জলের বুকে পানকৌড়ি

বয়স হলে কি গরম লাগা কমে যায়? তা যায় বোধ হয়। কারণ কুহেলির খুব মনে আছে ও যখন গরমের ছুটিতে হোস্টেল থেকে বাড়ি আসত তখন রাতে একটা সেমিজ পরে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে ঘুমাত। তা-ও ঘেমেনেয়ে একাকার। পাশের রুমে তার দাদি ঘুমাত মাথায় ঘোমটা দিয়ে ফ্যান না ছেড়ে। ফ্যান ছাড়লে তার নাকি গা শিরশির করত। ঠান্ডা রক্ত? অথচ যেবার ডিসেম্বরে স্টেশনমাস্টারের মেজ ছেলে ‘শুভবিবাহ’ নাটক করল, ওদের ছোট্ট মফস্বল শহরে সেবার কী শীত! কী শীত! গিরিন বিশ্বাস মডেল বালক বিদ্যালয়ের খোলা অডিটরিয়ামে সেই প্রথম নাটক দেখা। অডিটরিয়ামের উত্তর পাশেই বাবুর পুকুর। মানে গিরিন বাবুর পুকুর। হু হু করে হাওয়া আসছিল। তবে কী আশ্চর্য কুহেলি কুলকুল করে ঘামছিল। কুহেলি তখন মাঝেমধ্যে মায়ের তুলে রাখা শাড়ি পরে কলেজে যায়। রিটায়ার্ড স্টেশনমাস্টার ছেলেদের নিয়ে তাদের পুরোনো বাড়ি চুনকাম করে এসে উঠলেন। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তার মেজ ছেলে কবিতা লেখে, নাটক করে। ঝাঁকড়া চুল। তার সরু পাড়ের কাশ্মীরি চাদরের দোলা এলাকার কিশোরীদের মল্লিকা বনে প্রথম কলি ধরাল। কুহেলি কবিতা লিখল—

‘পুকুরে শুয়ে থাকো জলের শাড়ি, টান টান।

পানকৌড়ি আটকে যায় আঁচলের নিচে।’

তখন অমিল গদ্য কবিতার কাল। আজকের কুহেলিকার হাতেখড়িও অন্য বড় সাহিত্যিকদের মতো কবিতাতেই প্রথম। এখন তার বেশ নামডাক কথাসাহিত্যে। আসল নাম কুহেলি পারভিন হলেও কুহেলিকা নামেই লেখালেখি। বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছে সে। কিন্তু আগাগোড়াই প্রচারবিমুখ। এবারও গাঁইগুঁই করেছিল যোগদান না করার জন্য। ছাড়েনি নিজ মফস্বলের সাহিত্য সংগঠন ‘শেকড়ে ফেরা’র তরুণ সম্পাদক সাজিদ উল আকরাম। বলল, ‘আপা, আপনি আমাদের এলাকার গর্ব। আমাদের তেমন সংগতি নেই। কিন্তু পঁচিশ বছর পূর্তির এ বছর আপনাকে আমরা পুরস্কার দিচ্ছি। ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া, দুদিন অনুষ্ঠানের জন্য থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব সংগঠনের। নিজস্ব এলাকার প্রতি আপনারও কি সামান্য কর্তব্য নেই আপা?’

অনেক দিন বাড়ি আসা হয়ে ওঠেনি কুহেলির। ঘর-সংসার, মেয়েদের লেখাপড়া, ওদের বিদেশ যাওয়া, নিজের সংসার ভাঙা—সব মিলিয়ে নিজের জন্য সময় বের করা কঠিন ছিল। নিরেট ইটকাঠের মতো লোকের সঙ্গে বসবাস ওর সৃজনশীলতার ওপর কংক্রিটের প্রলেপ ফেলছিল প্রতিনিয়ত। তবু ওরই মধ্যে একটুকরো ভালোবাসার মতো নিজের লেখালেখির জায়গাটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিল। এমন পিছুটানও নেই এখন। বলেছিল, ‘আরে না না, কী বলো? সে তো বটেই। আমি তো বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেইছিলাম। তোমাদের কিচ্ছু করা লাগবে না। আমি বাড়ি থেকেই অনুষ্ঠানে যাব। বয়স হচ্ছে। কিছু নিয়মকানুনের মধ্যে থাকা লাগে। কদিন বেশ ঠান্ডায় ভুগলাম। আচ্ছা, দেখা হবে।’

