জাতীয় আয়োজন ব্যক্তিগত খতিয়ান

শিল্পকলা একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছে রুহুল আমিনের ছাপচিত্র ‘সন্দেহজনক প্রতিকৃতি’
শিল্পকলা একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছে রুহুল আমিনের ছাপচিত্র ‘সন্দেহজনক প্রতিকৃতি’
>এ মাসের প্রথম দিন থেকে ২১ তারিখ অবধি জাতীয় চিত্রশালায় হয়ে গেল জাতীয় চারুকলা ও প্রদর্শনীর ২৩তম আয়োজন। সেই প্রদর্শনীর দিকে ফিরে দেখা।

জাতীয় চারুকলা ও প্রদর্শনীর ২৩তম আয়োজন বিষয়ে কথা বলা আর বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের কাজ নিয়ে ভাষ্য হাজির করা প্রায় একই কথা। তরুণ শিল্পীরাই জাতীয় পর্যায়ে এই বৃহৎ কলেবরের আয়োজনের মধ্যমণি। তবে আয়োজকদের কাজ থেকে দর্শকের চাওয়া-পাওয়া প্রসঙ্গে দু-একটি কথা তো থাকেই।

প্রথমত, শিল্পকর্মের এই যজ্ঞ, যা এশীয় দ্বিবার্ষিক আয়োজনের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বড় ও বিশেষ আয়োজন, তার উদ্দেশ্যটি আরও পরিষ্কার এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তিতে নির্ধারণের সময় এসেছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো শিল্পকর্ম বাছাইয়ে নাকচ করার প্রক্রিয়া জারি রাখা আবশ্যক। গত শতকের আশির দশকে এই প্রদর্শনীতে একাডেমিকেন্দ্রীক বাস্তববাদ বা লাইফ ড্রয়িং কিংবা জড়জীবন আমলে না নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ‘নিরীক্ষা’ শব্দটি প্রায় ফেটিসের পর্যায় উন্নীত হওয়ায়, একদা এর অপব্যবহারও দেখা গেছে। এমনকি আজও এর খুব সদ্ব্যবহার হচ্ছে—এমনটা হলফ করে বলা যায় না। তবু নিরীক্ষার প্রতি পক্ষপাতই জাতীয় পর্যায়ের কলা প্রদর্শনীকে একাডেমির আওতা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। কারণ, শিল্পকর্মের ভাষা, এর বিকাশ, এমনকি নব উৎক্ষেপ—কোনোটিই একাডেমির দক্ষতানির্ভর কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আধুনিক তথা সাম্প্রতিক শিল্পের এমন জাতীয় পর্যায়ের আয়োজন মূলত ‘এনলাইটেনমেন্ট প্রজেক্টের’ পরিণাম বিশেষ। এর মধ্যে দিয়ে জাতীয় সাংস্কৃতিক অর্জনের ভিত্তি যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি এটি দর্শকের রুচি তৈরির কারখানাও। জাতীয় এই মনুমেন্টের মর্যাদা রক্ষা করতে কিউরেটর নিয়োগের কথা তোলা যায়। কিন্তু এ দেশে শিল্পকলা বাছাই ও পুরস্কার প্রদানে শিষ্টাচার কেবল কিউরেটর নামের ‘কাজির বিচারের’ ওপর নির্ভর করে বলে মনে হয় না। শিল্পীদের একমুখীনতা নিরুৎসাহিত করার আরও অনেক প্রতিষেধক এখানে প্রয়োজন।

সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় চারুকলা ও প্রদর্শনীর বর্তমান চরিত্র চিহ্নিত করতে গেলে প্রথমে যেটি কারও চোখ এড়াবে না, সেটি হলো বেশ কয়েকটি একাডেমিমুখী ও অধ্যয়ননির্ভর কিছু শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদন। এসব চিত্রকর্মে অনেক ক্ষেত্রে বাহ্যিক আয়োজন বেশি, বস্তু বা সার কম।

ভারতের চতুর্থ ট্রিয়েনালে (১৯৭৮) উপলক্ষে গীতা কাপুরের সঙ্গে  কথোপকথনের একপর্যায়ে মার্কিন চিন্তক হেরল্ড রোজেনবার্গ ‘পপ’-শিল্পে বিষয় বা সাবজেক্ট ম্যাটার আছে অথচ কনটেন্ট বা সারবস্তু নেই—এমন সিদ্ধান্ত দেন। পদের মধ্যে পদার্থ না রাখা যদি শিল্পীর ভাষা তৈরির প্রকল্প হয়, যেমন ওয়ারহোলের ক্ষেত্রে ছিল, তবে শিল্পের একটা চরিত্র দাঁড়াতে পারে। কিন্তু শিল্পী যদি তাঁর বিষয়ের আকারায়ণ ও উপস্থাপনায় এমন হয়ে ওঠেন যে আধারে আধেয় নেই এবং একে উদ্‌যাপন করা হচ্ছে বলে মনে হয়, তখন শিল্পের ভিত নড়তে বাধ্য। নাম না উল্লেখ করে বলা যায় যে জড়জীবন জাতীয় কাজে, ঐতিহ্যের নামে নকশা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে, এমনকি আত্মপ্রতিকৃতি বা আপন দেহ উপস্থাপন করে দক্ষতা প্রদর্শনের মধ্যমে এই সমস্যা চিহ্নিত করা গেছে।

