আরও কিছুদিন থাকা প্রয়োজন ছিল তাঁর

মুহম্মদ আবদুল হাই (২৬ জুলাই ১৯১৯—৩ জুন ১৯৬৯)। প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী
মুহম্মদ আবদুল হাই (২৬ জুলাই ১৯১৯—৩ জুন ১৯৬৯)। প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী

যে বাংলা বিভাগ আমরা এখন দেখছি, তা মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের গড়া। কথাটা পুরোপুরি ঠিক হলো না। বরং বলা উচিত, যে বাংলা বিভাগ আমরা এখন দেখছি, তার কিছুটা মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের গড়া আর বাকিটা আমরা ভেঙে ফেলেছি। আমাদের হাতের হাতুড়ি যে বড় শক্ত! এখন বিষয় অনুযায়ী সিলেবাস হয় না, বরং শিক্ষক অনুযায়ী সিলেবাস হয়। এখন ক্ষেত্র নির্ধারণ করে গবেষণা হয় না, এমনকি গবেষণার পরেও তার ক্ষেত্র বিচার হয় না। এখন ছাত্ররা নিজে তৈরি হতে চায় না, শিক্ষকের মাধ্যমে কীভাবে ‘তৈরি’ হওয়া যায়, সেই চেষ্টা করে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ বেশি দূর এগোতে পারেনি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রায় অর্ধশত বছর পার হয়ে গেল। কত স্বপ্ন ছিল! ওই স্বপ্ন পর্যন্তই। কিংবা বলা যায়, ওই স্বপ্ন ছিল দিবাস্বপ্ন। এখনো ষাটের দশকের গৌরব নিয়ে বুক ফুলাই আমরা। তবে সেটা বাইরের রূপ। ভেতরটা যে বড় ফাঁপা—সেখানে বায়ু নেই, প্রাণের স্পন্দন নেই। অনেক সময় বাইরের ক্ষতটাও ধরা পড়ে অন্যদের চোখে। আবদুল হাইয়ের মতো স্বপ্নদ্রষ্টা এবং দূরদর্শী ‘নেতা’র অভাব শুধু বাংলা বিভাগ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল হাই যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪৯ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩০। সময়টা দেখুন, ভারতবর্ষ থেকে সবে আলাদা হয়েছে পাকিস্তান। স্বপ্ন কিন্তু তখনো ছিল। তবে সেটা সত্যি করে তোলার স্বপ্ন। যোগদানের পরের বছর তিনি লন্ডনে চলে যান জে আর ফার্থের অধীনে উচ্চতর গবেষণা করার কাজে। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘আ ফনেটিক্স অ্যান্ড ফনোলজিক্যাল অব ন্যাজালস অ্যান্ড ন্যাজালাইজেশন ইন বেঙ্গলি’। ১৯৫৩ সালে আবার বাংলা বিভাগে যোগ দেন। আবদুল হাইয়ের অধীনে পিএইচডি করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। গবেষণার বিষয়-বৈচিত্র্যের দিকে অধ্যাপক হাইয়ের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। তিনি এঁদের একজনকে গবেষণা করিয়েছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগ নিয়ে, একজনকে লোকসাহিত্য বিষয়ে এবং আরেকজনকে ভাষার ওপর।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে তখন বাংলার পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা সহজ ছিল না। কেন? কারণ, ১৯৪৭-এর পর ভারত হয়ে গেল হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান হলো মুসলমানের দেশ। অথচ বাংলা পড়তে গেলে পড়তে হয় মধ্যযুগের কাব্য। আর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মানেই ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্য। সেখানে বড় অংশজুড়ে রয়েছে হিন্দু কবিদের লেখা দেবদেবীমূলক প্রশস্তিগীতি। আবদুল হাই এই সত্যকে অস্বীকার করবেন কীভাবে? অথচ ওদিকে সরকারের রক্তচক্ষু। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল-এর অংশবিশেষ পাঠ্য করলেন হাই সাহেব। সব ভেবে তিনি এর নাম দিলেন ‘কালকেতু উপাখ্যান’। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল পাঠ্য করতে গিয়েও একই সমস্যা। হিন্দু সাহিত্য ইসলামি রাষ্ট্রে পাঠ্য হয় কীভাবে? আবদুল হাই একটু কৌশলী হলেন। নির্বাচিত অংশের নাম দিলেন ‘মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান’। একই কারণে মধ্যযুগের আদিকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর নাম দিলেন ‘বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য’। বৈষ্ণবপদ আর শাক্তপদ পড়ানোর জন্য সংকলন গ্রন্থ করলেন। নাম দিলেন ‘মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতা’। বাংলা বিভাগের পাঠ্যক্রম নির্ধারণ এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট সংস্কারে নিজেকে সঁপে দেননি তিনি। এসব কাজে পাশে পেয়েছেন সৈয়দ আলী আহসান, আহমদ শরীফ, আনোয়ার পাশাসহ আরও অনেক গুণী শিক্ষককে।

