ক্রিপটোনিয়ান

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

এপ্রিল মাসের এক পড়ন্ত বিকেলবেলায় প্রথমবারের মতন তার অস্তিত্ব আমার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠল। টানা কয়েক দিন গায়ে গায়ে লেগে থাকার পরে সেই দিনই জ্বর ছেড়েছিল। বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং গাউনটা জড়িয়ে নিয়ে টলোমলো পায়ে আমার আটতলা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের বে-উইন্ডোতে বসেছিলাম দেয়ালে পিঠ রেখে। শরীরে অবসাদ এবং মনে এক ধরনের বৈরাগ্য। আমার এত অসুস্থতা সত্ত্বেও একই রকমভাবে ঘূর্ণমান পৃথিবীর প্রতি অভিমান নিয়ে জানালার বাইরে চেয়েছিলাম। রাস্তায় সার বাঁধা মেপলের পাতাগুলো অনেক রকম রঙে রঙিন—সবুজ, হলুদ, লাল, কমলা, খয়েরি। তারা টুপটাপ গাছ থেকে খসে পড়ে জড় হচ্ছিল ফুটপাতে, বাতাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে ফেলছিল দূরে দূরে। গাছগুলোর মাথায় নরম আলো। সেই একই আলোর চাদর এসে আমার গায়ের ওপর পড়ায় গাছেদের সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি হচ্ছিল।

সেদিন রাস্তাও একদম নিরিবিলি। শুধু ওই পাশের বাড়িটার খোলা জানালায় একটা সাদা নেটের পর্দা বাতাসে দুলছিল—সুখের দিনের স্মৃতির মতন। তার অবাধ ওড়াউড়িতে গতজন্ম মনে পড়ে—কী ছিল তখন? এখন কী নেই? ওই বাড়িতে কারা থাকে? আটতলার জানালায় পাখিরা হাতের কাছে ওড়ে। একটা খয়েরি পাতা বাতাসে নাচতে নাচতে কত ওপরে উঠে আসছিল। রোদ লেগে স্পষ্ট হচ্ছিল, সে যে প্রাণহীন কে বলবে? আমি নিজের মনেই গুনগুন করছিলাম, ‘ইয়েলো বার্ড, ইউ আর নট লং, ইন সিঙিং অ্যান্ড ইন ফ্লাইং অন...।’ ঠিক তখনই গাউনের পকেটে ফোনটা কেঁপে উঠল। ফেসবুক মেসেঞ্জারে জামশেদ জিসান লিখেছে, ‘উইলো উইপিং ইন দ্যা ওয়াটার, ওয়েভিং টু দ্যা রিভার ডটারস, সোয়েইং ইন দ্যা রিপলস অ্যান্ড দ্যা রিডস, ইন আ ট্রিপ টু সিরাস মাইনর, স’ আ ক্রেটার ইন দ্যা সান...আ থাউজেন্ড মাইলস অব মুনলাইট লেটার...।’ চমকে ঘরের আনাচ-কানাচে চোখ বোলালাম। এই গানটাই আমি ভাবছি সে জানল কেমন করে? কাকতালীয়?

মনে পড়ল এই আইডির সঙ্গে আমার কমন কোনো বন্ধু নেই। এ রকম কারও বন্ধুত্বের অনুরোধ সাধারণত আমি রাখি না। এর বেলায় ব্যতিক্রমের কারণ তার কভারে বুকোওস্কির বাণী, ‘সত্যি সত্যি বাঁচার আগে কয়েকবার মরতে হয়।’ যখন তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল, ঠিক তখন আমি বুকোওস্কির পোস্ট অফিস পড়ছিলাম। এখন অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে তখন কেন অবাক হলাম না? অনুরোধ গ্রহণ করেছিলাম। উত্তরে ইনবক্সে সে লিখল, ‘থ্যাংকস’, আমি লিখলাম, ‘বুকোওস্কি আমারও প্রিয়’, আর একটা স্মিত হাসির ইমো। এরপর মাঝেমধ্যে বার্তাবিনিময় হয়েছে, যে রকম অনেকের সঙ্গেই হয়। বেশির ভাগ সময়ই আমার বিভিন্ন লেখা পড়তে চেয়েছে, দিয়েছি। কখনো পছন্দের গানের লিংক ভাগাভাগি। একদিন লিখল, ‘হাইবার্নেশানে যাই, ভালো থাকবেন।’ তাতেও আমার অনুভূতির তেমন কিছু হেরফের হয়নি। ফেসবুকে এটাও খুব সাধারণ ঘটনা।

