হিটলার কত রান করেছিলেন?

১৯২৩ সালে মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় অন্য দুজন সৈনিকের সঙ্গে হিটলার (ডানে)। এই সময়েই ক্রিকেট খেলেছিলেন তিনি। ছবি: দ্য টেলিগ্রাফ, ১৯ মার্চ ২০১০
১৯২৩ সালে মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় অন্য দুজন সৈনিকের সঙ্গে হিটলার (ডানে)। এই সময়েই ক্রিকেট খেলেছিলেন তিনি। ছবি: দ্য টেলিগ্রাফ, ১৯ মার্চ ২০১০
>কিংবদন্তি যা-ই বলুক, ক্রিকেট খেলেছিলেন জার্মান নেতা হিটলারও

দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এটি কোনো কিংবদন্তি নয়, নির্জলা সত্য ঘটনা—অ্যাডলফ হিটলারও একদিন ক্রিকেট খেলেছিলেন! আমাদের জীবনে এ পর্যন্ত শোনা সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটীয় কিংবদন্তি হলো ‘ফুয়েরার’ বা নেতা হিটলারের নির্দেশে জার্মান দেশে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়েছে। জার্মানিতে ক্রিকেট বন্ধের গল্পটা এমন: পাঁচ দিন খেলার পর একটি টেস্ট ম্যাচ যখন ড্র হয়ে গেল, তখন হিটলার চরম বিরক্ত হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হাই তুললেন। পাঁচ দিন ধরে বাইশজন মানুষ মাঠে দৌড়াদৌড়ি করার পরেও একটি ম্যাচ যে ড্র হতে পারে, এটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এ ঘটনায় তিনি এতটাই বিরক্ত হলেন যে কর্মকর্তাদের ডেকে সাফ সাফ বলে দিলেন, জার্মানির মতো আর্য দেশে ক্রিকেটের মতো অনার্য ও ‘অজার্মান’ খেলা যেন আর না হয়। সেই থেকে জার্মানিতে আর ক্রিকেট খেলা হয় না।

কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ইংলিশ লেখক জন সিম্পশনের আনরিলায়েবল সোর্স: হাউ দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ওয়াজ রিপোর্টেড (২০১০) এবং ড্যান ওয়াডেলের লেখা ফিল্ড অব স্যাডোজ: দ্য রিমার্কেবল ট্রু স্টোরি অব দ্য ইংলিশ ক্রিকেট ট্যুর অব নাজি জার্মানি ১৯৩৭ (২০১৪) নামের বই দুটি মোটামুটি একই রকম তথ্য জানাচ্ছে আমাদের। সিম্পশনের বইটি মূলত বিশ শতকের সাংবাদিকতার ওপর লেখা। এখানে তিনি ১৯৩০ সালে ডেইলি মিরর–এ প্রকাশিত তৎকালীন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য অলিভার লকার ল্যাম্পসনের একটি লেখাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, হিটলার ক্রিকেট খেলেছিলেন খোদ ব্রিটিশ ভদ্রলোকদের সঙ্গেই।

১৯২৩–এর মিউনিখ অভ্যুত্থানের অল্প কিছুদিন পর হিটলার জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বন্দী হয়ে থাকা কিছু ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দীর দেখা পান। ওই একই সময় জার্মান সৈন্যবাহিনীর তখনকার ল্যান্স করপোরাল হিটলার কাছের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। অলিভার লকার ল্যাম্পসনের সূত্র ধরে সিম্পশন জানাচ্ছেন, একদিন হিটলার গেলেন ওই ইংরেজ যুদ্ধবন্দীদের কাছে। তখন তাঁরা ক্রিকেট খেলছিলেন। খেলাটি ভালোভাবে বোঝার জন্য তাঁদের কাছে একটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে চাইলেন হিটলার। ধারণা করা হয়, যুদ্ধবন্দীরা তাঁকে একটি ক্রিকেট ম্যাচ দেখিয়েছিলেন এবং লিখে দিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলার নিয়মকানুনও। এর কিছুদিন পরে হিটলার নিজের একটি ক্রিকেট দল নিয়ে আবার সেখানে গেলেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে খেললেন একটি প্রীতি ম্যাচ। আনরিলায়েবল সোর্স: হাউ দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ওয়াজ রিপোর্টেড–এ জন সিম্পশন বলছেন, খেলতে গিয়েই হিটলার বুঝতে পারলেন, ক্রিকেট ঠিক ‘পুরুষোচিত’ খেলা নয়, জার্মানদের মতো আর্যদের খেলা তো নয়ই। এ কারণে এই খেলার নিয়মকানুন নিজের মতো করে লেখার চিন্তা করলেন তিনি। এ ছাড়া তিনি শান্তিকালীন সময়ের জন্য এবং অফ ডিউটিতে সৈন্যদের প্রশিক্ষণের একটি মাধ্যম হিসেবে ক্রিকেট নিয়ে ‘গবেষণা’ও করতে চেয়েছিলেন।

