হুমায়ূনের মৌলানারা

নবনী; নি; এই মেঘ, রৌদ্রছায়া; জোছনা ও জননীর গল্প—এই উপন্যাসগুলোতে হ‌ুমায়ূন আহমেদ চিত্রিত করেছেন মৌলানাদের বিচিত্র রূপ
নবনী; নি; এই মেঘ, রৌদ্রছায়া; জোছনা ও জননীর গল্প—এই উপন্যাসগুলোতে হ‌ুমায়ূন আহমেদ চিত্রিত করেছেন মৌলানাদের বিচিত্র রূপ

ছায়াবীথি নামে হ‌ুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস আছে। টিপিক্যাল হ‌ুমায়ূনীয় রচনা। নিম্নমধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের অন্তরঙ্গতায় মানবসম্পর্ক, বিশেষত পারিবারিক ও নর-নারী সম্পর্কের যে রূপ প্রণয়নের জন্য হ‌ুমায়ূনের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা, তার প্রতিনিধিস্থানীয় রচনা বলা যেতে পারে একে। গল্প বলার মুনশিয়ানা, খুব নিরীহ ভঙ্গিতে চরিত্র ও ঘটনা আমদানি করে ক্রমে গল্পজালে জড়িয়ে ফেলা আর তার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক ও মনস্তত্ত্বের মতো গুরুতর বিষয়ে লক্ষ্যভেদী পর্যালোচনা এ রচনার গুণ। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সবচেয়ে দরকারি চরিত্র হিসেবে লেখক নায়লাকে যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে নির্মাণ করেছেন। মিতব্যয়ী কাহিনিটিতে উপযুক্ত পরিসর বরাদ্দ করেছেন তার জন্য। আমরা অবশ্য এখানে উপন্যাসটির কথা তুললাম নায়লার একটি সংলাপ ধার করার জন্য। দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে জন্মদিনের পোশাক হিসেবে নায়লা ছেলেকে পরিয়েছে ‘পায়জামা, পাঞ্জাবি, নাগরা জুতা’। তার কাছে ছেলেকে এ পোশাকে খুবই সুন্দর লাগছে। কিন্তু নায়লা দুটি জিনিসের অভাব বোধ করছে। ঘরে ক্যামেরা নেই, থাকলে ছবি তুলে রাখা যেত। আর টুপিও কেনা হয়নি। কিনলে কী হতো? ‘টুপি পরিয়ে দিলেই একেবারে ষোল আনা মৌলানা’।

মায়েরা যখন দুই বছরি সন্তানের পোশাক নির্বাচন করেন, তখন নিশ্চয়ই চালু ফ্যাশনের দিকেই মূল নজরটা থাকে। সমাজে বা সংস্কৃতিতে প্রচলিত বিকল্প পোশাকও বিকল্প হিসেবে মানুষের পোশাক–ভান্ডারে মজুত থাকতে পারে। সেদিক থেকে ছেলের জন্য নায়লার পোশাক নির্বাচনে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু অন্তত দুই কারণে নায়লার উচ্চারণটিকে উল্লেখযোগ্যই মনে করি। এক. গত শতকের সত্তর-আশির দশকের ঢাকার মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের, যা হ‌ুমায়ূনের মূল বিচরণক্ষেত্র—ফ্যাশন-কল্পনায় এ ধরনের পোশাকের একটি বিকল্প থাকা খুবই সম্ভব, ঢাকার ফ্যাশন হাউসগুলোর সাংবাৎসরিক বিজ্ঞাপনে নজর রাখলেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়; কিন্তু বাংলাদেশের মূলধারার লেখাপত্রে তার স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। কথাটা এভাবে বলা যায়: পোশাকটার প্রচলন ছিল বা আছে, কিন্তু ওই পোশাকের যারা মূল বাহক, সেই মৌলানা সমাজ অভিজাত পঙ্‌ক্তি থেকে নির্বাসিত হয়েছে। অথচ নায়লা ছেলেকে শুধু পোশাক পরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে কল্পনা করেছে মৌলানা হিসেবে। এর মানে এই নয়, সে তার ছেলেকে ভবিষ্যতে মৌলানা হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু তার উচ্চারণ নিশ্চিত করে বলে যে বর্গ হিসেবে ‘মৌলানা’দের প্রতি তার কোনো বিতৃষ্ণা তো নেই-ই, বরং একধরনের সমীহের বোধ আছে। এ ধরনের উচ্চারণ ঢাকার মূলধারার সাংস্কৃতিক উৎপাদনগুলোতে বিরল ঘটনা। দুই. হ‌ুমায়ূনের বহু রচনায় নানান ধরনের মৌলানা চরিত্র বারবার এসেছে। চরিত্রগুলোর গড়নে যে ধরনের সহানুভূতি এবং মায়া কাজ করেছে তার স্বরূপ পর্যালোচনা করে বলা যায়, হ‌ুমায়ূন মূলধারার চিহ্নব্যবস্থায় অপদস্থ মৌলানা সমাজকে দেখার নতুন ভঙ্গি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। সেদিক থেকে নায়লার আপাতসরল উচ্চারণটিকে এমন উচ্চারণ হিসেবে সাব্যস্ত করা সম্ভব, যা হ‌ুমায়ূন বিশেষভাবে উচ্চারণ করাটাকে জরুরি মনে করেন।

যদ্যপি আমার গুরু নামে ইতিমধ্যে ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠা রাজ্জাকনামায় ছফা জানাচ্ছেন, রাজ্জাক সাহেব তাঁকে ‘মৌলবি’ ডাকতে পছন্দ করতেন। প্রফেসর রাজ্জাক গোঁয়ার মানুষ ছিলেন। অর্থাৎ, ধর্ম মানতেন না। অর্থাৎ, ভদ্রলোকসমাজ যেসব ট্যাবু মান্য করে সমাজে দাখিল থাকে, তিনি ভদ্রসমাজের মানুষ হয়েও সেগুলোকে বড় একটা পাতে তুলতেন না। কলকাতায় উনিশ-বিশ শতকের ঔপনিবেশিক শাসনে পুষ্ট প্রাচ্যবাদী এবং মুসলমান বিদ্বেষী সংস্কৃতির প্রচণ্ড প্রতাপে মুসলমান সমাজের সম্মানসূচক শব্দগুলোর যে পতন ঘটেছিল, তাতে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘মৌলবি’ ভদ্রসমাজে পতিত এ রকম শব্দগুলোর একটি। বিশ্ববিদ্যালয়–পাস ছফাকে এবং অন্য কাউকে কাউকে ‘মৌলবি’ সম্বোধন করে তিনি হয়তো শব্দটিকে পুনরায় জাতে তুলতে চেয়েছেন। কাজ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বাংলাদেশের ভদ্রসমাজে শব্দটি তার মহিমা হারিয়েছে।