ভদ্রতাবশত লিখলাম, ‘আপনিও ভালো থাকবেন, আমাদের এলোমেলো আলাপগুলো মিস করব।’

 ‘আমিও, দ্যা মেমরি উইল ব্রিং আ সাডেন স্মাইল অন মাই ফেস আউট অব দ্যা ব্লু।’

 ‘আপনার ইমেল আইডি দিয়ে যান।’

 ‘এখানেই আবার কথা হবে, থাকেন আর নেন গান শুনেন।’

সেই গান আর শোনা হয়নি, তার আগেই সে হাজির। আমার চমকানো ভাব গোপন করে লিখলাম, ‘ইউ আর ব্যাক! ইয়েই!’

সে একটা হাসিমুখের ইমোর সঙ্গে লিখল, ‘কেমন আছেন আপনি বা ছিলেন?’

এই এক প্রশ্নেই খানিক আগের আমার বৈরাগ্যমেশানো অভিমানটুকু মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। বাইরে রাস্তার ওপরে তখন মেপলের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে কয়েক ফোঁটা পানি উপচে নামল, আর আমি একটা হাসিমুখ আঁকলাম মেসেঞ্জারে। তারপর লিখলাম, ‘আমি তো থাকিই! আপনি কেমন আছেন? যে দুঃখে বনবাস গেছিলেন সেইটা মিটছে?’

‘হা হা হা, দুঃখ নিয়ে না, কাজের চাপে। বনবাস, শহরবাস। আপনার শহর থেকে দূরে অনেক।’

‘এখন আপনি কই?’

‘আপাতত ভারতে, তবে এমনিতে ঢাকায় থাকি।’

‘এফ-বির এই নাম তো বোধ হয় আপনার নিজের নাম না, তাই না?’

‘এইটা আমার অল্টার ইগো, সুপারম্যান আইডি। ক্লার্ক কেন্ট আপাতত বিশ্রামে আছে। ডেইলি প্ল্যানেট ওকে এত কাজের চাপ দিয়েছে যে সে একদমই ক্লান্ত।’

‘বাহ্বাহ্, আপনাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ! আমি তো আটতলার জানালায় বসে লাফ দেওয়ার তাল করতেছিলাম। এখন আপনি চলে আসছেন, নো চিন্তা, উড়াল দিয়ে ধরে ফেলবেন না?’

‘ভুলেও আমার ওপর ভরসা করবেন না! একটু ড্যামেজড আর ডিফেক্টিভ আছি।’

একটা দুঃখিত চেহারার ইমো দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘তো এই সুপারম্যানের কী কী বৈশিষ্ট্য?’

‘সে মানুষদের দেখে...দূর থেকে...’

‘আরে আমিও তো!’

‘আপনিও ক্রিপটন থেকে? বাহ বাহ বাহ!’

‘তো ক্লার্ক কেন্টের নাম বলা যাবে না?’

‘যেদিন আমার সাথে এক কাপ কফি খাবেন, সেদিন যাবে।’

‘কবে?’

‘কোনো একদিন...’

এ রকমই আপাত অর্থহীন কথার পিঠে কথা বলে যাচ্ছিলাম। বিকেল মরে গিয়ে সন্ধ্যা নামল। রাস্তায় আর উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে আলো জ্বলে উঠল। আমার বাতি নেভানো ঘরের ভেতর রাস্তার আলো ঝাঁপিয়ে এসে একটা আরামদায়ক আধো অন্ধকার সৃষ্টি করেছিল। আমরা টাইপ করতে করতে ভাগাভাগি করে নিচ্ছিলাম গানের লিংক, কবিতার পঙ্‌ক্তি, সিনেমার সংলাপ, বইয়ের প্যারাগ্রাফ বা ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের টুকরো। ফোনের নীলাভ সাদা আলো ভালো লাগছিল। সে কিছু টাইপ করার সময় ফোনে একটা টরেটক্কা মতন শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ফোনের স্ক্রিনে তিনটে বিন্দু ক্রমাগত ঢেউ খেলে খেলে ওঠানামা করতে করতে জীবন্ত হচ্ছিল। পরম শান্তির এই সব, খুব নির্ভরতার। যেন একটা দমচাপা সুড়ঙ্গ থেকে কেউ হাত ধরে ধীরে ধীরে তুলছিল আমাকে। খোলা বাতাসে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলছিল, এবার শ্বাস নাও।