বাংলা বিভাগ থেকে সাহিত্য পত্রিকা নামে একটি গবেষণা পত্রিকা বের হয়। সেটির যাত্রা শুরু হয়েছিল আবদুল হাইয়ের হাত ধরে, ১৩৬৪ সালে। ওই পত্রিকা দেখার পর ১৩৬৫ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় শনিবারের চিঠি লিখল, ‘এমন সুসম্পাদিত মূল্যবান প্রবন্ধ সংবলিত সাহিত্য পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গ হইতে একটিও প্রকাশিত হয় না।’ শনিবারের চিঠির এই মূল্যায়নে একটুও বাড়াবাড়ি নেই। কারণ, পশ্চিম বাংলা থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাই প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু একাডেমিক ঘরানায় তখন পর্যন্ত সাহিত্য পত্রিকা ছিল দুই বাংলায় সেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে এরপর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ গবেষণা পত্রিকা বের করতে থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় সাহিত্যিকী (১৩৬৬), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাণ্ডুলিপি (১৩৭৬), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষা-সাহিত্যপত্র (১৩৮০)।

 ১৭৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির এক বক্তৃতায় উইলিয়াম জোন্স খুলে দিয়েছিলেন তুলনামূলক ভাষাচর্চার ঐতিহাসিক দ্বার। এরপর উনিশ শতকের পুরোটা জুড়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের চর্চা হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়—এঁরা ছিলেন তুলনামূলক বাংলা ভাষাতত্ত্ব-চর্চার শীর্ষ ব্যক্তি। বিশ শতকে বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আবদুল হাই ছিলেন প্রথম বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানী। বাংলা ভাষার ধ্বনি নিয়ে তিনিই আধুনিক কালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অথচ পাণিনিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধ্বনিবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন: ‘পাণিনিস অ্যাচিভমেন্ট অ্যাজ আ ইনগুইস্ট হ্যাজ হার্ডলি বিন ইক্যুয়ালড অ্যানিহোয়ার...’। বিশ শতকে পশ্চিমে বর্ণনামূলক ভাষাচর্চার যে স্ফূর্তি আমরা দেখি, আবদুল হাই মনে করেন, এর শিকড় প্রোথিত রয়েছে ভারত-ভূমিতে। কারণ, পাণিনি, পতঞ্জলি ওই ধারারই বিশ্লেষক।

মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের দুটি বই বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন এবং ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের দুটি বই বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন এবং ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব

বাংলা ভাষার সংস্কার প্রশ্নে আবদুল হাই বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করেন। আজ আমরা বিদেশি শব্দের বানানে দীর্ঘ-ঈ এবং দীর্ঘ-ঊ বাদ দিয়েছি। আবদুল হাই দেখিয়েছেন, বাংলা ধ্বনির দীর্ঘ ও হ্রস্ব উচ্চারণে শব্দের অর্থের কোনো বদল ঘটে না। তাই বাংলা শব্দে কেবল হ্রস্ব-ই এবং হ্রস্ব-উ থাকলেই চলে। তবে বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণে তিনি ঈ, ঊ ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন। অন্য সব শব্দে—তৎসম-অতৎসম ভেদ না করে—তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছেন কেবল ই এবং উ। যুক্তাক্ষরের রূপকে স্বচ্ছ করার কথা বলেছেন। উ-কারের বহু রকম আকারকে তিনি এক রকম করতে চেয়েছেন; যেমনশু, রু, হু নয়; সব সময় শু, রু, হু  ইত্যাদি। আবার র-ফলার আকারও সব এক করতে চেয়েছেন; তার মানে ত্রাণ হবে ত্রাণ, ভ্রমণ হবে ভ্রমণ ইত্যাদি। ব-ফলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এর কী প্রয়োজন যেখানে দ্বিত্ব উচ্চারণই নেই। যেমন ত্বক, শ্বাপদ ইত্যাদি বানানকে লিখতে চেয়েছেন তক, শাপদ এ রকমভাবে। দেখা যায়, বানানের ব্যাপারে আবদুল হাই ব্যুৎপত্তিবাদী নন, উচ্চারণবাদী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বানানকে মূলত উচ্চারণ-অনুগ করতে চেয়েছেন। ভাষার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আবদুল হাই গাড়ির নম্বরপ্লেট, দোকানের সাইনবোর্ড—এসব থেকে ইংরেজি একেবারে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছেন।