নজরুল তাঁর মশহুর কবিতা ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এ প্রতিপক্ষের তালিকায় ‘মৌলবী’ আর ‘মোল্লা’দের কথা লিখেছিলেন এভাবে: ‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লারা’ কন হাত নেড়ে’। এখানে ‘মৌলবী’ শব্দটি দুর্দান্ত ওই শব্দালংকারের আমন্ত্রণে এসে থাকতেও পারে; কিন্তু পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাও এই শব্দের পক্ষেই ছিল। ওই সময়ে বাংলা অঞ্চলে ‘স্বাতন্ত্র্যবাদী’ চেতনা দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। জয়া চ্যাটার্জি এবং আরও অনেক কামেল ঐতিহাসিক যদিও কিরা-কসম কেটে আজকাল দাবি করছেন, কথিত স্বাতন্ত্র্যচেতনা বাঙালি ভদ্রলোক হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যেই অধিকতর দৃশ্যমান আর কার্যকর ছিল, কিন্তু কলকাতার কবজি আর কলমের জোরে স্থায়ী দুর্নামের ভাগীদার হলো কেবল মুসলমান পক্ষ। আর ইতিহাসের বিবরণীতে মুসলমান পক্ষের স্বাতন্ত্র্যচেতনা পয়দা করার অন্তত আংশিক দায় বর্তালো বহিরাগত মৌলবিদের ওপর। এভাবে হয়তো বিশ শতকের বিশের দশকে ‘মৌলবি’ শব্দটির একধরনের অপরায়ণ ঘটেছিল। তা ছাড়া ‘মোল্লা’ শব্দটিও তখন দ্রুত তার জাত হারাচ্ছিল। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছেন, মুসলমান বুদ্ধিজীবী তরুণদের একটা বড় দল তখন ‘চুটাইয়া মোল্লা-বিরোধী অভিযান’ শুরু করেছিল। সে তালিকায় আবুল মনসুর আহমদ সাক্ষ্য দিচ্ছেন, নজরুলও ছিলেন। মনে রাখা দরকার, তখন ফররুখ আহমদ বা আবুল হুসেনরা ‘সৈয়দ’ উপাধি বর্জন করছিলেন। সমাজের নতুন ধ্যানধারণা স্বভাবতই পুরোনো ক্ষমতাচক্রের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল। হয়তো ভালোই হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল। কিন্তু এই ‘মোল্লা-মৌলবি’বিরোধীরা নিশ্চয়ই ভাবতেও পারেননি, তাঁদের বিরোধ আরও অনেক বিরোধের সঙ্গে মিলে একটা বিপুল পক্ষকে কীভাবে অস্তিত্ববান রেখেই কোণঠাসা করে ফেলবে।

ইউরোপে আধুনিকতার বিপরীতে গির্জা কোণঠাসা হয়েছিল। কিন্তু সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে খোদ ইসায়ি ধর্মই নতুন নতুন রূপে জায়মান হয়ে ওই ধর্মের নিশানবরদারদের জন্য পরিসর তৈরি করেছিল। কলকাতায় পুরোনো ধর্মপন্থীরা ধরাশায়ী হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল গোরার পরেশবাবুর মতো নতুন ধর্মপন্থী। কিন্তু মুসলমান সমাজ এ ধরনের মৌলিক বদলের মধ্য দিয়ে যাবে না। তার সীমিত আধুনিকতা সমাজের উঁচুতলার খুব সামান্য অংশেই অল্প পরিমাণে কাজ করবে। বিপুল পরিমাণ ধর্মাশ্রয়ী মানুষের কোনো মৌলিক বদল না ঘটিয়েই হয়ে উঠবে আধুনিক। ফলে ধর্মের নিশানধারীরা নতুন কালের উপযোগী হয়ে না উঠে বিদ্যমান থাকবে আধুনিকতার ভার ও ভাঁড় হয়ে। তারা প্রাচ্যবাদী ঘৃণার শিকার হবে। ব্যাপারটা যে বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরে ঘটেছে তা নয়। সে রকম হলে সম্ভবত ভালোই হতো। কিন্তু সামাজিক পরিসরে বহাল তবিয়তে এবং যথেষ্ট সম্মান-শ্রদ্ধা নিয়ে বজায় থেকেই মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও শিল্পকলায় ভীষণভাবে নাকাল দশায় হাজির থাকা বা পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকাটাই তৈরি করেছে গভীর সংকট।

হ‌ুমায়ূন এই অনুপস্থিত বা বিকৃতভাবে উপস্থিত সমাজকেই আবিষ্কার করতে চেয়েছেন তাঁর বিপুলসংখ্যক রচনায়। প্রথম দিকের রচনাবলি সাক্ষ্য দেয়, ব্যাপারটা তাঁর কলমে প্রস্তুত অবস্থায় ধরা দেয়নি, বরং ক্রমে তিনি পারিবারিক কাহিনির গণ্ডি ছেড়ে বৃহত্তর বাংলাদেশের সমাজ আবিষ্কারের অভিযানে নামলে এই চরিত্র সমাজ-সংগঠনের অনিবার্য উপাদান হয়ে তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রচলিত ডিসকোর্সের চাপ তাঁর নিজের বিবরণীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে এই অর্থে যে অনেক দূর পর্যন্ত তাঁর উপস্থাপনা কাউন্টার-ডিসকোর্সের মতো। লক্ষণীয়, তিনি মৌলবি শব্দটি পারতপক্ষে ব্যবহার করতেন না, মোল্লা তো নয়ই; বরং প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে ব্যবহার করে গেছেন তুলনামূলক সম্মানজনক ‘মৌলানা’ অভিধাটি, যেমনটি আমরা দেখেছি ছায়াবীথির নায়লার মুখে।

