গল্পের সাইকেল আকাশে ওড়ে

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মাঠের মাঝখানে বড় একটা হিজলগাছ। লোকটি বসে আছেন সেই গাছতলায়। শূন্যে ডান হাত এমনভাবে নাড়ছেন, যেন শিল্পীর হাত। আঙুলে ধরা তুলি। পাশে রঙের পাত্র, সামনে ক্যানভাস। তিনি ছবি আঁকছেন। ডান হাতে রঙের পাত্র থেকে রং লাগাচ্ছেন তুলিতে। বাঁ হাত মাঝেমধ্যেই পাশে নামাচ্ছেন। ফাঁকা শূন্য হাতই আবার তুলছেন। ঠোঁটের কাছে নিচ্ছেন। যেন চায়ের মগ তুলছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে মগ আবার নামিয়ে রাখছেন। 

এ রকম দৃশ্য দেখলে কার না কৌতূহল হয়! আমারও হলো। পাগল নাকি! 

দ্রুত হেঁটে হিজলতলায় এলাম। না পোশাক–আশাক আর চেহারা দেখে পাগল মনে হচ্ছে না। খুবই সুন্দর চেহারা। সুপুরুষ যাকে বলে। বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। পরনে সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি। আপনমনে শূন্যে ছবি এঁকে চলেছেন। আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। 

পাগলই হবে। 

আমি গলা খাঁকারি দিলাম। তিনি চমকে আমার দিকে তাকালেন। স্নিগ্ধ মুখে হাসলেন। আরে আপনি! কখন এলেন? কেমন আছেন? 

আমি অবাক। আপনি আমাকে চেনেন নাকি? 

না। তবে আপনি যে মানুষ, তা বুঝতে পারছি। 

আমিও বুঝতে পারলাম, যা ভেবেছি তা–ই। পাগলই। এক ফাঁকে বললেন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন বসুন। চা খাবেন, চা? আছে। ফ্লাস্কভর্তি করা আছে। মগটা আমি ব্যবহার করছি। আপনি ওই ফ্লাস্কের মুখটায় ঢেলে নিন। সংকোচ করবেন না। আপনিও মানুষ আমিও মানুষ। নিন প্লিজ। খুব ভালো চা। ও বানিয়েছে। 

কোথায় চা? 

এই তো আপনার হাতের কাছেই ফ্লাস্ক। 

আমি হতভম্ব হয়ে দেখি সত্যি আমার হাতের কাছে, ঘাসের ওপর নতুন বড় একটা ফ্লাস্ক। কোত্থেকে এল কিছুই বুঝলাম না, কিছুই টের পেলাম না। 

ভদ্রলোক বাঁ হাত পাশে নামালেন। যেন মগটা রাখলেন। ডান হাত এমনভাবে ঘাসের ওপর নামালেন, যেন তুলিটা রাখলেন। তারপর নিজ হাতে ফ্লাস্ক খুললেন। চা ঢেলে আমাকে দিলেন। 

খান, খান। খুব কম মানুষেরই সৌভাগ্য হয় এমন চা খাওয়ার। আমার পর এই সৌভাগ্য শুধু আপনারই হচ্ছে। আপনার নামটা যেন কী? 

ফ্লাস্কের চা–ভর্তি মুখটা ধরে নিজের নাম বললাম। তিনি মুগ্ধ গলায় বললেন, নাইস টু মিট ইউ। তারপর নিজের নাম বললেন।...আমি একজন পেইন্টার। ছবি আঁকি। ছেলেবেলা থেকেই আঁকতাম। একসময় আঁকাআঁকি নেশা পেশা হয়ে যায়। খান চা খান। 

ঢালার পর থেকেই অপূর্ব গন্ধ পাচ্ছি চায়ের। চায়ের এ রকম মনোহর গন্ধ হতে পারে জানা ছিল না। 

প্রথমে মনে হয়েছিল কী ভৌতিক কাণ্ড রে বাবা! ভদ্রলোক চা খাচ্ছেন ঠিকই, চায়ের মগ–ফ্লাস্ক দেখা যাচ্ছে না। আমাকে খাওয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাস্ক হাজির। চায়ের গন্ধে এখন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? 

নিজের অজান্তেই চায়ে চুমুক দিলাম। দিয়ে মনে হলো, সত্যি এত স্বাদের চা জীবনে খাইনি। কেমন নেশা ধরানো অপূর্ব এক পানীয়। চা এ রকমও হতে পারে? 

কেমন চা? 

অসাধারণ, অপূর্ব। 

জীবনে খেয়েছেন এ রকম চা? 

না। 

পাবেন কোথায় যে খাবেন? এ তো আর মানুষের তৈরি চা না! 

তাহলে কার তৈরি? 

পরিদের তৈরি। পরিদের। 

কী বলছেন? 

হ্যাঁ। আমার স্ত্রী পরি। এই চা সে তৈরি করেছে। আমি নিজেও ভাই দেশে এখন আর থাকি না। সে থাকতে চায় না। আমাদের ছেলেপুলে নেই। একজন মানুষ আর একজন পরি একসঙ্গে থাকি। 

পাগল! বদ্ধ পাগল। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে খারাপ লাগছে না। অলৌকিক চা খেতে খেতে বললাম, তাহলে আপনি থাকেন কোথায়? 

পরিস্থানে থাকি ভাই। পরিস্থানে। মানে পরিদের দেশে। মাঝেমধ্যে ছবি আঁকতে দেশে আসি। এ রকম খোলা মাঠ বা গাছতলায় বসে ছবি আঁকি। 

কী ধরনের ছবি আঁকেন? ল্যান্ডস্কেপ...

না না ওসব না। আমি শুধু এক রকমের ছবি আঁকি। 

সেটা কী রকম? 

তিনি হাসলেন। হাসিটা যে কী সুন্দর! একেই বুঝি রমণীমোহন হাসি বলে। 

আমি ভাই শুধু পরিদের ছবি আঁকি। নানা রকম পরি। সব রঙের পরি আঁকি। শুধু কালো আঁকি না। পরিরা কালো হয় না। 

কিন্তু আমি তো আপনার আঁকা ছবি দেখতে পাচ্ছি না। ক্যানভাস–তুলি–রং, এমনকি চায়ের মগটাও দেখতে পাচ্ছি না। 

সেটা আপনি পাবেন না। আমার আঁকা ছবি আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ দেখতে পায় না। আমি প্রকৃত অর্থে তার জন্য আর আমার জন্যই ছবি আঁকি। আমার ছবি সে খুব পছন্দ করে। আমাকে বিয়ে করার সময় তার শর্তই ছিল আমি শুধু ছবি আঁকব তার জন্য। শুধু পরিদের ছবি আঁকব। যেদিন যে রকম পরির ছবিই আঁকি না কেন, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে আমি আসলে তার ছবিই এঁকেছি। 

আমি কথা বলি না। মৃদু হেসে চায়ে চুমুক দিই। 

আপনার মনে হচ্ছে আমি পাগল? 

না মানে...

সেটাই মনে হওয়ার কথা। কিন্তু ভাই আমি পাগল না। পাগল যে নই তার প্রমাণও আপনি পাবেন। তবে আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। অনেক দিন পর একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হলো তো! হাজার হলেও জাতভাই। তাদের দেখলে ভালো লাগে। 

আপনি যে বললেন প্রায়ই ছবি আঁকতে দেশে আসেন, তাহলে মানুষের সঙ্গে আপনার দেখা হয় না কেন? 

লোকালয়ে আমি আসি না। নির্জন–নিরিবিলি জায়গায় আসি। তা–ও দিনের বেলা বলতে গেলে আসিই না। জ্যোৎস্নারাতে কোনো বনের ধারে, মাঠ কিংবা নদীর ধারে আসি। এবার বহু বছর পর দিনের বেলা এলাম। 

আপনার বয়স কত? 

অনুমান করেন তো? 