আরও যে যে বিষয়ের অভাবে শিল্পের পরিসরে চিত্রভাষার বিকাশে ব্যত্যয় ঘটেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিল্পীর নিজস্ব ‘ডিসকোর্স’ না থাকা। চিন্তা ও ডিসকোর্সের পার্থক্য হলো, দ্বিতীয়টি জীবন-যাপন-চৈতন্য—এই তিনের সূত্রে গভীরতা পায়। অন্যদিকে চিন্তানির্ভর ছবি বিমূর্তকে মূর্ত করে তোলার মতো একরৈখিক প্রক্রিয়ানির্ভর। ‘সোশ্যাল মিডিয়া শো অফ’ (শিল্পী: শারমী আলম), কিংবা ‘ওমেন সারাউন্ডিং’ (শিল্পী: কপিল চন্দ্র), চিত্রদ্বয়ে অঙ্কনের মুনশিয়ানা আছে, চিন্তা আছে, কিন্তু চিন্তাকে শিল্পে রূপান্তরের চেষ্টার বিপরীতে এখানে চিন্তার বা নিরাকার ভাবনার সাকার রূপ সৃষ্টি করা হয়েছে মাত্র। এ ছাড়া অনেক উদাহরণ দেওয়া যেত, কিন্তু এ দুইয়ের মধ্য দিয়ে তর্কের সহজ সুরাহা হয় বললে ভুল বলা হয় না।

আরও একপ্রস্থ চিত্র আছে, যেগুলোতে নকশাধর্মিতা বর্তমান ও প্রকৃতির উপস্থাপনায় আলোকচিত্রসুলভ কিছু উপাদান তুলে ধরা হয়েছে।

এই যদি হয় সমস্যার খতিয়ান, তবে এত বৃহৎ কলেবরের প্রদর্শনীতে সম্ভাবনার দিক নিয়েও আলোচনার অনেক উপলক্ষ হাজির আছে বলা যায়। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রুহুল করিমের ‘দ্ব্যর্থক প্রতিকৃতি’ বা ইংরেজিতে ‘পোর্ট্রেট অব অ্যাম্বিগুইটি’, অথবা রাফাত আহম্মেদের ‘সম্পর্ক-৪’—আধাবিমূর্ত ও বাস্তববাদী রীতির এই দুটি ভিন্ন উপস্থাপনা আসলে একই ছকনির্ভর। প্রথমজন যদি রেখার জটিলতায় বিশ্বাস রেখে মুখাবয়বের দ্ব্যর্থকতা তুলে ধরতে কাঠখোদাই সম্পন্ন করে থাকেন, অন্যজন মানুষের অবয়বের বাস্তবতায় দ্ব্যর্থকতা সৃষ্টি করেছেন কাপড়চোপড়ের ওপর ভিডিও ইমেজের প্রক্ষেপণ নকল করে। প্রক্রিয়াটি দুজনেরই পাথেয়। এর সুফল তাঁরা অর্জন করেছেন চিত্রের সম্ভাবনা ছড়িয়ে দিতে পেরে।

শহিদ কাজীও একই পথের পথিক, যদিও উপস্থাপনার ব্যাপকতায় তিনি চিত্রকে স্থাপনামুখী করে তুলছেন।

অপর দিকে আরও পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী ফারিয়া খানম আয়না ব্যবহার করে তাঁর হিজাব পরিহিতার ফিগারে নতুন মাত্রা যোগ করতে পেরেছেন। এই মাত্রা তাঁর শিল্পকে অংশগ্রহণমূলক বস্তুতে পরিণত করেছে।

বাস্তববাদী অঙ্কনে পারদর্শী শিল্পীদের মধ্যে সুনন্দা বাণী বর্মণের ‘মুখোশ’, সরফুদ্দীন মাহমুদ চৌধুরীর ‘আঁধারে যাত্রা’—এসব ছবির বিষয়ের উপস্থাপনায় শিল্পীরা যে ইঙ্গিতধর্মিতা ব্যবহার করেছেন, তা অনেকের কাজের লিটারালিজম বা আক্ষরিকতার বিপরীতে যথেষ্ট লাগসই বলে দাবি করা চলে।