হ‌ুমায়ূনের মৌলানারা সংখ্যায় বহু আর ধরনে বিচিত্র। কয়েকটি চরিত্র আছে এমন, যেখানে লেখক মৌলানা চরিত্রের প্রতি ভদ্রলোকসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ব্যক্তিচরিত্রকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, যেন গভীর সহানুভূতির একটা পটভূমি গড়ে ওঠে। নবনী উপন্যাসের ‘চ্যাংড়া হুজুর’ এ ধরনের চরিত্র। কলেজের ইতিহাসের লেকচারার এই নামহীন ভদ্রলোককে স্রেফ ধর্মীয় লেবাস ধারণ করায় ছাত্রীকুল আর তাদের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত মা-বাবার যে গভীর ঘৃণা সইতে হয়েছে, তা রীতিমতো বিভীষিকাতুল্য। উপন্যাসটির কুশলী বিবরণীতে লেখক এই সামাজিক ঘৃণার বিপরীতে স্থাপন করেছেন নবনীর প্রেমকে, যে প্রেম বস্তুত ব্যক্তিচরিত্রের শুভ্রতা উন্মোচিত হওয়ার প্রেক্ষাপটেই জন্ম নিয়েছে। এই প্রেম সামাজিক অসম্মতির কারণে পরিণতিতে পৌঁছায়নি; কিন্তু নবনী শেষ পর্যন্ত ওই গভীর অনুভূতি সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে সামাজিক ভাষার বিপরীতে অন্যতর সম্ভাবনার ঘোষণাই দিয়ে গেছে।

এ ধরনের চরিত্রগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ‘মিসির আলি’ সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ বড় গল্প ‘জ্বীন কফিল’-এর মৌলানার কথা। মাদ্রাসাশিক্ষিত এই মৌলানা মোকতার বাড়ির সহানুভূতি পেয়েছিল সম্ভবত তার গরিবি এবং ভালোমানুষির জন্য। কিন্তু ওই বাড়ির ছোট মেয়ে তার প্রেমে পড়ে গেলে সহানুভূতি রাতারাতি পরিণত হয় ঘৃণায়। মেয়েটি সামাজিক ভাষায় বিদ্যমান এই ঘৃণার চাপ সইতে না পেরে আক্রান্ত হয় মনোবিকারে। নবনী উপন্যাসের মতো এ গল্পেও হ‌ুমায়ূন আশ্চর্য কুশলতায় সামষ্টিক ভাষার বিপরীতে ব্যক্তির সহানুভূতিকে আবিষ্কার করেছেন এবং এভাবে সামাজিক ভাষাকাঠামোয় পরাস্ত মৌলানা চরিত্রের জন্য পাঠকের গভীর অনুরাগ নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক ভাষাকে এড়িয়ে না গিয়ে এবং প্রভাবশালী ডিসকোর্সকে সূক্ষ্মভাবে মোকাবিলা করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে জোরালো করার দৃষ্টান্ত অবশ্য হ‌ুমায়ূন-রচনাবলিতে প্রচুর পাওয়া যায়।