যা অনুমান করেছিলাম, বললাম। চল্লিশের বেশি হবে না। 

তিনি হাসলেন। মানুষের অনুমান অবশ্য এ রকমই হবে। পরিস্থানে থাকি তো! বয়স বাড়ে না। আমার বয়স ভাই এক শ ষাট বছর। আমি রবীন্দ্র যুগের আর্টিস্ট। রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন শেষ বয়সে। আমার শুরু হয়েছিল ছেলেবেলায়। সেই অর্থে আমি রবীন্দ্রনাথের সিনিয়র আর্টিস্ট। 

আমার মুখে মৃদু হাসি। 

বিশ্বাস করছেন না তো? মানুষের এই একটাই দোষ ভাই। মনভর্তি অবিশ্বাস। আমি কেন শুধু পরিদের ছবি আঁকি সেই ঘটনাটা বলি। যখন ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম, তখন সব রকম ছবিই আঁকতাম। ফুল–পাখি–প্রজাপতি। নদী–নৌকা–ঘরবাড়ি। মানুষের মুখ। এক রাতে মনে হলো, একটা পরির ছবি আঁকি। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি পরিরা অপূর্ব সুন্দর হয়। কোনো কোনো জ্যোৎস্নারাতে পরিস্থান থেকে দল বেঁধে পৃথিবীতে উড়ে আসে। সবকিছুই মানুষের মতো, শুধু সৌন্দর্যটা তুলনাহীন। আর প্রজাপতির মতো দুখানা পাখনা আছে। তবে ইচ্ছা করলে পাখনা খুলে রাখতে পারে। পাখনা যে খুলে রাখতে পারে তার প্রমাণ আমি প্রথম রাতেই পেয়ে গেলাম। 

আমি কি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি? ছবি আঁকাটা শেষ করবেন না? 

আজ আর হবে না। আজ আপনার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগছে। ছবির বাকিটা পরিস্থানে গিয়ে শেষ করব। 

কবে ফিরে যাবেন? 

কবে মানে? আজই। কিছুক্ষণ পরই। আপনার সঙ্গে কথা শেষ করে যাব। বহুদিন জীবনের গল্প কাউকে বলা হয় না। আপনাকে বলতে ভালো লাগছে। শুনুন না তারপর কী হলো! 

জি জি বলুন। 

আমাদের বাড়ির পরই দিগন্তব্যাপী মাঠ। আমি একা থাকি মাঠের ধারের একটা ঘরে। রাত জেগেও ছবি আঁকি। এক রাতে একটা পরির ছবি আঁকলাম। পরি সাদা। শুধু পাখনা দুটো রঙিন। ভারি সুন্দর হলো ছবিটা। আহা, এ রকম একজন পরি যদি আমার বউ হতো। বাইরে শিউলি ফুলের মতো জ্যোৎস্না। সুন্দর হাওয়া বইছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মাঠের দিকে গিয়ে একটু ঘুরলাম। ঘরে ফিরে দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। দেখি ছবিটা ক্যানভাসে আছে শুধু রঙিন পাখা দুটো ছবি থেকে খুলে টেবিলের ওপর রাখা...