ইঙ্গিতময় প্রতীক নির্মাণের দিক বিচার করলে মলয় বালার প্রাচ্যকলার টেকনিক ব্যবহার করে গড়ে তোলা কাজটিও বহুবিধ সম্ভাবনা ধারণ করে।

বিমূর্ত নির্মাণ অর্থাৎ চিত্রতল বিষয়বস্তুহীন করে তোলার শক্তি নতুন প্রজন্মে খুব একটা লক্ষ করা যায় না। যদি আজমির হোসেনের আধোবিমূর্ততা কিংবা আরজু রাহমানের বিমূর্ততাকে মান হিসেবে ধরে নিই, তবে বিমূর্ত ও মূর্তের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যাঁরা স্বার্থক ছবি এঁকেছেন, তাঁরা হলেন সোমা সুরভী জান্নাত, রুজভেল্ট ডি রোজারিও এবং প্রমিতি হোসেন। এই শিল্পীরা কেবল চিত্র বা চিত্রভাষার শক্তিতে বিশ্বাসী নন, তাঁদের কাজে ব্যাষ্টিক সামাজিক মনস্তত্ত্ব রেখা ও মোটিভের সূত্রে গড়ে উঠেছে। স্বকীয় ও পরকীয়—এই দুটি বিষয়কে তাঁরা একত্রে হাজির করতে পেরেছেন। সুরভী তাঁর স্থাপনাসুলভ কাজ, যাতে রেখাচিত্র বড় ও ছোট ছোট চিত্রপট থেকে দেয়ালেও বিস্তার লাভ করেছে, বৃহৎ কলেবরের এই স্থাপনা যেন মনোজগৎ ও জগৎ উভয়ের ব্যাখ্যা হিসেবে হাজির করেছেন।

প্রমিতি হোসেন তাঁর কালো পটে অপর বা বহির্জগতের আয়োজনে ডাক্তারি বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত ছবি ব্যবহার করে সমালোচনামূলক বার্তা বা সংকেত হাজির করেছেন। তাঁর ছবিতে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করে, তা যেমন দাদাবাদের নব্য পরিণতি হিসেবে পাঠ করা যায়, তেমন চিহ্নের কাব্যিক প্রকাশ বলেও একে ব্যাখ্যা করা চলে। কাব্যিক প্রকাশের সূত্রে প্রমিতির কাজে একধরনের নীরবতা বিরাজ করে, যা দাদাবাদের উচ্চনাদী ভাষ্যে কখনো সেভাবে লক্ষ করা যায়নি।

বলা বাহুল্য, ভাস্কর্যের চেয়ে বরাবরই চিত্রের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। গুণ বিচারে চিত্রের স্থানও ওপরে। তবে কয়েকটি স্থাপনার উল্লেখ ছাড়া এই প্রদর্শনীর প্রতি সুবিচার করা হয় না।

শারদ দাশের ‘উই আর গোয়িং ফাস্ট!!!’ একটি পুরোনো থিমের ভাস্কর্যরূপ। অন্যদিকে আশির দশকের শিল্পী নিলুফার চামান মানব, প্রকৃতি—এ দুইয়ের ঐক্য ও মানুষের তৎপরতায় প্রকৃতির পরিণতির দিকটি স্বয়ংক্রিয় র‌্যাত, কাটা গাছ, সোনালি বুলহর্ন, সোনালি এক জোড়া শ্রমিকের বুট, কাটা তক্তা, গাছের সোনালি বাকল ইত্যাদির সমন্বয়ে বিশাল আকারের স্থাপনার আয়োজন করেছেন।

আবার নতুনতর দিক উন্মোচনের সূত্রে পলাশ ভট্টাচার্য পঞ্চভূতের তিনটি উপাদানকে আধুনিক জীবনে অনুষঙ্গে তিনটি ভিডিও মনিটরে তুলে ধরেছেন। রূপম রায় তাঁর ‘মাইগ্রেটরি সাউন্ড’ শিরোনামের স্থাপনায় দৃশ্যের বদলে উপস্থাপন করেছেন অভিজ্ঞতা। ফুলে-ফেঁপে ওঠা বিশাল মোটা পাইপ যেন শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়ছে। এমন কাজ দর্শকের সঙ্গে ক্রিয়া করতে সক্ষম।

ঢাকার শিল্পাঙ্গনে শিল্পের ক্রিয়া করার বিষয়টি বহু আগে থেকেই নানা উপায়ে দর্শকের কাছে পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এমন শিল্পের সূত্রে লেখাজোখার হদিস মেলে না। আমাদের শিল্পাঙ্গনে শিল্প বিষয়ে সরেস চিন্তার অভাব এখনো পূরণ হয়নি। নানামুখী যে বিকাশ ঘটছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কোনো বয়ান শিল্পের শরীর বর্ণনায়, এমনকি আত্মা চেনাতে এখনো লেখা হয়নি।