নি উপন্যাসের মৌলানাকে ফেলতে চাই হ‌ুমায়ূনের মৌলানাদের দ্বিতীয় বর্গে। এ ধরনের বিপুল চরিত্র নিয়ে কারবার করেছেন হ‌ুমায়ূন, যারা হয় মাদ্রাসাশিক্ষিত অথবা ওই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েই ধর্মীয় নৈতিকতার ভিত্তিতে জীবন যাপন করে। এরা বাস্তবেও তেমন উচ্চকিত চরিত্র নয়, হ‌ুমায়ূনের রচনায়ও নয়; কিন্তু দারুণ প্রাণবন্ত, পরিশ্রমী, বন্ধুবৎসল এবং সত্যিকারের ইহলৌকিক। জোছনা ও জননীর গল্পর ইরতাজউদ্দিনকে বলতে পারি এ ধরনের চরিত্রের চরম রূপ। যে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ওই মৌলানা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও পাকিস্তানের স্থিতি কামনা করে, সেই ধর্মবিশ্বাসজনিত নৈতিকতার বশেই সে নিজের জীবনের বিনিময়ে উপলব্ধ সত্য উচ্চারণের সাহস অর্জন করে। ধর্ম যাদের মতাদর্শের উৎস ও রূপ, সে ধরনের মানুষকে নিয়ে হ‌ুমায়ূন অনেকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

মৌলানাশ্রেণির সঙ্গে ক্ষমতা সম্পর্কের যোগাযোগ পরীক্ষিত হয়েছে হ‌ুমায়ূনের বেশ কয়েকটি রচনায়। এই মেঘ, রৌদ্রছায়া উপন্যাসের ইমামসাহেব উপস্থাপিত হয়েছেন রীতিমতো ক্ষমতার চার প্রধান ধরনের একটি হিসেবে। তবে বলতেই হবে, হ‌ুমায়ূন মৌলানাদের ওই অংশ নিয়ে কোনো কাজ করেননি, যে অংশ রাষ্ট্র বা অপরাপর ক্ষমতার তাত্ত্বিক-প্রায়োগিক ভিত্তি গড়ার জন্য কাজ করে অথবা অনুরূপ কাজে ব্যবহৃত হয়। ধর্মজীবীদের একটা অংশ যে ধর্মচর্চা ও নীতি-নৈতিকতার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য রক্ষা না করেই জীবনাতিপাত করে, সে সত্যও তাঁর লেখায় ধরা পড়েনি। তিনি প্রধানত নজর দিয়েছেন তুলনামূলক নিগৃহীত ও নিরীহ মানুষের দিকে। আরেকটা কাজও তিনি সম্ভবত করেননি। ধর্মতত্ত্ব বা নৈতিকতা বা ভাবাদর্শের দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আগ্রহী কোনো মৌলানা চরিত্র নিয়েও তিনি কখনো আগ্রহ দেখানি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ থেকে শুরু করে তাঁর সমকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মূলধারার শিল্প-সাহিত্যে মৌলানা বা সমধর্মী চরিত্রের যে অপরায়ণ ঘটেছে, তার নিরাকরণই হয়তো হ‌ুমায়ূনের উদ্দেশ্য ছিল। তাতে তিনি সফল হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। নিজের রচনায় মৌলানাদেরকে সমাজের অর্গানিক সমগ্রের অংশ হিসেবে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনি বিরল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। অন্যদিকে হ‌ুমায়ূন-পরবর্তী নানাজনের নানামাত্রিক চর্চা থেকে ধারণা হয়, তিনি প্রবলভাবে এদিকে বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন।

● অপদস্থ মৌলানা সমাজকে দেখার নতুন ভঙ্গি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন হ‌ুমায়ূন।
● তিনি কাজ করেছেন প্রধানত নিগৃহীত ও নিরীহ মৌলানাদের নিয়ে এবং তাঁর উপস্থাপনার গুণে এসব মানুষ খুব সহজেই পাঠকের সহানুভূতি অর্জন করে।
● ধর্ম যাদের মতাদর্শের উৎস ও রূপ, সে ধরনের মানুষকে নিয়ে হ‌ুমায়ূন বহু লেখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
● হ‌ুমায়ূন-পরবর্তী নানাজনের নানামাত্রিক চর্চা থেকে ধারণা হয়, তিনি প্রবলভাবে এদিকে বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হয়েছেন।