ট্রেনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরায় জানালার দিকে বসেছিল কুহেলি। ইদানীং গরমকালেও ব্যাগে একটা শাল রাখে ট্রেনে-বাসে-প্লেনে যাতায়াতের সময়। এসি কামরায় খানিক পরেই ওর ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। ব্যাগ খুলে শাল বের করে মাথা-গলা ভালো করে ঢেকে বসল। পরের স্টেশনে ওর পেছনের খালি সিটগুলো ভরে গেল। কথাবার্তা শুনেই বোঝা গেল ওরা একদল তরুণ কবি-সাহিত্যিক। যাচ্ছে আমন্ত্রিত হয়ে ‘শেকড়ে ফেরা’য়। সাহিত্য নিয়ে ওদের আলোচনার সবটাই কানে আসছিল কুহেলির। কান আরও খাড়া হলো যখন ওরা আলোচনা শুরু করল কুহেলিকাকে নিয়ে। ওরা জানে কুহেলিকাকে এবার পুরস্কৃত করা হচ্ছে।

‘গত সপ্তাহের গল্পটা পড়ে তো আমি একেবারে মুগ্ধ। কী বিষয়! কী বর্ণনা!’

‘আমি ভাই কুহেলিকার প্রেমে পড়ে গেছি। ওর গল্পের নায়িকারা এত সুন্দর! এত ব্যক্তিত্বময়! আর এ তো জানা কথা যে গল্পের নায়িকারা সাধারণতই গল্পকারেরই প্রতিচ্ছবি।’

‘একটু বেশি আদিরসাত্মক।’

‘আমরা পুরুষেরা যখন খোলামেলা লিখি তখন মনে করি এটাই স্বাভাবিক। নারী লেখকদের আমরা ছকে বেঁধে ফেলেছি। তার বাইরে গেলেই মনে হয় এ একটু বেশি বেশি। কিন্তু সত্যি করে বলো তো আদিরস পড়তে কার না ভালো লাগে?’

‘আরে আমি তো না পড়ে পাতা উল্টে যাই কখন “চুমু” শব্দটা আসবে এই খোঁজে। গাদিরস আমার ভাল্লাগে না।’

‘গাদিরস কী রে?’

‘গাদ্যিক রস’

‘তসলিমা নাসরিন পড়িস না?’

‘সে আর বলতে? যত গালমন্দই করি, পড়তে শালা জোশ লাগে!’

‘এত দিনে কুহেলিকাকে দেখতে পাব। কী যে ভালো লাগছে!’

‘তুই কি নিবেদনের জন্য প্রস্তুত?’

‘সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।’

‘আচ্ছা ধর, বয়স আমাদের চেয়ে বেশি হলো, তাহলে?’

‘তোর মাথা! এত সমকালীন লেখা বয়সীরা লিখতে পারে?’

‘আচ্ছা আমরা কেন ধরেই নিচ্ছি কুহেলিকা নারীই? ছদ্মনামে পুরুষও তো হতে পারে?’

‘নামটাই যখন কুয়াশাচ্ছন্ন।’

‘কিংবা এলই না অনুষ্ঠানে।’

‘আমি কেবলি স্বপন, করেছি বপন...।’

সকাল আটটায় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। কুহেলি একটু দেরিতে পৌঁছাল। সাহিত্য সম্পাদক সাজিদ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। রিকশা থেকে নামতেই সে এগিয়ে এল, ‘আপা নিশ্চয় কথাসাহিত্যিক কুহেলিকা?’

‘তুমি সাজিদ?’

‘জি আপা। আমি আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত। ছোট্ট এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছি বলেই আপনার দেখা পেলাম। কত দিন বাড়ি আসেন না আপা?’

‘খুব কম। মা মারা যাওয়ার পর গত পনেরো বছরে আসাই হয়ে ওঠেনি।’

‘কতজন আপনাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। বসবেন চলুন’ বলে সাজিদ কুহেলিকাকে শামিয়ানার নিচে নিয়ে এল। তরুণ-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকদের কী উৎসাহী হাঁটাচলা! কেউ পকেট থেকে নতুন কবিতা বের করে কাউকে শোনাচ্ছে, কেউ থামের আড়ালে গিয়ে নিজে নিজে মহড়া দিচ্ছে। কারণ বিকেলের পর্বে স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর বসবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর আসাম থেকেও এসেছেন জনা কুড়ি। নিজের প্রকাশিত বই কোলে নিয়ে বসে আছেন প্রবীণ কবিরা। যেন নবজাতক সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন দুহাত দিয়ে। সাজিদের ছোটাছুটি বেশি। একবার অতিথিদের সামনে এসে বিনয়ে নুয়ে পড়ে কুশলাদি নিচ্ছে, একবার স্টেজে উঠে চেয়ারের সংখ্যা বাড়াচ্ছে, একবার মাইক টেস্ট করার জন্য ‘হ্যালো, ওয়ান, টু...’ বলে সবাইকে প্যান্ডেলে আসার অনুরোধ করছে। এ বছর মোট চারজনকে পুরস্কৃত করছে শেকড়ে ফেরা। দুজন কবিতায়, একজন প্রবন্ধে, একজন কথাসাহিত্যে। যারা এ অঞ্চল ছেড়ে দেশভাগ বা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা কবি-সাহিত্যিক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে শেকড়। নাড়ির টানে অনেকেই আসতে চায় কিন্তু হয়ে ওঠে না। শেকড় তার সীমিত সংগতি দিয়ে তাদের নিয়ে আনা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে।

পুরস্কৃতদেরসহ অতিথিদের মঞ্চে আহ্বান করা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী সাহিত্যানুরাগী তরুণীদের নিযুক্ত করা হয়েছে তাদের মঞ্চে উঠে আসতে সাহায্য করার জন্য। উপস্থাপক কুহেলিকার নামের সঙ্গে একপ্রস্থ বিশেষণ যোগ করে মঞ্চে আসার অনুরোধ করল। এক লাবণ্যময়ী লবঙ্গলতিকা কুহেলিকাকে পাশে নিয়ে মঞ্চে দিয়ে গেল। কুহেলিকা আসনে বসে কৌতুকভরে দর্শকসারিতে বসা গতকালের ট্রেনের তরুণ সাহিত্যিকদের লক্ষ করতে লাগল। কারও মুখ হাঁ, কেউ বাকরুদ্ধ, অবলীলায় কোনো একজনের মাথায় হাত উঠল, কেউ কেউ একে অন্যকে মৃদু খোঁচা দিয়ে অস্ফুটে হতাশ বেদনায় বিড়বিড় করল। কুহেলিকা হাসিমুখে দর্শকদের দিকে হাত নাড়ল। হাততালি পড়ল। কিন্তু ওই তরুণদের কজনের হাত অসাড় হয়ে কোলের ’পরে পড়ে রইল—কুহেলিকার চোখ এড়াল না।

কিন্তু বিদগ্ধ তরুণদের সে স্বপ্নভঙ্গের রেশ কাটতেও সময় নিল না। লবঙ্গলতিকা তাদের সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। অতিথিদের দীর্ঘ বক্তব্যে মনোযোগের বদলে তাদের চোখ লবঙ্গলতিকার সুললিত দেহভঙ্গিমায় ঘুরপাক খেতে লাগল। দু-একজন আঙুলে বারবার মাথা আঁচড়ে তার সঙ্গে আলাপের ছুতো খুঁজছিল। উপস্থাপক ঘোষণা করল—