কথাগুলো পড়ে তেত্রিশ হাজার ভোল্টের শক পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যে লোক শিশুদের ভালোবাসতে পারেন, ক্যানভাসে মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকতে পারেন ছবি, তিনি কেন ক্রিকেট খেলতে পারবেন না? যে মানুষ পুরো পৃথিবীকে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলার ইচ্ছা পোষণ করেন, তিনি কেন নিজের মতো করে একটি খেলার জন্য আইন তৈরি করতে পারবেন না! মনে রাখতে হবে, মানুষ অমিত সম্ভাবনাময় প্রাণী, হিটলারও কি তার বাইরের?

কিন্তু কী ছিল সেই আইন, যা নিজেই লিখতে চেয়েছিলেন হিটলার? এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, ক্রিকেটে হিটলারি সেই আইন বলবৎ হলে আজ মাশরাফির জন্মই হতো না, রেকর্ড বুকে স্যার ব্র্যাডম্যান-শচীন-লারার নাম উঠত না, র‌্যাঙ্কিং লিস্টটার জন্মই হতো না বলে তাতে আমাদের সাকিবের নাম থাকার প্রশ্নও থাকত না, আর এমন তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে, দৌড়ে, শুয়ে ফিল্ডিং করতেন যে জন্টি রোডস, তিনি হয়তো আইস হকির দলপতি হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকতে চাইতেন।

হিটলার ভাবতেন, বিনোদনপ্রিয় ব্রিটিশদের জন্য ক্রিকেটর ‘বেসিক’ নিয়মকানুনসহ খেলাটি নিঃসন্দেহে খুব ভালো। কিন্তু ‘সিরিয়াস মাইন্ডেড’ জার্মানদের জন্য সেসব নিয়ম মোটেই জুতসই নয়। নাজি বাহিনীর জন্য তো নয়ই। তিনি অপুরুষোচিত, অজার্মান, অনার্য ভেবে ‘প্যাড’ নামের ক্রিকেটের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গটির ব্যবহার বন্ধ করতে চেয়েছিলেন! সাড়ে পাঁচ থেকে পৌনে ছয় আউন্স ওজনের এবং ২২.৩৮ সেমি-২২.৮৬ সেমি পরিধির পুরুষদের জন্য ব্যবহৃত ক্রিকেট বলটিকেও তিনি অজার্মানসুলভ ভাবতেন। তাই আরেকটু বড় আর আরেকটু শক্ত বল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন! আর এমন হলে, খেলা শেষে ব্যাটসম্যানদের পায়ের কয়টি হাড় যে অবশিষ্ট থাকত, কে জানে! শুধু কি তা–ই, অত বড় ও ভারী বলের ভার বোলাররাইবা বইতেন কীভাবে।

এই নাজিপ্রধান ক্রিকেটের জন্য একটি মোটো তৈরি করেছিলেন, জার্মান উচ্চারণে সেটি হলো, ‘ওনে হাস্ট, ওনে রাস্ট’, বাংলায় যার ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘তাড়াহুড়ো নেই কিন্তু অবিরাম’। এ কথাটাকে একেবারে গোদা বাংলায় বলা যায়, ‘আরামসে খেলতেই থাকো, খেলতেই থাকো’। এই বল আর এই মোটো নিয়ে, আপনার দৃষ্টিতে ক্রিকেট খেলার জন্য উপযুক্ত ব্যাটসম্যান কে? ‘দ্য ওয়াল’খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়?

যাহোক, হিটলার কত রান করেছিলেন, ফিরে আসি সেই প্রসঙ্গে। ১৯২৩ সালে হিটলার যে একটা ম্যাচ খেলেছিলেন, তাতে তিনি কত রান করেছিলেন বা কয়টা বলের মুখোমুখি হয়েছিলেন, এ বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে কবি নীরব। কারণ, দুজন লেখকই জানাচ্ছেন, সেই ম্যাচের স্কোর কার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ধারণা করা হয়, তিনি একটি মাত্র বলই খেলতে পেরেছিলেন! ছয়, চার, এক বা ‘গোল্ডন ডাক’—সব ধরনের রান করার সম্ভাবনাই তো এতে থাকে। মনে রাখা দরকার, মানুষ অমিত সম্ভাবনাময় প্রাণী, আর হিটলারও তার বাইরে নন!

তথ্যসূত্র: দ্য অস্ট্রেলিয়ান ও দ্য টাইমস অব ইসরায়েল
কৃতজ্ঞতা: দেবদ্যুতি রায়