প্রাণশক্তির রসস্রোত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

অনেকের ধারণা আছে যে বুঝি লড়াই করে’ দ্বন্দ্বসংঘর্ষের মধ্য দিয়েই শক্তি প্রকাশিত হয়। তারা এ কথা স্বীকার করে না যে সৌন্দর্য্য মানুষের বীর্য্যের প্রধান সহায়। বসন্তকালে গাছপালার যে নবকিশলয়ের উদ্যম হয়, তা যেমন তার অনাবশ্যক বিলাসিতা নয়, বাস্তবিক পক্ষে সে যেমন তার বড় সৃষ্টির একটি প্রক্রিয়া, তেমনি বড় বড় জাতির জীবনে যে রসসৌন্দর্য্যের বিস্তার হয়েচে তা তাদের পরিপুষ্টিরই উপকরণ জুগিয়েছে। এই-সকল রসই জাতির জীবনকে নিত্য নবীন করে’ রাখে, তাকে জরার আক্রমণ থেকে বাঁচায়, অমরাবতীর সঙ্গে মর্ত্ত্যলোকের যোগ স্থাপন করে, এই রসসৌন্দর্য্যই মানবচিত্তে আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় বিকশিত হয়। কেবল দেহেরই নয়, মনেরও জীবন আছে; সঙ্গীত হচ্চে তারই তৃষ্ণার একটি পানীয়, এই পানীয়ের দ্বারা মনের প্রাণশক্তি সতেজ হয়ে ওঠে।

জীবন নীরস হলে সঙ্গে সঙ্গে তা নির্ব্বীর্য্য হয়ে পড়ে। কিন্তু শুষ্কতার কঠোরতাই যে বীর্য্য এমন কথা আমাদের দেশে প্রায়ই শুন্‌তে পাওয়া যায়। অবশ্য বাহিরে বীর্য্যের যে প্রকাশ সেই প্রকাশের মধ্যে একটা কঠিন দিক আছে, কিন্তু অন্তরের যে পূর্ণতা সেই কাঠিন্যকে রক্ষা করে সেই পূর্ণতার পরিপুষ্টি কোথা থেকে? এ হচ্চে আনন্দরস থেকে। সেইটে চোখে ধরা পড়ে না বলে’ তাকে আমরা অগ্রাহ্য করি, তাকে বিলাসের অঙ্গ বলে’ কল্পনা করি।

গাছের গুঁড়ির কাষ্ঠ-অংশটাকে দিয়েই ত গাছের শক্তি ও সম্পদের হিসাব কর্‌লে চল্‌বে না। সেটাকে খুব স্থূলরূপে স্পষ্ট করে’ দেখা যায় সন্দেহ নেই; আর গূঢ়ভাবে তার অণুতে অণুতে যে রস সঞ্চারিত হয়, যে রসের সঞ্চারণই হচ্চে গাছের যথার্থ প্রাণশক্তি, সেটা স্থূল নয়, কঠিন নয়, বাহিরে সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ নয় বলেই তাকে খর্ব্ব করা সত্য-দৃষ্টির অভাব বশতঃই বটে। গুঁড়ির সত্যটা রসের সত্যের চেয়ে বড় নয়, গুঁড়ির সত্য রসের সত্যের উপরেই নির্ভর করে, এই কথাটা আমাদের মনে রাখ্‌তে হবে।

যখন দেখ্‌তে পাব যে আমাদের দেশে সঙ্গীত ও সাহিত্যের ধারা বন্ধ হয়েছে, তখন বুঝ্‌ব দেশে প্রাণশক্তির স্রোতও অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সেই প্রাণশক্তিকে নানা শাখা-প্রশাখায় পূর্ণভাবে বহমান করে’ রাখ্‌বার জন্যেই, বিশ্বের গভীর কেন্দ্র থেকে যে অমৃতরস-ধারা উৎসারিত হচ্ছে তাকে আমাদের আবাহন করে’ আন্‌তে হবে। ভগীরথ যেমন ভস্মীভূত সগর-সন্তানদের বাঁচাবার জন্যে পুণ্যতোয়া গঙ্গাকে মর্ত্ত্যে আমন্ত্রণ করে’ এনেছিলেন তেমনি মানসলোকের ভগীরথেরা প্রাণহীনতার মধ্যে অমৃতত্ব সঞ্চারিত কর্‌বার জন্য আনন্দরসের বিচিত্র ধারাকে বহন করে’ আন্‌বেন।

সমস্ত বড় বড় জাতির মধ্যেই এই কাজ চল্‌চে। চল্‌চে বলে’ই তারা বড়। পার্লামেণ্টে, বাণিজ্যের হাটে, যুদ্ধের মাঠে তাঁরা বুক ফুলিয়ে তাল ঠুকে বেড়ান বলেই তাঁরা বড় তা নয়। তাঁরা সাহিত্যে সঙ্গীতে কলা-বিদ্যায় সকল দেশের মানুষের জন্যে সকল কালের রসস্রোত নিত্য প্রবহমান করে’ রাখ্‌চেন বলেই বড়।

>সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল
রবীন্দ্রনাথের ছোট ছোট কিছু লেখা এখনো লোকলোচনের অগোচরে রয়ে গেছে। কবি তাঁর সমকালের সাময়িকপত্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশিসংখ্যক রচনা প্রকাশ করেছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত সেকালের শ্রেষ্ঠ মাসিকপত্র প্রবাসীতে (প্রথম প্রকাশ, এলাহাবাদ, ১৩০৮ বঙ্গাব্দ)। প্রবাসীতে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যদের লেখা অন্যান্য পত্রিকা থেকে ‘কষ্টিপাথর’ বিভাগে নিয়মিত পুনর্মুদ্রিত হতো। দেবী প্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত নব্যভারত পত্রিকা (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯) থেকে পরের মাসের প্রবাসীতে (২২শ ভাগ, ১ম খণ্ড, ৩য় সংখ্যা) রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণশক্তির রসস্রোত’ শিরোনামে একটি ছোট মহার্ঘ্য লেখা পুনর্মু‌দ্রিত হয়েছিল। এটি এখন পর্যন্ত রবীন্দ্ররচনাবলি (বিশ্বভারতী, ৩৩ খণ্ড) কিংবা কবির কোনো বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। রবীন্দ্রতথ্যভান্ডারি পুলিনবিহারী সেন সংকলিত সাময়িকপত্রে মুদ্রিত রবীন্দ্ররচনার তালিকায় এই লেখাটির কথা আছে এবং সংকলকের মন্তব্য উল্লেখ আছে: ‘অপ্রকাশিত’ এখানে ‘অপ্রকাশিত’ অর্থ অগ্রন্থিত। এখনো অগ্রন্থিত এই ক্ষুদ্র গদ্য রচনাটি কবির একটি দলছুট লেখা। আকারের হ্রস্বতা একটি কারণ। এটিকে লিপিকারদলে ফেলা যায় না। আবার কালান্তর-এর সুদীর্ঘ ওজনদার প্রবন্ধমালার সঙ্গেও তুলনা করা যাচ্ছে না। অনুমান করি, কবি-সুহৃদ নব্যভারত সম্পাদকের উপরোধে কবি এই লেখাটি তাঁর পত্রিকার জন্য পাঠিয়েছিলেন। রচনাবলির সম্পাদকমণ্ডলীর নজর এড়িয়ে এই ছোট্ট লেখাটি পত্রিকার পাতায় বন্দী হয়েছিল এতকাল। কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মুখছুদুর রহমান, গ্রন্থাগার সহকারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। লেখাটি এখানে প্রকাশের সময় রবীন্দ্রনাথের বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।