বাংলা লিখিত ও মৌখিক ভাষার প্রমিত রূপ বা আদর্শ রূপ হিসেবে বিশ শতকের গোড়ার দিকে ‘চলিত ভাষা’ প্রধান জায়গা করে নেয়। কলকাতাকেন্দ্রিক (অনেকের মতে, নদীয়াকেন্দ্রিক) এই মান্যায়নে আবদুল হাইয়ের আক্ষেপ ছিল। তিনি দুঃখ নিয়ে বলেছেন, পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পরও পূর্ব বাংলার কোনো উপভাষা আদর্শ বা মান্য হতে পারেনি। তিনি ভেবেছেন, ‘ঢাকাইয়া বাংলা’ পূর্ব বাংলা অঞ্চলের আদর্শ ভাষারূপ হতে পারত। তবে এ ভূখণ্ডের মানুষ কলকাতার ভাষা নিয়ে এত দূর এগিয়ে গেছে যে ভাষার প্রমিতীকরণে তিনি আর অন্য পথ ধরতে চাননি। আঞ্চলিক ভাষা গবেষণাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। কাজ করেছেন সিলেটের উপভাষা, চট্টগ্রামের উপভাষা এবং ঢাকার উপভাষা নিয়ে। পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন দুটি প্রবন্ধ: ‘ফোক সংস অ্যান্ড ফোক লিটারেচার’ এবং ‘ইনডিজেনাস গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস’। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র সঙ্গে যুক্ত থেকে লিখেছেন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিষয়ক বই ট্র্যাডিশনাল কালচার ইন ইস্ট পাকিস্তান

পশ্চিমে জীবন শুরুই হয় নাকি চল্লিশের পর। আর আমরা পূর্ব-ভারতীয়রা চল্লিশেই যাই বুড়িয়ে। তাই চল্লিশের চোখের রোগকে বলে চালশে। কিন্তু এ অঞ্চলেও পঞ্চাশ বছর কি চলে যাওয়ার বয়স হতে পারে? আবদুল হাই চলে গেলেন ঠিক পঞ্চাশে। মৃত্যুর বছরেই বলেছিলেন, এবার নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার সময় এসেছে। তিনি ঠিকই তাঁর কথা রাখলেন। জায়গা করে দিলেন নতুনদের। কিন্তু তাঁর পরবর্তীকালের আর কেউ কি বাংলা বিভাগকে এতখানি দিতে পেরেছেন? কিংবা বাংলা ভাষা গবেষণায়? হয়তো আরও কিছুদিন থাকা প্রয়োজন ছিল তাঁর।

মুহম্মদ আবদুল হাই

l আবদুল হাইয়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের মরিচা গ্রামে।

l মাদ্রাসা থেকে ১৯৩৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৮ সালে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। দুই পরীক্ষাতেই তিনি বোর্ডে স্থান পান।

l আইএ পাস করার আগেই বিয়ে করেন মরিচা গ্রামের জমিদারকন্য আনিসা বেগমকে।

l ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে আবদুল হাইই প্রথম মুসলমান ছাত্র, যিনি বাংলায় অনার্স (১৯৪১) ও মাস্টার্স (১৯৪২)—দুই পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন।

l আবদুল হাইয়ের প্রথম গ্রন্থ একটি অনুবাদ। মানবেন্দ্র রায়ের দ্য হিস্টরিক্যাল রয়েল অব ইসলাম-এর বাংলা রূপ দিয়ে ১৯৪৯ সালে লেখেন ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান

l বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞানের ওপর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন মুহম্মদ আবদুল হাই। ১৯৬৪-তে বের হয় তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের গ্রন্থবদ্ধ রূপ ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব

l ধ্বনিনিয়ে গবেষণা করতে লন্ডনে গিয়েছিলেন তিনি। ছিলেন দুই বছর। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৫৮-এ লিখলেন ভ্রমণকাহিনি বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন

l ১৯৬৯ সালের ৩ জুন আবদুল হাই ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান। অনেকে বলেন, এটি আত্মহত্যা। কেউ কেউ বলেন, এটি হত্যাযজ্ঞ। তাঁর মৃত্যু শেষ পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেল।