অমৃতের সন্তান গিরিশ কারনাড

গিরিশ কারনাড (১৯ মে ১৯৩৮—১০ জুন ২০১৯)
গিরিশ কারনাড (১৯ মে ১৯৩৮—১০ জুন ২০১৯)

এই বছরে আমরা আমাদের দেশের শিল্প ও সাহিত্য পরিমণ্ডলে বেশ কয়েকজন গুণী মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি। সম্প্রতি হারালাম ভারতের প্রতিভাবান অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, সর্বোপরি লেখক ও অসাধারণ নাট্যকার গিরিশ কারনাডকে। ভারতীয় হয়েও তিনি সমগ্র বিশ্বের সম্পদ এবং অনেক বেশি করে আমাদের। ৮১ বছর বয়সে অতিসম্প্রতি অনন্তের যাত্রী হয়েছেন গিরিশ কারনাড। এই গুণী মানুষের চিরবিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডল অনেকখানি দরিদ্র হয়ে পড়ল। নাট্যকার হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন গত শতকের ছয়ের দশকে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাদল সরকার, মারাঠী বিজয় টেন্ডুলকার, হিন্দি মোহন রাকেশ ও মহেশ আলকাঞ্চুয়ারের সমসাময়িক ছিলেন। তাঁর সময় ছিল ভারতীয় নাটকের সুবর্ণ যুগ। গিরিশ কারনাড তাঁর নাটকসমূহ কন্নড় ভাষায় লিখেছিলেন, পরে যা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মঞ্চনাটক তাঁর নাটকের মঞ্চায়নে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। তারিক আনাম খানের নির্দেশনায় তুঘলঘ ও তৌকীর আহমেদের নির্দেশনায় হায়বদন নাটক দুটি ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চে অভিনীত হয়ে দর্শকের প্রশংসা অর্জন করে। এই দুটি প্রযোজনা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এবং আমাকে আনন্দিত ও প্রীত করেছিল। তাঁর লেখা নাগমণ্ডল নাটক ১৯৭৮ সালে দিল্লির পুরোনো কেল্লায় অভিনীত হয়ে বিপুলভাবে দর্শকনন্দিত হয়। নাটকটির নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন ভারতের বিখ্যাত ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার নন্দিত অধ্যক্ষ ইব্রাহিম আল কাজী। আমাদের দেশের নাটকের মানুষ সৈয়দ জামিল আহমেদ, তারিক নাম খান, খ ম হারুন, সৈয়দ মহিদুল ইসলাম ও এস এম মহসিন—এঁরা ইব্রাহিম আল কাজীর ছাত্র ছিলেন। এর আগে ১৯৬৪ সালে ইব্রাহিম আল কাজী গিরিশ কার্নাডের বিখ্যাত নাটক তুঘলক–এর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই নাটকটিও দিল্লির লাল কেল্লায় অভিনীত হয়েছিল। দুটো নাটকই প্রযোজনা করে দিল্লির ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’–এর রেপার্টরি কোম্পানি। মনোহর সিংহের মতো তুখোড় অভিনেতা এই নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন।

গিরিশ কারনাডের জীবন ছিল সাফল্যের বিজয়গাথায় পরিপূর্ণ। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম ও চলচ্চিত্র নির্দেশনার জন্য ভারতের একাধিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে লাভ করেন ভারতের সংগীত-নাটক একাডেমি পুরস্কার। গিরিশ কারনাড ১৯৭২ সালে কন্নড় সাহিত্য পরিষদ, ১৯৭৪ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৯২ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন। জ্ঞানপীঠ ও কালিদাস সম্মান লাভ করেন ১৯৯৮ সালে। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁর সৃজনশীল কাজের জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করে। চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এর মধ্যে বহুবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, কর্ণাটক স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্র পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে তিনি লাভ করেছিলেন এসব পুরস্কার। আর সেরা পার্শ্ব–অভিনেতার পুরস্কারও একাধিকবার লাভ করেছিলেন তিনি।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রশিল্পে অনন্য অবদানের জন্য ভারতের বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন গিরিশ কারনাড। ভারতের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। এ ছাড়া শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পাদপীঠ সংগীত-নাটক একাডেমিরও সভাপতি ছিলেন।

এই গিরিশ কারনার সঙ্গে আমার অম্লমধুর স্মৃতিচারণা করে আমি আমার এ সামান্য লেখনীর ইতি টানব। তিনি এক বছরের জন্য ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদে বৃত ছিলেন এবং এরপরে আসীন ছিলেন সংগীত-নাটক একাডেমির সভাপতি পদে। আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৫-১৬ বছর আগে। আমি বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের দিল্লিতে ওই ইনস্টিটিউটের অধিবেশনে যোগদান করেছিলাম। সেই অধিবেশনে কলকাতার নাটকের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাট্য বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। স্বনামধন্য গায়ক ভূপেন হাজারিকা তখন সংগীত-নাটক একাডেমির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত। সাবেক সভাপতি গিরিশ কারনাড মূল বক্তব্য দিতে উঠলেন। সুদর্শন, আত্মবিশ্বাসী শ্যামবর্ণ এবং ভরাট কণ্ঠের মানুষটাকে আজও আমার মনে আছে। তিনি যখন বক্তব্যে বললেন যে ভারতীয় নাটক পরিপক্বতা লাভ করল পাঁচ ও ছয়ের দশকে বাদল সরকার, বিজয় টেন্ডুলকার, মহেশ আলকাঞ্চুয়ার প্রমুখের আগমনে। নিজের নামটা তিনি ভদ্রতাবশত বলেননি। আমি তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিলাম এই বলে যে সমগ্র ভারতকে শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হবে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর–এর মতো একটি নাটক রচনা করতে। কিন্তু না, ওই দিন আমরা দুজন একমত হতে পারিনি। কফি বিরতির সময় তিনি আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে একমত নই।’ আমি বললাম, ‘আমি ক্ষুদ্র মানুষ হয়েও আপনার সঙ্গে একমত নই।’ তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে বুক মেলালেন এবং হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার মনটা ভরে গেল। আদতে ঝগড়া–বাগ্​বিতণ্ডা এমনই হওয়া উচিত। তিনি অনেক বড় মানুষ ছিলেন। আমি সে তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র; তবুও তিনি আমাকে অবজ্ঞা করেননি। আমার বুকটা বড় হয়ে গেল, নিজেকে ছোট ভাবতে পারছিলাম না। সে স্মৃতি আজও অক্ষয় হয়ে আছে আমার হৃদয়ে। তাঁকে হারিয়ে এই উপমহাদেশ এবং সমগ্র বিশ্বে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছি। তাঁর সৃজন যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে, এই আমার বিশ্বাস। জয়তু গিরিশ কারনাড।