আমি আবার হাসলাম। তিনি আমার হাসিটা খেয়াল করলেন। পাগলের প্রলাপ ভাবছেন তো? সেটাই ভাবার কথা। হাতে আঁকা ছবি থেকে পরির পাখা খুলে টেবিলে রাখা হবে, এটা কোনো মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমিও মেনে নিতে পারছিলাম না। আরে, ঘটনা কী? এ কী করে সম্ভব? আর ভারি সুন্দর একটা গন্ধ আমার ঘরে। তারপর দেখি ভাই, ছবিটা জ্যান্ত হয়ে গেল...ক্যানভাস থেকে পরিটা বেরিয়ে এল। ছবিতে তো এইটুকু সাইজ। ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে এল প্রমাণ সাইজের মানুষ। গা থেকে অপূর্ব গন্ধ আসছে। আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে সে। আমিও তাকিয়ে আছি। বাক্যরহিত। কথা বলতে পারছি না। পরি এসেছে আমার ঘরে? আমার কল্পনার পরি বাস্তবে! সে আমার মনের কথা শুনতে পাচ্ছিল। বাঁশির মতো মিষ্টি গলায় বলল, হ্যাঁ, কল্পনার পরি বাস্তবে। তোমার আঁকা ছবি আমার ভালো লেগেছে। এ জন্যই পরিস্থান থেকে চলে এলাম। তবে তোমার ছবিতে একটা গন্ডগোল আছে। সাদা পরির পাখা কখনো ও রকম রঙিন হয়? এ জন্য পাখা দুটো আমি খুলে রেখেছি। তুমি এখন থেকে শুধু পরির ছবি আঁকবে। যেকোনো পরি আঁকলেই দেখবে সেই পরি আমি। রোজ আমি তোমার ছবি দেখতে আসব। তারপর থেকে আমি রাত জেগে শুধু পরির ছবি আঁকি আর ক্যানভাস থেকে রোজ বেরিয়ে আসে সে। ধীরে ধীরে তার সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়ে গেল। বিয়ে করে সে আমাকে পরিস্থানে নিয়ে গেল। ওখানে কারও বয়স বাড়ে না। মাঝেমধ্যে সে আমাকে দেশে নিয়ে আসে ছবি আঁকার জন্য। তারপর আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার একটা সাইকেল আছে। হাওয়ার ওপর দিয়ে চালিয়ে আসে। আমাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে নিয়ে যায়। দাঁড়ান, তাকে ফোন করি। সে এসে আমাকে নিয়ে যাক। 

পাঞ্জাবির পকেট থেকে অদ্ভুত একটা মোবাইল ফোন বের করলেন তিনি। ফোনটা মানুষের বুড়ো আঙুলের মতো। দুপাশে দুটো ছিদ্র। ওই জিনিস কানে লাগিয়ে তিনি কী ভাষায় কথা বললেন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে বিস্মিত হয়ে দেখি, মাঠের শূন্যতা দিয়ে একটা সাইকেল উড়ে আসছে। মাটির অনেক ওপর দিয়ে আসছে। যেন কেউ চালিয়ে আসছে। তবে চালককে দেখা যাচ্ছে না। 

সাইকেল এসে আমাদের সামনে থামল। ভারি একটা সুগন্ধে ভরে গেল চারদিক। ভদ্রলোক রংতুলি ইত্যাদি গুছিয়ে ব্যাগে ভরলেন। ব্যাগ বা রংতুলি কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি না। ভদ্রলোকের অঙ্গভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছিলাম। তারপর তিনি অদৃশ্য ক্যানভাস থেকে অদৃশ্য ছবি খুলে হাতে নিলেন। বললেন, চলি ভাই। আপনার সঙ্গে গল্প করে খুব মজা পেলাম। 

সাইকেলটা বাস্তব। ভদ্রলোকও বাস্তব। বাকি সবকিছুই অবাস্তব। চোখে দেখা যাচ্ছে না। তিনি সাইকেলের রডে চেপে বসলেন। তারপর নিরাকার চালককে বললেন, ভদ্রলোককে একটু চেহারাটা দেখাও। নয়তো সে বিশ্বাস করবে না যে আমার স্ত্রী পরি সাইকেল চালিয়ে আমাকে এখন পরিস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। 

চলতে গিয়েও মুহূর্তের জন্য থামল সাইকেল। চালকের আসনে ফুটে উঠল এক অসামান্য নারীমূর্তি। তার রূপে রোদ ম্লান হয়ে গেল। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম তার পিঠে হালকা মোলায়েম গোলাপি রঙের পাখা। মাঠের শূন্যতায় সাইকেল চালিয়ে দিয়ে এক পলকের জন্য পেছন ফিরে তাকাল সে। মিষ্টি করে হাসল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। শূন্যে মিলিয়ে গেল সাইকেল। 

খানিক পর বাস্তবে ফিরে দেখি চায়ের ফ্লাস্কটা রয়ে গেছে।