও দূরে কোথাও যাওয়ার সুযোগ পেলেই চনমন করে ওঠে মন। প্রথমটায় মনে হচ্ছিল কাছাকাছি কোথাও যাওয়া হচ্ছে আমাদের, পরে বোঝা গেল জায়গাটির দূরত্ব যথেষ্টই, ঘণ্টা দুয়েকের কাছাকাছি লাগল পৌঁছাতে। অরণ্য পরিবৃত সুন্দর এক জায়গায় জিন্দা পার্কটি। কিছু কিছু দালানকোঠা দেখে বোঝা গেল এখানে আরও অনেক কিছু গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। লেক ও গাছপালা দেখে আমাদের মন ভরে গেল খুশিতে। সেখানে গাছগাছালির মধ্যে চারপাশ-খোলা একটি রেস্তোরাঁ। এখানে দুপুরের খাবার খেলাম আমরা। জলাভূমিও আছে চারপাশে। বাঁশের সাঁকোও আছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার। ঢাকা শহরের এত কাছে এমন একটি জায়গা থাকতে পারে কল্পনা করা যায়নি। অনেক রকমের গাছ, কারও তেমন চেনা নেই। তবে স্থানীয়দের কেউ কেউ নাম বলে দিলেন। চা খাওয়া হলো আরও একবার। এক জায়গায় বসে আড্ডা হলো। টেপ রেকর্ডার থেকে গান শোনা হলো, খালি গলায় দু-একজন গাইলেন। এমন জায়গায় এলেই না ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ গেয়ে উঠতে ইচ্ছা করে বা নিজের পছন্দের কোনো গান।

পার্কের ভেতরে অভিনব ধরনের একটি সুউচ্চ লাইব্রেরি-ভবন।

সর্বোচ্চ তলায় উঠে গেলাম আমরা। সারা শহরের ছবি তোলা, দেখা হলো। নিজেদেরও ছবি তোলা হলো। আহা, অনেক অনেকক্ষণ সেখানে বসে থাকার ইচ্ছা হলো। কারণ, রোদ পড়ে এসেছে, ঝিরিঝিরি হাওয়া। এই ভবনে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হচ্ছে, তার নমুনা দেখা গেল। মনে হচ্ছিল এত উঁচুতে বসে বই পড়তে নিশ্চয় ভালো লাগবে, হাওয়া খেতে খেতে। বেশ কিছুক্ষণ আমরা এই উঁচু প্রাসাদটির সর্বোচ্চ তলায় কাটালাম। তারপর নামতে লাগলাম। আবারও চা, বিস্কিট খাওয়া হলো, আইসক্রিম খেলাম কেউ কেউ। আবারও আড্ডা এদিক-সেদিকে বসে। যন্ত্রে গান শোনা, উৎসাহী গায়কের গান গেয়ে ওঠা।

এতক্ষণ আমরা ভ্রমণের গল্প নিয়ে ছিলাম। এবার এক অন্য রকম ঘটনার কথা শোনা যাক। ইলিয়াসের গাড়িতে আমরা ছিলাম। সামনে চালক। পেছনের দুটি সারিতে আমরা। হাইওয়েতে বা বড় রাস্তায় বেশ ভালোই চলছিল আমাদের গাড়ি। হঠাৎ দূরে দেখা গেল একটি হাতির ওপর বসে একজন লোক, যে হাতিটিকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। কাছাকাছি চলে এল হাতি এবং হঠাৎ আমাদের গাড়ির সামনে এসে গতি রোধ করে দাঁড়াল। হাতিকে দিয়ে এমনভাবেই পথ আটকানো হলো যে আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই থাকল না। হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ি ভেঙে ফেলার ভয় দেখাতে লাগল। আর মাহুত বলতে লাগল, খুশি করেন, খুশি করেন একে, টাকা দেন। ইলিয়াস ১০০ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন। মাহুত কী এক ইশারা বা কায়দা করল যে হাতি তার শুঁড় উঠিয়ে গাড়ি ভেঙে ফেলার ভাব করতে লাগল, মাহুত বলে উঠল, আরও দেন আরও দেন, নাইলে কিন্তু খবর আছে, ইলিয়াস তাড়াতাড়ি আরও ২০০ টাকা চালকের হাতে দিলেন, চালক কায়দা করে সে টাকা হাতির সামনে ছুড়ে মারল। মাহুত সাহেব তখন দয়া করে আমাদের পথ ছেড়ে দিতে হাতিকে সরিয়ে নিল।

তো, এই হচ্ছে আমাদের নতুন ঢাকা। কত রকমের ছিনতাই যে হয়। হাতি দিয়ে ভয় দেখিয়েও ছিনতাই। মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছি, দুঃস্বপ্ন। কিন্তু, এমনই আমাদের নতুন বাস্তবতা।