পরের দুই মাস অনিয়মিত কথা হতো। সে ডুব দিয়ে থাকত প্রায়ই, বলা-কওয়া ছাড়া। যেহেতু ফেসবুক আইডি ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব জানি না, নিজ থেকে তাই যোগাযোগও করতে পারতাম না। তার জন্য অপেক্ষা, প্রতীক্ষায় রূপ নিল। সেতারের তারের মতন টানটান হয়ে থাকতাম। যখন হঠাৎ শুশুকের মতন ভেসে উঠত, ঝনঝন করে বাজতাম আমি। আজব এক খেলা, কখনো সে এসে বলল, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’, হয়তো আমি ড্রাইভ করছি তখন, সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে জবাব দিতাম, কিন্তু সে চুপ।

কখনো টিকতে না পেরে লিখতাম, ‘এই যে ভাই সুপারম্যান, আপনি তো ক্রিপটনের কলঙ্ক! লোকজন যে ঝুপঝাঁপ লাফায়ে নিচে পড়তেছে, কই আপনি তো প্যান্টের ওপরে আন্ডারওয়্যার পরে উদ্ধার করতে আবির্ভূত হইতেছেন না!’

উত্তরে সে জানাত, ‘সরি, ওয়াজ লকড ইন দ্য ফোর্ট্রেস অব সলিটিউড, ক্রিপ্টোনাইট এভরিহোয়্যার!’

একদিন অফিসে কাজ করছিলাম। এ সময় লিখল, “জানেন এখানে খুব বৃষ্টি, কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না, কম্বল গায়ে গড়াগড়ি দিচ্ছি!’

টাইপ করা কয়েকটা শব্দ মাত্র, তাতেই আমার গাল-টাল লাল হয়ে কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। নিজেই বুঝলাম না কী হলো বিষয়টা। বাংলা সিনেমার ভিলেনের ঢঙে লিখলাম, ‘সুন্দরী! আপনি যে একটা সিডাকট্রেস এইটা জানেন?’

এবার লজ্জায় লাল হওয়ার একটা ইমো দিয়ে লিখল, ‘আপনি সিডিউসড হইতেছেন নাকি?’

‘হইতেই পারি!’

 ‘শোনেন, আমাকে বেশি লাই দিয়েন না, আমি কিন্তু লোক খারাপ, আপনার অবুঝ নির্মল বালিকা হৃদয় একদম তছনছ করে দিব, মুহাহা!’

‘আমার যত ইচ্ছা লাই দিব, আপনার কি তাতে? হুম হুমম হুমমম?’

‘আচ্ছা, অ্যাজ ইউ উইশ। এবার উঠি, থাকেন।’

‘শোনেন শোনেন, আমাকে আপনার ভয়েস ক্লিপ পাঠান।’

‘পাঠাব না।’

কিন্তু কয়েক দিন পর ঠিকই পাঠিয়েছিল। ভাঙা ভাঙা গলা, তাতে একটা প্রশ্রয় মেশানো সান্ত্বনা ছুঁয়ে আছে, যেন আমি বাচ্চা একটা মেয়ে আর সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করছে, ‘এত অস্থির কেন আপনি, বলেন তো? শোনেন, নদীর পানি যেভাবে যায়, ডুবানো হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে, কিছু সময় সেভাবে যেতে দিতে হয়...’