‘সম্মানিত সুধী, অকৃত্রিম আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কবি আলোক দত্ত আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বলা বাহুল্য তার শেকড়ও এ অঞ্চলের মাটিতেই প্রোথিত। বয়স ও অসুস্থতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটু দেরিতে হলেও তিনি এসে পৌঁছেছেন। আমরা বিকেলে তার কথা শুনব, তার কবিতা উপভোগ করব। আমি তরুণ কবি অন্যতমাকে অনুরোধ করছি কবি আলোক দত্তকে মঞ্চে নিয়ে আসার জন্য।’

লবঙ্গলতিকা ওরফে অন্যতমা কবির হাত ধরে মঞ্চে তুলে কুহেলিকার পাশের আসনে বসিয়ে দিয়ে গেল। ট্রেনের সাহিত্যিকদের মুগ্ধতা ও ঈর্ষার আবেশ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। কুহেলিকা কাঁপছিল। তার পাশের আসনে তার প্রিয় কবি। কবিকে এখানে এভাবে পাবে কোনো দিন ভাবেনি। মনে মনে ধন্যবাদ জানাল সাজিদকে। আলোক দত্ত তার দিকে সুগভীর বিস্ময়ে চেয়ে দেখল। কুহেলিকা আরক্তিম হলো।

পুরস্কারপ্রাপ্তিতে উপস্থাপক অনুভূতি ব্যক্ত করার কথা বললে কুহেলিকা যা বলবে ভেবে এসেছিল, তা তেমনভাবে বলতে পারল না। যা প্রথমে বলার কথা তা বলল মাঝখানে, শেষের কথা প্রথমেই বলে দিল। কেমন সামঞ্জস্যহীন একটা বক্তব্য দিয়ে কী কারণে চোখে জল নিয়ে ধরাগলায় শেষ করল। ওর মনে হলো এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে আর ও আসবে না। কিন্তু দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি যেন শেষ হচ্ছিল না।

এ পর্ব শেষ হলে সবাই দুপুরের খাবারের জন্য চলে গেল। অতিথি আর পুরস্কারপ্রাপ্তদের জন্য খাবারের বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও সাজিদ দেখল কুহেলিকা আর আলোক দত্ত হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণচূড়ায় ছাওয়া তাদের শানবাঁধানো বাবুর পুকুরের দিকে এগোচ্ছিল। সাজিদ ডাকতে গিয়েও ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি নিয়ে ফিরে গেল। কুহেলিকা প্রিয় কবির হাত ধরে সাবধানে বাবুর পুকুরের পইঠাতে গিয়ে বসল। তখন পুকুরের জল শান্ত। পাড়ে লাল মখমলের মতো কৃষ্ণচূড়ার গালিচা। কুহেলিকার নরম কোলের মধ্যে রাখা হাতের ওপর হাত রেখে আলোক দত্ত শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খুব ছোটবেলায় মেলার নাগরদোলায় চড়ে ওপর থেকে নিচে নামার সময় পেট আর বুকের মধ্যে যে অদ্ভুত ভয়মিশ্রিত ভালো লাগা অনুভূতি হতো কুহেলির, তখন তা-ই হচ্ছিল। এত কাছ থেকে আলোক দত্তকে সে কোনো দিন দেখেনি। অথচ নিজের বুকের চেয়ে কাছের আর কোনো ঘর ছিল না ওর। সে ঘরে তো প্রতিনিয়ত আলো আসত, আলো সরে যেত।

‘যুদ্ধ শেষে আমার ভাই ফিরে এল। আরও কতজন ফিরে এল। কেবল স্টেশনমাস্টারের মেজ ছেলেকেই দেশ টানল, না’?—কুহেলি পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলে চোখ রেখে বাতাসে ভাসিয়ে দিল প্রশ্নটা।

‘ফিরে এলে কি তোমাকে পেতাম কুহেলি? তার চে...’।

তারপর এত পানকৌড়ি! এত পানকৌড়ি! পুকুরের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে যেখানে-সেখানে পানকৌড়ির হানা। পানকৌড়িরা এত মুক্ত! এত স্বাধীন!