বই লেখকের দুর্ভাগ্যগুলো

পাঠকের দৃষ্টিতে লেখক যেমন, এর বাইরেও নানা বাস্তবতা থাকে লেখকের, থাকে বিচিত্র দুর্বিপাক। আবার বস্তুগত দিক দিয়ে তাঁর প্রাপ্তির পরিমাণও প্রায় নেই বললেই চলে। তারপরও কেন লেখেন একজন লেখক? ১৯৬৬ সালে ‘মিস অ্যাডভেঞ্চারস অব আ রাইটার অব বুকস’ শিরোনামের এক লেখায় প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন মার্কেস। তাঁর সাংবাদিক–জীবনের বিভিন্ন লেখা নিয়ে সদ্য প্রকাশিত দ্য স্ক্যান্ডাল অব দ্য সেঞ্চুরি অ্যান্ড আদার রাইটিংস বইয়ে সংকলিত হয়েছে এ লেখাটি। অনুবাদ করেছেন নুসরৎ নওরিন
জাঁ পল সার্ত্রে
জাঁ পল সার্ত্রে

বই লেখা একটা আত্মঘাতী কাজ। তাৎক্ষণিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিচারে আর কোনো কাজই এত সময়, শ্রম আর নিষ্ঠার দাবি করে না। ওই ২০০ পৃষ্ঠা কতগুলো ঘণ্টার মানসিক যন্ত্রণা এবং গার্হস্থ্য দুর্দশার বিনিময়ে তাঁদের লেখক লিখেছেন, আর সে জন্য তিনি কতটুকুই-বা পেয়েছেন—এসব ভেবে বিস্মিত হওয়ার মতো অনেক পাঠক রয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। যাঁরা জানেন না, তাঁদের অবগতির জন্য সংক্ষেপে বলা যায়, ক্রেতা যে মূল্যে দোকান থেকে বইটি কেনেন, লেখক তার মাত্র ১০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। সুতরাং যে পাঠক ২০ পেসোতে (কলম্বিয়ার মুদ্রা) একটি বই কিনেছেন, লেখকের জীবিকায় তাঁর অবদান সাকল্যে ২ পেসো। ঝুঁকি নিয়ে যে প্রকাশক বইটি বের করেছেন, বাকি অংশটুকু তাঁর এবং বিক্রেতা-পরিবেশকদের। ব্যাপারটাকে আরও অন্যায় লাগে যখন আপনি ভাবেন যে শ্রেষ্ঠ লেখক তাঁরাই, যাঁদের লেখালেখিতে ঝোঁক অল্প কিন্তু ধূমপানে ঝোঁক বেশি, আর তাই এটা স্বাভাবিক যে ২০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখতে তাঁদের কমপক্ষে দুই বছর আর ২৯ হাজার সিগারেট খরচ হয়েছে। সোজা অঙ্কের হিসাবে বইটা থেকে যতটা তাঁদের আয় হবে, তাঁর চেয়েও বেশি তাঁরা ধূমপানেই ব্যয় করে ফেলেন।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আমার এক লেখক বন্ধু বলেছিল, ‘ওই প্রকাশক, পরিবেশক, বই বিক্রেতারা সবাই বড়লোক আর আমরা সব লেখকই গরিব।’

আলবেয়ার কামু
আলবেয়ার কামু

অনুন্নত দেশগুলোতে সমস্যাটা ঘোরতর, যেখানে বই ব্যবসাটা অত জোরদার নয়, কিন্তু ব্যবসাটা তাদের একচেটিয়াও নয়। সফল লেখকদের জন্য স্বর্গভূমি যুক্তরাষ্ট্রেও সুলভ সংস্করণের দৌলতে রাতারাতি ধনী বনে যাওয়া প্রতিটি লেখকের বিপরীতে কয়েক শ মানসম্পন্ন লেখক রয়েছেন, যাঁরা ওই ফোঁটা ফোঁটা বরফচোয়ানো ১০ শতাংশের আমৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যায়সংগত বৈভব বৃদ্ধির সাম্প্রতিক দর্শনীয় ঘটনাটি ঘটেছে ট্রুমান কাপোটির ইন কোল্ড ব্লাড উপন্যাসের ক্ষেত্রে। প্রকাশের প্রথম কয়েক সপ্তাহেই এটি গ্রন্থাকারের জন্য ৫ লাখ ডলার আয় নিয়ে এসেছে, একই পরিমান এসেছে এর চলচ্চিত্র স্বত্ব থেকেও। বিপরীত দিকে, আলবেয়ার কামু, যিনি তখনো বইয়ের তাকে রয়ে যাবেন, যখন অবিশ্বাস্য ট্রুমান কাপোটিকে কেউ মনেও রাখবে না, তাঁকে বই লেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছদ্মনামে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। নোবেল পুরস্কার—যেটি তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুর খুব বেশি একটা আগে নয়—তাঁকে পারিবারিক দুঃখ-দুর্দশা থেকে খুব সামান্যই ক্ষণিকের স্বস্তি দিতে পেরেছিল। এটা সঙ্গে করে এনেছিল হাজার চল্লিশেক ডলার, যা দিয়ে সেই সময় একটা বাড়ি কেনা যেত, যে ধরনের বাড়ির পেছনে বাচ্চাদের জন্য খেলার উঠোন থাকে। এর চেয়ে ভালো ছিল, যদিও অনিচ্ছাকৃত, পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে জাঁ পল সার্ত্রের ব্যবসাটাকে বাড়িয়ে নেওয়া, কারণ তাঁর এই মনোভাব স্বাধীনতার জন্য তাঁকে একটি ন্যায়সংগত ও প্রাপ্য খ্যাতি এনে দেয়—এটা তাঁর বইয়ের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