ফেসবুকের বাইরে তাকে কল্পনা করতে চাইতাম। একটাই দৃশ্য ঘুরেফিরে ভাসত চোখে। খুব দ্রুতগামী ট্যাক্সির পেছনের সিটে গা এলিয়ে সে বসে আছে, অনেক রাত। খুব ক্লান্ত সে। কানে হেডফোন, গাড়ির খোলা জানালায় তার চুল উড়ছে, ধুলাবালি লাগছে চোখেমুখে। গাড়িটা পেরিয়ে যাচ্ছে গাছের পর গাছ মাঠ, লাইটপোস্ট। তার কানে বাজছে রে লামনটেইনের গান ‘ওয়াক অন ডাউন দ্যা হিল, থ্রো দ্যা গ্রাস গ্রোন টল অ্যান্ড ব্রাউন অ্যান্ড স্টিল ইটস হার্ড সামহাউ টু লেট গো অব মাই পেইন, অন পাস্ট দ্যা বাস্টেড ব্যাক অব দ্যাট ওল্ড অ্যান্ড রাস্টেড ক্যাডিলাক দ্যাট সিঙ্কস ইনটু দিস ফিল্ড কালেক্টিং রেইন...উইল আই অলওয়েজ ফিল দিস ওয়ে, সো এম্পটি, সো এস্ট্রেঞ্জড...’

আমার মনে হয়, এটাই তার গান। সে-ই শুনিয়েছিল, আর আমার একদম ভেতরের সমস্ত হাহাকার কান্না হয়ে উঠে আসছিল। হয়তো এটা আমারও গান, আমাদের যোগাযোগটা বোধ হয় এখানেই।

মাঝেমধ্যে খুব অভিমান হতো, অপমানিত লাগত, মূল্যহীন মনে হতো নিজেকে। চোখ থেকে টুপটাপ পানি ঝরত আর আমি হাসি হাসি গলায় তাকে ভয়েস ক্লিপ রেকর্ড করে পাঠাতাম।

একবার পাঠালাম, ‘আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর, ওরে কেরামত, আমারে কেউ পারবি না রে করতে মেরামত।’

সে লিখল, ‘আমি তো ইন্টারগ্যালাক্টিক হাইওয়ে, হাই হয়ে ছুটে আসতেছি! আপনি একটা আস্ত পাগল, এটা জানেন?’

শুধু এইটুকুতেই মনে হতো খুশিতে বেলুনের মতন উড়ে যাব। একবার খুব হাসছিলাম, বলেছিলাম, ‘কমলা একটা পারফেক্ট ফল। ওপরের স্কিনটা দেখলে বোঝাই যায় না ভেতরে কীভাবে প্রতিটা অংশ সাজানো! লেয়ারে লেয়ারে সারপ্রাইজ।’

জবাবে বলল, ‘একদম আপনার মতো, একপ্যাঁচ শাড়ির নিচে ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট।’

হাসির রেশ নিয়েই জানতে চাইলাম, ‘ডিড ইউ মিস মি?’

সঙ্গে সঙ্গে চাবুকের মতন জবাব এল, ‘না, সে রকম কথা ছিল?’

এই একটা বাক্যেই তাল কেটে গেল। যদিও শব্দগুলো আলাদাভাবে তেমন কর্কশ কিছু না। তবু যেন প্রশ্নটা তাকে কোনো তিক্ত কিছু মনে করিয়ে দিয়েছিল আর সে বিরক্তিতে চোখমুখ শক্ত করে ভ্রু কুঁচকে জবাব দিয়েছে। কেন? এর ভেতর অধিকারবোধের ভাব আছে তাই? প্রচণ্ড অপমানিত লাগলেও ব্যাপারটা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিতে চাইলাম।

 ‘সেইটা তো অবভিয়াস যে করেন নাই, কিন্তু বলেন তো একটু আগের সেই ভদ্র ছেলেটাকে কী করলেন?’

 ‘হয়তো সে কখনো ছিলই না। আমি এমনই, অসহ্য লাগলে ব্লক করে দেন।’

তারপরেই দেখি আর মেসেজ পাঠানো যাচ্ছে না।

পরে অবশ্য আবার আলাপ সহজ হয়েছে। তবুও তার সেদিনের বিরক্তিটুকু একটা কাঁটার মতন বিঁধিয়েছিল আমাকে। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম যে সত্যিই তার কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই।

দুই.

এখন জুলাই মাস। গাছের পাতা ঝরে গেছে, ডালগুলোকে মনে হয় কঙ্কাল। গুনে গুনে কুড়ি দিন জামশেদ জিসানের কোনো মেসেজ পাইনি। এর আগে এতদিন নিঁখোজ থাকেনি। আমি অফিসে। সন্ধ্যা হচ্ছে, অফিসের জানালা থেকে দূরের সমুদ্র দেখা যায়। আমাদের অপেক্ষাগুলো রেলগাড়ির মতন। সূর্য ডুবছে, তরল হলুদ। সামনের সাদা বাড়িটার টানা বারান্দা পার করে কালো জামা পরা মেয়েটা হেঁটে গেল। সূর্যটা তলিয়ে যাচ্ছে। এই দেখতে থাকাগুলো বোবা...অফিসের ভেতরে সবার ব্যস্ত পায়চারি। সামনের রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ে। আলো জ্বলে ওঠে। সবকিছুর ভেতরে আমার নিশ্বাস কেঁপে কেঁপে ওঠে, তাতে শূন্যতা জড়ায় সেলাইয়ের মতন। এসবের ভাষা নেই। আমাদের অপেক্ষাগুলো রেলগাড়ির মতন মনে হয়। আকাশটা গোলাপি হয়। ওরা বাড়ি ফিরবে, আমিও অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম পর্যন্ত...শুধু আমি কোথাও ফিরব না...

তিন.

ট্রাম ক্রসিংয়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সকালের ট্রামে দেখা বৃদ্ধার মুখ মনে আসে। তার হাতে একটা বই ছিল-ইউ। বয়স কত হবে তার? আশি? মুখে কি পরিতৃপ্ত ভাব ছিল? তার একটা জীবন কেমন গেল? শুধু সেই বই পড়তে থাকা, ভাঁজ পড়া চামড়ার পরতে পরতে আদরের মতন রোদ লেগে থাকা এক মুহূর্ত দেখে কিছুই জানা যায় না। কত অসংখ্য মুহূর্ত আমি জানি না, দেখিনি...

হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে কারও গায়ে পড়লাম। কেউ দুহাত দিয়ে আমাকে জাপটে ধরে আছে। আর তীব্র ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ট্রামটা পার হলো। আমার হার্টবিট আমি নিজেই শুনতে পাচ্ছি। নরম উলের সোয়েটারে ডুবে আছে আমার মুখ। আর হালকা আফটার শেভের গন্ধ। আমি মুখ তোলার আগেই সে তার দুহাতের পাতায় আমার মুখ নিয়ে উঁচু করে ধরল। ট্রাফিক লাইটের আলো তার চোখেমুখে। কী যে স্নিগ্ধ, সুন্দর! তার চোখ ঝিকমিক করছে, হাসছে সে। আমি এমনকি নিশ্বাসও নিতে পারছি না! আমার চোখ মুছে দিতে দিতে সে বলল, ‘তো মিস কমলালেবু, একটু হইলেই তো জীবনানন্দ হয়ে সারছিলেন!’

একটু ধাতস্থ হয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কে?’

‘আমি একজন মুমূর্ষু! চলেন এইবার আমার শুশ্রূষা করবেন!’ আমাকে জড়িয়ে থেকেই তার দিকে টানতে টানতে সে বলে।

তার বুকের ওপর হাত রেখে থামাতে থামাতে বলি, ‘না না না, আগে নাম বলেন আপনার।’

এবার নাটকীয় ভঙ্গিতে কয়েক হাত দূরে গিয়ে মাথা থেকে অদৃশ্য টুপি খুলে একটা বাও করে সে, ‘আপনার সেবায় ক্লার্ক কেন্ট ওরফে ইশতি হে মহিমাময়ী! যদি অনুগ্রহ করে আমার সাথে এক পেয়ালা কফি পানে আজ্ঞা হয়, তবে আজকের এ মনোরম সন্ধ্যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে...।’ সে হাত বাড়ায় আমার দিকে।

আমি তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরতে ধরতে বলি, ‘ইশ্! আমাকে একমাত্র ক্লার্ক কেন্টই বাঁচাতে পারে!’