অনেক লেখক পুরোনো ধাঁচের একজন পৃষ্ঠপোষকের আশায় আকুল হয়ে যান। এমন পৃষ্ঠপোষক যিনি একজন ধনী, উদার ভদ্রলোক ও শিল্পীদের সহায়তা করবেন, যাতে তাঁরা স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে পারেন। শিল্পের জন্য পৃষ্ঠপোষক আজও রয়েছে, যদিও তা অন্য রূপে। বড় আকারের ব্যবসা সমিতিগুলো, যেগুলো কখনো কখনো রাজস্ব কমানোর জন্য, অথবা তাদের সম্পর্কে জনমানসে যে রাক্ষুসে রূপটি থাকে, তা বদলাতে এবং কালেভদ্রে নিজেদের অপরাধী বিবেককে স্বস্তি দিতে, শিল্পীদের কাজকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু আমরা লেখকেরা আমাদের মন যেমনটা চায়, তা-ই করতে পছন্দ করি এবং আমরা সন্দেহ করি, সম্ভবত ভিত্তিহীনভাবেই, পৃষ্ঠপোষকতা চিন্তা ও প্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় মেনে নিতে হয়। আমার নিজের ক্ষেত্রে, আমি কোনোরকম ভর্তুকি ছাড়াই লিখতে পছন্দ করি—তা শুধু এ কারণে নয় যে আমি অদ্ভুত একটি নিপীড়ন-জটিলতায় ভুগি, এবং এই কারণেও যে, লেখার শুরুতে আমার কোনো ধারণাই থাকে না এটা শেষ হলে আমি কার সঙ্গে চুক্তিতে যাব। লেখা শেষে যদি আমি পৃষ্ঠপোষকের মতাদর্শের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, তবে সেটা অন্যায় হবে—বেশির ভাগ লেখকের ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী অসংগতিপূর্ণ মেজাজের কারণে যেটা হওয়া খুবই সম্ভব। একইভাবে এটি হতো সম্পূর্ণ অনৈতিকও, যদি আমি ভাগ্যক্রমে চুক্তিবদ্ধ হতাম।

ইন কোল্ড ব্লাড ছবির দৃশ্য
ইন কোল্ড ব্লাড ছবির দৃশ্য

পৃষ্ঠপোষক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদের পিতৃত্বসুলভ সাধারণ বৃত্তি, লেখককে রাষ্ট্রের বেতনভোগী কর্মচারী বলে বিবেচনা করার সমাজতান্ত্রিক প্রস্তাবের একটি প্রতিরূপ মনে হয়। নীতিগতভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাধানটি সঠিক, কারণ লেখককে এটি মধ্যবর্তীদের শোষণ থেকে মুক্ত করে। কিন্তু এযাবৎ বাস্তবে এবং কে জানে কত দিন ধরে, এই ব্যবস্থার যেসব অন্যায়কে শোধরানোর কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর অন্যায়ের জন্ম সে দিয়েছে। সম্প্রতি সোভিয়েতের দুজন দুর্ভাগা লেখক সাইবেরিয়ায় সশ্রম দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, লেখা খারাপ হওয়ার জন্য নয় বরং পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে দ্বিমত করার জন্য। আমরা লেখকেরা যে একদল দুর্বৃত্ত, যারা জুতোর বাড়ির চেয়েও অন্ধবিশ্বাসী তাত্ত্বিকের স্ট্রেটজ্যাকেট (ভয়ানক অপরাধী কিংবা মানসিক রোগীকে অন্যকে আঘাত করা থেকে বিরত রাখার জন্য বিশেষ পোশাক) এবং এমনকি আইনগত ব্যবস্থাসমূহে, বেশি আঘাত পাই—যে শাসনব্যবস্থা এটা স্বীকার করার মতো যথেষ্ট পরিপক্বতা দেখাতে ব্যর্থ হয়, সেখানে লেখালেখি কতটা বিপজ্জনক এ ঘটনায় সেটা দেখিয়েছি।

আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখকের জন্য ভালো লেখা ছাড়া অন্য আর কোনো বিপ্লবী দায়িত্ব নেই। প্রথাবিরোধিতা, যেকোনো শাসনব্যবস্থায়, একটি অপরিহার্য শর্ত, যার ব্যত্যয় হওয়া চলে না। কারণ, একজন প্রথানুগত লেখক একজন ডাকাতের মতো এবং অতি অবশ্যই তিনি একজন বাজে লেখক।

এই বিমর্ষ পর্যালোচনার পর, আমরা লেখকেরা কেন লিখি, তা ভেবে বিস্মিত হওয়াটা স্বাভাবিক। জবাবটি, অনিবার্যভাবেই, যতখানি না অকপট তার চেয়ে বেশি অতিনাটকীয়। আপনি একজন লেখক—ঠিক যেভাবে আপনি হয়তো একজন ইহুদি অথবা কৃষ্ণাঙ্গ। সাফল্য অনুপ্রেরণাদায়ী, পাঠকের সমর্থন সঞ্জীবনী, কিন্তু এগুলো সম্পূরক পুরস্কার—কারণ একজন ভালো লেখক ছেঁড়া জুতো নিয়ে এবং বই বিক্রি না হলেও লিখেই যাবেন। এটা একটা পেশাগত বিপত্তি, যেটা সামাজিক সেই বাতুলতার ব্যাখ্যা দেয় যে, কেন অসংখ্য নারী ও পুরুষ না খেয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছে, এমন কিছুর জন্য, যেটা মোটের ওপর এবং সত্যি বলতে কোনো উদ্দেশ্যই সাধন করে না।

এল এসপেকতাদোর, বোগোতা, জুলাই ১৯৬৬